ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির মতোই বিমান থেকে নেমে আসবেন বঙ্গবন্ধু ;###;এ সময় তোপধ্বনি করা হবে ;###;থাকবে প্রতীকী অভ্যর্থনা ও গার্ড অব অনার ;###;আলোক প্রক্ষেপণের মাধ্যমে মুহূর্তটি জীবন্ত করে তোলা হবে

ক্ষণগণনা শুরু ॥ বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরার প্রতীকী উপস্থাপনা

প্রকাশিত: ১১:০৩, ১০ জানুয়ারি ২০২০

ক্ষণগণনা শুরু ॥ বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরার প্রতীকী উপস্থাপনা

উত্তম চক্রবর্তী/মোরসালিন মিজান ॥ আজ যেখানে পুরনো বিমানবন্দর, স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন সেখানেই প্রথম পা রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাঙালীর মহান নেতা মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস বন্দী ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে। চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের কয়েকদিন পর ১০ জানুয়ারি দেশের মানুষের কাছে ফিরতে সক্ষম হন তিনি। তাঁকে বহন করে নিয়ে আসা বিশেষ বিমান যেখানে প্রথম মাটি ছুঁয়েছিল সেখানেই গড়া হয়েছে নতুন মঞ্চ। এ মঞ্চ থেকেই আজ শুক্রবার শুরু হবে মুজিববর্ষের ক্ষণগণনা। এ উপলক্ষে বিকেলে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে। আগামী ১৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। এদিন থেকে পরবর্তী বছরের ১৭ মার্চ পর্যন্ত সময়কে মুজিববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষ এ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। এ সময়ের মধ্যে জাতীয় পর্যায়ে অসংখ্য উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। থাকবে আরও নানা কর্মসূচী। বছরব্যাপী উৎসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি গভীর অনুরাগ প্রকাশ করবে কৃতজ্ঞ বাঙালী। গান কবিতা নৃত্যায়োজন নাটক সিনেমাসহ সব মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হবে বঙ্গবন্ধুর কীর্তি। বিপুল কর্মযজ্ঞ সামনে রেখে আজ শুরু হচ্ছে আনুষ্ঠানিক ক্ষণগণনা। মুজিববর্ষ শুরুর আগে মূল আয়োজনের বিষয়ে একটি ধারণা দেবে আজকের অনুষ্ঠান। জানা যায়, এই আয়োজন স্মরণীয় করে রাখতে প্রয়োজনীয় সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। মূল অনুষ্ঠান শুরু হবে বিকেল সাড়ে ৪টায়। আমন্ত্রিত অতিথি ও বিশিষ্ট নাগরিকদের উপস্থিতিতে ক্ষণগণনা কার্যক্রমের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় মুজিবর্ষের লোগো উন্মোচন করবেন তিনি। দিনের প্রধান আকর্ষণ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ঐতিহাসিক মুহূর্তটির প্রতীকী উপস্থাপনা। সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ এটি বাস্তবায়ন করবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির মতোই একটি বিমান থেকে নেমে আসবেন জাতির জনক। এ সময় তোপধ্বনি করা হবে। সেইসঙ্গে থাকবে প্রতীকী অভ্যর্থনা ও গার্ড অব অনার প্রদানের ব্যবস্থা। আলোক প্রক্ষেপণের মাধ্যমে মুহূর্তটি জীবন্ত করে তোলা হবে। জানা গেছে, এরই মাঝে সেখানে স্থাপন করা হবে ডিজিটাল ঘড়ি। এ ঘড়ি থেকেই শুরু হবে ক্ষণগণনা। পাশাপাশি অনুষ্ঠানস্থলে স্থাপিত এলইডি স্ক্রিনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর জীবন সংগ্রাম বর্ণনা করা হবে। থাকবে বিভিন্ন অডিও ভিজ্যুয়াল পরিবেশনা। কিউআর কোডের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে জন্মশতর্ষের শুভেচ্ছা ও বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে পারবে কৃতজ্ঞ জাতি। এটিও অভিনব একটি প্রয়াস বলেই ধারণা করা হচ্ছে। জানা যায়, পুরনো বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা অনুসরণ করে প্রায় একই সময় দেশের ৬৪ জেলায় স্থাপন করা হবে ডিজিটাল ঘড়ি। জেলা শহর ও থানা পর্যায়ে এটি ছড়িয়ে দেয়া হবে। সরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে এ ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। ঢাকার সবচেয়ে বড় ঘড়িটি স্থাপন করা হবে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায়। এছাড়া উত্তরা, হাতিরঝিল, কলাবাগান মাঠ, শাহবাগসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি স্থান থেকে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের ক্ষণগণনার তথ্য জানা যাবে। মুজিববর্ষ উদ্যাপনে হাতে নেয়া অযুত কর্মসূচীর সমন্বয়ের দায়িত্বে রয়েছে ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি’। সরকারীভাবে গঠিত কমিটি সারাদেশের সব উৎসব অনুষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় সাধনের কাজ করছে। বিভিন্ন অঙ্গনের বিশিষ্টজনদের নিয়ে গঠিত কমিটি দিচ্ছে নানা পরামর্শও। আজকের আয়োজন সম্পর্কে জানতে চাইলে কমিটির প্রধান সমন্বয়ক ড. কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের একটি দেশ দিয়েছেন। জাতিরাষ্ট্রের স্থপতি হিসেবে তার তুলনা কেবলই তিনি। আমরা জাতি হিসেবে তাঁর কাছে চির কৃতজ্ঞ। জন্মশতবার্ষিকী সেই কৃতজ্ঞতা জানানোর বড় সুযোগ করে দিয়েছে। মুজিববর্ষে সারাদেশেই নানা উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। আয়োজন থেকে শ্রদ্ধা ভালবাসা জানানো হবে জাতির জনকের প্রতি। একইভাবে তার কীর্তির কথা আগামী প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা হবে। সে লক্ষ্যে আজ তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দরে কয়েকটি নতুন ও অভিনব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মুহূর্তটি ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর ফিরে আসার মধ্য দিয়ে বাঙালীর স্বাধীনতা পূর্ণতা পেয়েছিল। আজকের অনুষ্ঠানে ঐতিহাসিক মুহূর্তটি লেজার শোর মাধ্যমে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করা হবে। একই মঞ্চ থেকে শুরু হবে মুজিববর্ষের ক্ষণগণনা। আজকের অনুষ্ঠানটি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানমালার প্রাক শুরু বলেও মন্তব্য করেন তিনি। জানা যায়, একই স্থান থেকে আগামী ১৭ মার্চ মুজিববর্ষের জাতীয় অনুষ্ঠানমালা উদ্বোধন করা হবে। এ উপলক্ষে রাজধানীর জাতীয় প্যারেড গ্র্যাউন্ডে চোখ ধাঁধানো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। বিকেল ৪টার আয়োজনে উপস্থিত থাকবেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান অনুষ্ঠানে বিশেষ বক্তৃতা করবেন। বছরব্যাপী মুজিববর্ষ উদ্যাপনের উদ্বোধন ঘোষণা করবেন প্রধানমন্ত্রী। অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার হাতে শ্রদ্ধা স্মারক তুলে দেয়া হবে। এসবের বাইরে থাকছে আকর্ষণীয় কিছু আয়োজন। ৫৫ মিনিটের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও লেজার শোর প্রস্তুতি চলছে। সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের উদ্যোগে ফ্লাইপাস্ট অনুষ্ঠিত হবে। শত শিল্পীর পরিবেশনায় থাকবে যন্ত্রসঙ্গীত। বাংলা এবং ইংরেজিতে গাওয়া হবে থিম সং। বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী সংস্থা সংগঠন রাজনীতিবিদ শিল্পী সাহিত্যিক সংস্কৃতিকর্মীদের পক্ষ থেকেও মুজিববর্ষের বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করা হবে। বঙ্গবন্ধু ফিরেছিলেন এই দিনে আজ ১০ জানুয়ারি, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। ৯ মাসের সশস্ত্র ও রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে দেশ স্বাধীন হলেও প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর দেশে ফিরে আসার মধ্য দিয়েই বাঙালীর বিজয়ের পূর্ণতা লাভ করে। জীবন মৃত্যুর কঠিন চ্যালেঞ্জের ভয়ঙ্কর অধ্যায় পার হয়ে সারা জীবনের স্বপ্ন, সাধনা ও নেতৃত্বের ফসল স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে মহান এ নেতার প্রত্যাবর্তন স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয় পূর্ণতা পায়। এ কারণেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এটি একটি অবিস্মরণীয় ও ঐতিহাসিক দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিয়েছিলেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণার পর ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালীর ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। অপারেশন সার্চলাইট নামের এ অভিযানের শুরুতেই পাক হানাদাররা বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর ধানম-ির বাসা থেকে বন্দী করে নিয়ে যায়। গ্রেফতারের আগ মুহূর্তে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। এ ঘোষণার মাধ্যমে সর্বস্তরের জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ লড়াই শুরু করারও ডাক দেন তিনি। গ্রেফতার করে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী করা হলেও তাঁর অনুপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর নামেই পরিচালিত হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। বাঙালী