ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সংসদে ভাষণে রাষ্ট্রপতি

জাতীয় ঐকমত্য ছাড়া শান্তি ও সমৃদ্ধি স্থায়ী রূপ নিতে পারে না

প্রকাশিত: ১১:০৫, ১০ জানুয়ারি ২০২০

জাতীয় ঐকমত্য ছাড়া শান্তি ও সমৃদ্ধি স্থায়ী রূপ নিতে পারে না

সংসদ রিপোর্টার ॥ রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা, আইনের শাসন ও অব্যাহত আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সকল রাজনৈতিক দল, শ্রেণী ও পেশা নির্বিশেষে সকলের ঐকমত্য গড়ে তোলার সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, জাতীয় ঐকমত্য ব্যতীত শান্তি ও সমৃদ্ধি স্থায়ী রূপ নিতে পারে না। শত প্রতিকূলতা, বাধা-বিপত্তি ও বৈরিতার মধ্যেও দেশে সুশাসন সুসংহতকরণ এবং গণতন্ত্র চর্চা ও উন্নয়ন কর্মসূচীতে তৃণমূল থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সরকারের প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে। দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছেন, ইতিহাসের সাহসী সন্তানরা লাখো প্রাণের বিনিময়ে একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিয়ে গেছেন। আমাদের দায়িত্ব এ দেশ ও জাতির অগ্রযাত্রাকে বেগবান করা। ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত গৌরবোজ্জ্বল স্বাধীনতা সমুন্নত ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুজ্জ্বল রাখতে দেশ থেকে দুর্নীতি-সন্ত্রাস-মাদক ও জঙ্গীবাদ সম্পূর্ণরূপে নির্মূলের মাধ্যমে শোষণমুক্ত সমাজপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে বাঙালী জাতিকে আরও ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বৃহস্পতিবার একাদশ জাতীয় সংসদের ২০২০ সালের প্রথম অধিবেশনে (শীতকালীন) ভাষণে রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, একাত্তরের শহীদদের কাছে আমাদের অপরিশোধ্য ঋণ রয়েছে। তাই আসুন, ধর্মবর্ণগোত্র নির্বিশেষে দলমতপথের পার্থক্য ভুলে জাতির গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা ও দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার মধ্য দিয়ে আমরা লাখো শহীদের রক্তের ঋণ পরিশোধ করি। রাষ্ট্রপতি বলেন শান্তি, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির যে পথে আমরা হাঁটছি, সে পথেই বাংলাদেশকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এ বছর আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং ২০২১ সালে মধ্য-আয়ের দেশ হিসেবে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করব। আমাদের দৃষ্টি ২০২১ সাল ছাড়িয়ে আরও সামনের দিকে, ২০৪১ সালে বিশ্বসভায় বাংলাদেশ একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশের মর্যাদায় অভিষিক্ত হবে- এটাই জাতির প্রত্যাশা। আমি দৃঢ়ভাবে আশাবাদী, সুশাসন এবং সমাজের সকলস্তরে জনগণের সর্বাত্মক অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমরা সরকার নির্ধারিত লক্ষ্যসমূহ অর্জনসহ একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনে সক্ষম হব। রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, জাতীয় সংসদ দেশের জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার কেন্দ্রবিন্দু। জাতীয় ঐকমত্য ব্যতীত শান্তি ও সমৃদ্ধি স্থায়ী রূপ নিতে পারে না। গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা, আইনের শাসন ও অব্যাহত আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সকল রাজনৈতিক দল, শ্রেণী ও পেশা নির্বিশেষে সকলের ঐকমত্য গড়ে তোলার সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য আমি উদাত্ত আহ্বান জানাই। স্বচ্ছতা, জবাবদিহী, পরমতসহিষ্ণুতা, মানবাধিকার ও আইনের শাসন সুসংহতকরণ এবং জাতির অগ্রযাত্রার স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষার সফল বাস্তবায়নে সরকারী দলের পাশাপাশি বিরোধী দলকেও গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে হবে। তিনি সরকারী দল ও বিরোধী দল নির্বিশেষে সংশ্লিষ্ট সকলকে জনগণের প্রত্যাশা পূরণের প্রতিষ্ঠান এই মহান জাতীয় সংসদে যথাযথ ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় নতুন বছরের প্রথম অধিবেশনে রাষ্ট্রপতি তাঁর ভাষণে সরকারের উন্নয়ন-সফলতা-অগ্রগতি এবং আগামীদিনের মহাপরিকল্পনার কথা জাতির সামনে তুলে ধরেন। অধিবেশন এক ঘণ্টা মুলতবির পর সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে স্পীকার রাষ্ট্রপতির আগমনের ঘোষণা দিলে সশস্ত্র বাহিনীর একটি বাদক দল বিউগলে ‘ফ্যানফেয়ার’ জানিয়ে রাষ্ট্রপতিকে সম্ভাষণ জানান। স্যুট-কোট পরিহিত রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ অধিবেশন কক্ষে প্রবেশ করলে নিয়ম অনুযায়ী জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রীসহ সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা দাঁড়িয়ে তাঁকে সম্মান জানান। সংসদে রাষ্ট্রপতির জন্য স্পীকারের ডানপাশে লাল রঙের গদি সংবলিত চেয়ার রাখা হয়। প্রায় সোয়া এক ঘণ্টা স্পীকারের আসনের বাম পাশে রাখা রোস্ট্রামে দাঁড়িয়ে ১৬৩ পৃষ্ঠার ভাষণের সংক্ষিপ্তসারে রাষ্ট্রপতি দেশের অর্থনীতি, বাণিজ্য-বিনিয়োগ, খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে সরকারের কার্যক্রম ও সাফল্য তুলে ধরেন। তাঁর দীর্ঘ ভাষণের সময় সংসদ সদস্যরা মুহুর্মুহু টেবিল চাপড়িয়ে রাষ্ট্রপতিকে উৎসাহিত করেন। এর আগে বিকেল ৫টার দিকে সংসদের উত্তর প্লাজা দিয়ে সংসদ ভবনে প্রবেশ করেন রাষ্ট্রপতি। ভাষণ শেষে জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি সংসদ অধিবেশন ত্যাগ করেন। রাষ্ট্রপতির ভাষণের সময় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, তিন বাহিনী প্রধানগণ, বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার ও দাতা সংস্থার প্রতিনিধিরা ভিভিআইপি লাউঞ্জে বসে পুরো ভাষণ শোনেন। রাষ্ট্রপতির ভাষণের পর স্পীকার সংসদ অধিবেশন আগামী সোমবার বিকেল ৪টা পর্যন্ত মুলতবি ঘোষণা করেন। রাষ্ট্রপতি তাঁর ভাষণের শুরুতে জাতির পিতাসহ ১৫ আগস্টের সকল শহীদ, জাতীয় চার নেতা এবং স্বাধীনতাপরবর্তী সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেন, সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে একাদশ জাতীয় সংসদ গঠিত হয় এবং বর্তমান সরকারের ওপর দেশ পরিচালনার গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয়। বাংলাদেশের জনগণের বিপুল সমর্থনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়। তিনি বলেন, গত মহাজোট সরকারের ধারাবাহিকতায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজীবন লালিত স্বপ্ন সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য-আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত-সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। সরকারের নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের শ্রেণীতে উত্তরণের সকল যোগ্যতা অর্জন করেছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোলমডেল। মুজিববর্ষ উদ্যাপনের কথা তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি বলেন, এ বছর উদ্যাপিত হবে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী। জাতির পিতার জীবনাদর্শ, জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য তাঁর অব্যাহত সংগ্রাম, নির্ভীক, দূরদর্শী ও প্রজ্ঞাময় নেতৃত্ব এবং তাঁর গভীর দেশপ্রেম জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিম-লে স্বীকৃত। নতুন প্রজন্মের কাছে এবং জাতীয়-আন্তর্জাতিকভাবে জাতির পিতার জীবনাদর্শ ও কর্ম বিশেষভাবে উপস্থাপনের জন্য মুজিববর্ষ উদ্যাপনের বিস্তারিত কর্মসূঈ গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে উদ্যাপনের লক্ষ্যে বিষয়ভিত্তিক সমন্বিত কর্মপরিকল্পনায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দফতরে মোট ২৯৩টি কর্মসূঈ নির্ধারণ করা হয়েছে। ১৭ মার্চ ২০২০ হতে ১৭ মার্চ ২০২১ পর্যন্ত মুজিববর্ষে দেশ ও দেশের বাইরে সরকারী কর্মসূচী ছাড়াও বেসরকারী, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা সকলেই জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে যার যার নিজস্ব কর্মসূচী বাস্তবায়ন করবে। দুর্নীতি-সন্ত্রাস-মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি দুর্নীতি-সন্ত্রাস ও মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির কথা উল্লেখ করে রাষ্ট্রপ্রধান আবদুল হামিদ বলেন, দেশের আইনের শাসন সুসংহত ও সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে সরকারের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরও শক্তিশালী করা হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও তথ্য কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা এবং যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার রায় কার্যকর করা হয়েছে। পলাতক আসামিদের স্বদেশে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও হত্যা মামলা এবং বিডিআর হত্যাকা- মামলার বিচারকার্য সম্পন্ন হয়েছে এবং আদালত কর্তৃক দোষীদের বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া হলি আর্টিজান হামলা মামলা, নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলাসহ বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার রায় দ্রুত প্রদান করা হয়েছে। দুর্নীতি, জুয়া, মাদক, জঙ্গীবাদ ও উগ্রবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছে এবং জনজীবনে স্বস্তি বিরাজ করছে। এশিয়ায় সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশ বাংলাদেশ সরকারের উন্নয়ন ও সফলতা তুলে ধরতে গিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, বাংলাদেশ আজ এশিয়ার সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশ। পরপর তিনটি অর্থবছরে ৭ শতাংশের বেশি হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের পর গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। দেশের জনগণের মাথাপিছু আয় দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। গত অর্থবছরে মাথাপিছু জাতীয় আয় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৯০৯ মার্কিন ডলারে, গত এক দশকে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে তিনগুণ। তিনি বলেন, দেশে দারিদ্র্যের হারও দ্রুত কমে এসেছে। ২০০৫ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪০ শতাংশ; যা ২০১৯ সালে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। অতি দারিদ্র্যের হার কমে হয়েছে ১০ দশমিক ১৫ শতাংশ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবসম্পদ উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়নসহ সামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশে অভাবনীয় অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। উন্নয়ন প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সাফল্য। রাজস্ব নীতি ও সহায়ক মুদ্রানীতি অনুসরণের মাধ্যমে সরকার সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা ও উৎকর্ষের স্বাক্ষর রেখে চলেছে। মুদ্রাস্ফীতি ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৫ শতাংশ। সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪১টি দেশের মধ্যে ৯৫তম। বিশ্বে বাংলাদেশ উন্নয়ন-বিস্ময় রাষ্ট্রপতি তাঁর ভাষণে আরও বলেন, উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সার্থক উত্তরসূরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের যাত্রা পথে আলোর দিশারী। অনেক বাধা ও ষড়যন্ত্র পেরিয়ে তাঁর বলিষ্ঠ ও প্রত্যয়ী নেতৃত্বে জনকল্যাণমুখী আধুনিক বাংলাদেশ বর্তমান বিশ্বের উন্নয়ন-বিস্ময়। আর্থ-সামাজিক সকল সূচকে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোলমডেল। বাংলাদেশ বর্তমান বিশ্বে উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের অগ্রযাত্রার পথরেখাও সুনির্দিষ্ট। সহ¯্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এমডিজি অর্জনে সাফল্যের ধারাবাহিকতা বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণ ঘটাবে এবং রূপকল্প- ২০২১ এর দুর্নিবার যাত্রা আমাদের পথের দিশারী। একই সঙ্গে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট এসডিজি অর্জনে গৃহীত কর্মসূচীসমূহ এবং ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়নের মাধ্যমে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশ হবে সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত সোনার বাংলা- বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা। কিন্তু আমাদের ভবিষ্যত নাগরিকদের জন্য উন্নয়ন ও অগ্রগতি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং পরিবেশগতভাবে টেকসই না হলে তা অর্থবহ হবে না। এ উপলব্ধি থেকে প্রধানমন্ত্রী আমাদের জন্য শতবর্ষী বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ অনুমোদন করেছেন। যুগোপযোগী এসব পরিকল্পনাকে বাস্তব রূপ দেয়ার লক্ষ্যে সরকারের মন্ত্রণালয়, বিভাগ এবং দফতরসমূহ নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। ধর্মীয় সংস্কৃতির বিকাশ এবং ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে জনগণের নৈতিক মান ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। দেশের সকল সম্প্রদায়ের মানুষ যাতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিসহকারে স্ব স্ব ধর্ম চর্চা করতে পারে সে ব্যাপারে সরকার বদ্ধপরিকর। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রীস্টানসহ সকল সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসবসমূহ নির্বিঘেœ যথাযথ ভাবগাম্ভীর্য ও উৎসবমুখর পরিবেশে শান্তিপূর্ণভাবে উদ্যাপিত হচ্ছে। ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে সকল সম্প্রদায়ের সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বর্তমান সরকার ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকা-কে যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করেছে। শিক্ষা বিষয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, শিক্ষা জাতির সার্বিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির চাবিকাঠি। এ উপলব্ধি থেকে প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বজনীন ও বাধ্যতামূলক করে নিরক্ষরমুক্ত সোনার বাংলা বিনির্মাণে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। তারই ধারাবাহিকতায় তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা শিক্ষা খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকল্পে নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। জাতির পিতা ১৯৭৩ সালে ৩৬ হাজার ১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ এবং ১ লাখ ৫৭ হাজার ৭২৪ শিক্ষককে সরকারী করেন। জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালে দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো একসঙ্গে ২৬ হাজার ১৯৩টি রেজিস্টার্ড বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন এবং প্রায় এক লাখ ৫ হাজার শিক্ষকের চাকরি সরকারীকরণ করেন। ২০২১ সালেই খুলে যাবে পদ্মা সেতু রাষ্ট্রপতি বলেন, দেশের সর্বত্র নিরবচ্ছিন্ন, নিরাপদ ও সময় সাশ্রয়ী সড়ক যোগাযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সেতু বিভাগ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে এবং ২০২১ সালের জুন নাগাদ সেতুটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়। তিনি বলেন, এই সেতু এশিয়ান হাইওয়েতে অবস্থিত হওয়ায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সড়ক নেটওয়ার্কসহ দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে অবস্থিত দেশগুলোর মধ্যে যাতায়াত ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। জাতীয় জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২ শতাংশ বৃদ্ধি এবং প্রতিবছর দশমিক ৮৪ শতাংশ হারে দারিদ্র্য নিরসনের মাধ্যমে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এই সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। কূটনৈতিক সফলতার আরও একটি বছর গত এক বছরে কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশের সফলতার কথা উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, বঙ্গবন্ধুর প্রণীত পররাষ্ট্রনীতির মূলমন্ত্র : সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়- এই নীতির ওপর ভিত্তি করে বাণিজ্য প্রতিঘাত ও শরণার্থী সমস্যা জর্জরিত বর্তমান বিশ্বের নানাবিধ চ্যালেঞ্জ সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবেলার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ অতিক্রম করেছে কূটনৈতিক সফলতার আরও একটি বছর। বিশ্ব শান্তি, জলবায়ু পরিবর্তন, আন্তর্জাতিক অভিবাসন, নিরাপত্তা ইস্যুতে বাংলাদেশের সরব উপস্থিতি আন্তর্জাতিক মহলে দেশের ভাবমূর্তির ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শীতা এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সক্রিয় ভূমিকা বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে একটি উদার, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও দায়িত্বশীল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর শান্তির বার্তায় চলমান উন্নয়নে গণতন্ত্রের পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী সকল সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ অনুসন্ধানের মূল্যবান দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন, যা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় ভূয়সী প্রশংসা লাভ করেছে। তিনি বলেন, মানবিক দিক বিবেচনায় বাংলাদেশ মিয়ানমারের ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সাময়িকভাবে আশ্রয় প্রদান করেছে। এ বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার উপস্থিতি বাংলাদেশের জন্য ব্যাপক আর্থ-সামাজিক ও পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ এবং পুরো অঞ্চলটির জন্য নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করেছে। বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা যেন মিয়ানমারে নিরাপদে প্রত্যাবর্তন করে পূর্ণ মর্যাদার সঙ্গে পুনর্বাসিত হতে পারে সে বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় ও কার্যকর উদ্যোগ কামনা করি।
×