ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

টঙ্গীর তুরাগ তীরে বিশ্ব এজতেমা শুরু আজ

প্রকাশিত: ১১:০৮, ১০ জানুয়ারি ২০২০

টঙ্গীর তুরাগ তীরে বিশ্ব এজতেমা শুরু আজ

নূরুল ইসলাম, টঙ্গী থেকে ॥ রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠ টঙ্গীর তুরাগ তীরে আজ শুক্রবার থেকে শুরু হচ্ছে তবলীগ জামাতের প্রথমপর্বের তিন দিনব্যাপী বিশ্ব এজতেমা। বৃহস্পতিবার বিকেলের মধ্যেই এক বর্গকিলোমিটারের এজতেমার বিশাল ময়দান মুসল্লিতে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেছে। প্রথমপর্বে ৬৪ জেলার তবলীগ অনুসারী মুুসল্লিরা অংশগ্রহণ করবেন। প্রথমপর্বের বিশ^ এজতেমার নেতৃত্বে রয়েছেন আলেমি অনুসারী যোবায়ের গ্রুপের দল। দ্বিতীয় পর্বের নেতৃত্বে থাকবেন সা’দপন্থী ওয়াসিকুল ইসলাম ও শাহাবউদ্দিন অনুসারীর দল। তিনদিনের এই বিশ্ব এজতেমার আখেরি মোনাজাত হবে রবিবার। চারদিন বিরতি দিয়ে ১৭ জানুয়ারি থেকে শুরু হবে দ্বিতীয়পর্বের এজতেমা, চলবে ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত। সেখানেও রয়েছে আখেরি মোনাজাতের আনুষ্ঠানিকতা। প্রায় ১০০ দেশের তবলীগ অনুসারী মুসল্লিরা এজতেমায় অংশ নেবেন বলে আযোজকরা জানান। ইতোমধ্যে ৩০ দেশের মুসল্লি এজতেমা ময়দানে এসে উপস্থিত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার বার্ধক্যজনিত কারণে এজতেমায় আসা এক মুুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। দু’পর্বের বিশ^ এজতেমা শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার টঙ্গী বিশ^ এজতেমা ময়দানের ফ্রি চিকিৎসা ক্যাম্পে চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ বিতরণের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ধর্মপ্রতিমন্ত্রী মাওলানা শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ এমপি, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল এমপি ও গাজীপুর সিটি মেয়র জাহাঙ্গীর আলম মুসল্লিদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন এবং এজতেমা আয়োজনের ব্যবস্থাপনা নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। তারা বলেন, বিশ^ এজতেমায় আগত মুসল্লিরা আসা-যাওয়া এবং অবস্থানকালীন যাতে কোন সমস্যায় না পড়েন তার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা হয়েছে। ৪৫টি ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্পের মাধ্যমে মুসল্লিদের চিকিৎসাসেবা দেয়া হবে। চিকিৎসা সেবাদান প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে হামদর্দ ল্যাবরেটরি, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন, ইবনেসিনা ফার্মাসিউটিক্যাল, টঙ্গী ওষুধ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতি, গাজীপুর সিভিল সার্জন অফিস, গাজীপুর জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর, মানবাধিকার কমিশন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, স্বাস্থ্য অধিদফতর, র‌্যাব ফোর্স। হামদর্দ বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান কাজী গোলাম রহমানের সভাপতিত্বে ধর্ম সচিব নুরুল ইসলাম, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি আব্দুল হামিদ জমাদ্দার, হামদর্দের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডাঃ হাকীম ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া প্রমুখ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। বিশ^ এজতেমা সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে এজতেমা আয়োজকরা এজতেমা মাঠটিকে ৯২টি খিত্তায় ভাগ করেছেন। এসব খিত্তায় ৬৪ জেলার মুসল্লিরা অবস্থান করবেন। উদ্বোধনকালে ধর্মপ্রতিমন্ত্রী আলহাজ শেখ মোঃ আব্দুল্লাহ বলেন, টঙ্গীর বিশ্ব এজতেমার খাতিরে বহির্বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের নাম অতি পরিচিত। তাই এজতেমা সারাবিশ্বে বাংলাদেশের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ব এজতেমায় আগত মুসল্লিদের যাতে কোন প্রকার সমস্যা না হয় সেজন্য সরকারের সকল বিভাগকে কড়া নির্দেশ দিয়েছেন। যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মোঃ জাহিদ আহসান রাসেল বলেন, বিশ্ব এজতেমার সকল কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। ইতোমধ্যে দেশ-বিদেশের কয়েক লাখ মুসল্লি ময়দানে সমবেত হয়েছেন। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সমন্বয়ে চৌদ্দটি কমিটি গঠনের মাধ্যমে সুনির্দিষ্টভাবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ময়দানে আগত ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের নির্বিঘেœ চলাচলের জন্য ইতোমধ্যে ময়দানের চারপাশে অত্যাধুনিক ৬ হাজার এলইডি লাইট স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও বিশ্ব এজতেমা ময়দান ও আশপাশের এলাকা দুর্গন্ধ ও রোগ-জীবাণুুমুক্ত রাখতে ছয় শ’ ড্রাম ব্লিচিং পাউডার ও দুই হাজার লিটার কেরোসিন ছিটানো হচ্ছে। মশা-মাছি তাড়াতে ৬০টি ফগার মেশিনে মশানাশক ওষুধ ¯েপ্র করা হচ্ছে এবং রাস্তার ধূলাবালি রোধ করার জন্য প্রতিদিন সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে পানি ছিটানো হবে। এছাড়াও ৬০টি গার্বেজ ট্রাকের মাধ্যমে দিনরাত বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রম চলবে। রাস্তায় এলইডি লাইটের মাধ্যমে মুসল্লিদের চলাচলের সুব্যবস্থা করা হয়েছে। র‌্যাবের কার্যক্রম বৃহস্পতিবার সকালে র‌্যাব কার্যালয়ে এক ব্রিফিংয়ে র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজির আহমেদ বলেন, তিন দিনব্যাপী বিশ^ এজতেমার নিরাপত্তা দিতে পোশাকে এবং সাদা পোশাকে র‌্যাব সদস্যদের নিয়ে পুরো এজতেমা ময়দানকে ঘিরে ফেলা হয়েছে। স্থল, আকাশ ও নৌপথে র‌্যাবের টহল ব্যবস্থা থাকবে সার্বক্ষণিক। সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব ছড়ানো রুখে দেয়ার লক্ষ্যে নেয়া হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। মহাসড়কে যানজট বৃহস্পতিবার সকাল থেকে টঙ্গী-গাজীপুর সড়ক, আব্দুল্লাহপুর-চন্দ্রা সড়ক, টঙ্গী-কালীগঞ্জ সড়ক ও টঙ্গী এয়ারপোর্ট সড়কে প্রচ- যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। পর্যাপ্ত সংখ্যক ট্রাফিক পুলিশ দায়িত্বে না থাকায় এমন অবস্থা দেখা দিয়েছে বলে এজতেমা আসা মুুসল্লিরা বলেছেন। অপরদিকে টঙ্গী-গাজীপুর সড়কে বিআরটি কাজের জন্য রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কারণে রাস্তা সরু থাকায় যানবাহনের চাপ এক লাইনে পড়ছে। এতেও দেখা দিয়েছে যান চলাচলে ভোগান্তি। গাজীপুর মেট্রোপলিটন হাইওয়ে পুলিশের এসি (সাউথ) থোয়াই মারমা জানান, বিশ্ব এজতেমায় আগত মুসল্লিদের যানবাহনের কারণে রাস্তায় গাড়ির চাপ বেড়ে যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। যেসব শূরা সদস্য ময়দানে উপস্থিত এজতেমা ময়দানে ভারত ও পাকিস্তানের কয়েকজন শূরা সদস্য উপস্থিত রয়েছেন। তারা হলেন ভারতের মাওলানা আহমদ লাট, মাওলানা ইব্রাহীম দেওলা, মাওলানা ফারুক ওরফে ভাই ফারুক, মাওলানা জুহায়েরুল হাসান, মাওলানা ইসমাইল গোদরা ও পাকিস্তানের মাওলানা জিয়াউল হক, মাওলানা খুরশিদ আলম, মাওলানা ডাঃ নওশাদ, মাওলানা ফাহিম, মাওলানা হাসমত উল্লাহ, মাওলানা বখতে মুনির ও মাওলানা শাহেদ। সিসি ক্যামেরার আওতায় এজতেমা ময়দান বৃহস্পতিবার থেকে এজতেমার চারপাশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। প্রায় আট হাজার বিভিন্ন সংস্থার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এজতেমার শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত থাকবে। এবারও বিশ্ব এজতেমা ময়দানসহ মাঠের আশপাশসহ সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে। এজতেমাস্থলের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে অলিম্পিয়া টেক্সটাইল মিলস্ প্রাঙ্গণে পুলিশের এক ব্রিফিংয়ে গাজীপুর মেট্রোপলিট পুলিশ কমিশনার মোঃ আনোয়ার হোসেন এসব তথ্য জানান। তিনি আরও জানান, টঙ্গী ব্রিজ থেকে জয়দেবপুর চৌরাস্তা, মন্নু গেট থেকে কামারপাড়া পর্যন্ত এবং তুরাগ নদসহ পুরো এলাকাকে পাঁচটি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি সেক্টরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কঠোর নজরদারির মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করবেন। প্রবেশ পথগুলোতে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। এদিকে মুসল্লিদের নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এজতেমা ময়দান ও আশপাশের এলাকায় পাঁচ-স্তরের নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলেছে। যাতে কোন কুচক্রীমহল এজতেমা ময়দানে কোন ধরনের জঙ্গী কার্যক্রম চালিয়ে নাশকতা সৃষ্টি করতে না পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা যে কোন জঙ্গী কার্যক্রম প্রতিহত করতে প্রস্তুত রয়েছে বলে জানান গাজীপুরের পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার জানান। সেবা সংস্থাসমূহ এদিকে ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, এজতেমাস্থলে তাদের একটি কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়েছে। যেখানে সার্বক্ষণিক কর্মকর্তাসহ ফায়ারম্যানরা অবস্থান করবেন। ময়দানের প্রতি খিত্তায় ফায়ার এক্সস্টিংগুইসারসহ ফায়ারম্যান, গুদাম ঘর ও বিদেশী মেহমানখানা এলাকায় পানিবাহী গাড়ি, ডুবুরী ইউনিট, একটি স্ট্যান্ডবাই লাইটিং ইউনিট এবং পাঁচটি এ্যাম্বুলেন্স থাকবে। ডেসকো কর্তৃপক্ষ জানায়, এজতেমা এলাকায় সার্বক্ষণিক বিদ্যুত সরবরাহের সকল প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। উত্তরা, টঙ্গী সুপার গ্রিড ও টঙ্গী নিউ গ্রিডকে মূল ১৩২ কেভি সোর্স হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে। যে কোন একটি গ্রিড নষ্ট হলেও সামগ্রিক বিদ্যুত সরবরাহ বিঘিœত হবে না বলে জানায় ডেসকো কর্তৃপক্ষ। এজতেমা এলাকায় চারটি স্ট্যান্ডবাই জেনারেটর এবং পাঁচটি ট্রলি-মাউন্টেড ট্রান্সফরমারও সংরক্ষণ করা হয়েছে মুসল্লিদের সার্বক্ষণিক বিদ্যুত সরবরাহে। এজতেমায় বিশেষ ট্রেন ও বাস সার্ভিস এজতেমা ময়দানে মুসল্লিদের যাতায়াতের সুবিধার্থে বৃহস্পতিবার থেকে বিআরটিসির শতাধিক স্পেশাল বাস সার্ভিস চলাচল করতে দেখা গেছে। জানা যায়, আব্দুল্লাহপুর-মতিঝিল ভায়া এজতেমাস্থল, শিববাড়ী-মতিঝিল ভায়া এজতেমাস্থল, টঙ্গী-মতিঝিল ভায়া এজতেমাস্থল, গাজীপুর-চৌরাস্তা, মতিঝিল-ভায়া এজতেমাস্থল, গাবতলী-গাজীপুর ভায়া এজতেমাস্থল, গাবতলী-মহাখালী ভায়া এজতেমাস্থল, গাজীপুর-মতিঝিল ভায়া এজতেমাস্থল, মতিঝিল-বাইপাইল ভায়া এজতেমাস্থল বিআরটিসির বাস সার্ভিস চলাচল করবে। এছাড়া বাংলাদেশ রেলওয়ে বিশেষ ট্রেন সার্ভিস পরিচালনা করবে। এ ছাড়াও সকল আন্তঃনগর, মেইল এক্সপ্রেস ও লোকাল ট্রেনে অতিরিক্ত কোচ সংযোজন করা হয়েছে। এজতেমা চলাকালে সকল আন্তঃনগর ট্রেন টঙ্গী রেলস্টেশনে দুই মিনিট করে যাত্রা বিরতি করবে।
×