যখন প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তুলেছে, বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানের কারাগারে প্রহসনের বিচারে ফাঁসির আসামি হিসেবে মৃত্যুর প্রহর গুনছিলেন। কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সেলের পাশে তাঁর জন্য কবর পর্যন্ত খোঁড়া হয়েছিল। কিন্তু বাঙালীর স্বাধীনতা, মুক্তির প্রশ্নে ফাঁসির আসামি হয়েও বঙ্গবন্ধু ছিলেন অবিচল, আপোসহীন। এদিকে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তাঁকেই রাষ্ট্রপতি করে গঠিত হয় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার। ‘মুজিবনগর সরকার’ নামে খ্যাত এ সরকারের নেতৃত্বে মরণপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে গোটা বাঙালী জাতি। দীর্ঘ ৯ মাসব্যাপী সশস্ত্র সে যুদ্ধে বহু ত্যাগ আর এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর জাতি বিজয়ের লালসূর্য ছিনিয়ে আনে। স্বাধীনতাকামী জনতা দীর্ঘ নয় মাস মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশকে স্বাধীন করার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতেও বিশ্বব্যাপী জনমত গড়ে তোলে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হলেও বাঙালী জাতির মনে ছিল না স্বস্তি, বিজয়ের আনন্দ। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী জাতির জনকের ভাগ্য কী আছে- এনিয়ে এ ভূখ-ের প্রতিটি মানুষ ছিল বিচলিত, আতঙ্কিত। চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হওয়ার পর বিশ্বনেতারা বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। পরে পরাজিত পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী শেষ পর্যন্ত বন্দিদশা থেকে বঙ্গবন্ধুকে সসম্মানে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। পরাজিত পাকি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো নিজে বঙ্গবন্ধুকে বিমানে তুলে দেন অবনত মস্তকে। জাতির জনক পাকিস্তান থেকে সাড়া পান ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি ভোর রাতে। এদিন বঙ্গবন্ধু ও ড. কামাল হোসেনকে পিআইয়ের একটি বিশেষ বিমানে তুলে দেয়া হয়। সকাল সাড়ে ৬টায় তাঁরা পৌঁছান লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে। বেলা ১০টার পর থেকে তিনি কথা বলেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ, তাজউদ্দীন আহমদ ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ অনেকের সঙ্গে। পরে ব্রিটেনের বিমানবাহিনীর একটি বিমান করে পরের দিন ৯ জানুয়ারি দেশের পথে যাত্রা করেন বঙ্গবন্ধু। লন্ডনে সাংবাদিকদের কাছে দেয়া এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ আমার বিরুদ্ধে বিচারের নামে এক প্রহসন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। শুনানি অর্ধেক সমাপ্ত হওয়ার পর পাক কর্তৃপক্ষ আমার পক্ষ সমর্থনের জন্য একজন আইনজীবী নিয়োগ করে। আমি কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে দেশদ্রোহীর কলঙ্ক নিয়ে মৃত্যুদ-ের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর, আমার বিচারের জন্য যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল তার রায় কখনও প্রকাশ করা হবে না। পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বিচারের নামে প্রহসন অনুষ্ঠান করে আমাকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানোর ফন্দি এঁটেছিলেন।’ বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের জনগণের মতো এত উচ্চমূল্য, এত ভয়াবহ ও বিভীষিকাময় জীবন ও দুর্ভোগ আর কোন মানুষকে ভোগ করতে হয়নি। বাংলাদেশে নির্মম হত্যাকা- ঘটানোর জন্য পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী দায়ী। হিটলার যদি আজ বেঁচে থাকত, বাংলাদেশের হত্যাকা-ে সেও লজ্জা পেত। আমি আর এক মুহূর্ত এখানে থাকতে রাজি নই। আমি আমার জনগণের কাছে ফিরে যেতে চাই।’ লন্ডন থেকে রওনা হয়ে ১০ জানুয়ারি সকালেই বঙ্গবন্ধু নামেন দিল্লিতে। সেখানে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, সমগ্র মন্ত্রিসভা, প্রধান নেতৃবৃন্দ, তিন বাহিনীর প্রধান এবং অন্যান্য অতিথি ও সে দেশের জনগণের কাছ থেকে উষ্ণ সংবর্ধনা লাভ করেন সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের জনক শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু ভারতের নেতৃবৃন্দ এবং জনগণের কাছে তাদের অকৃপণ সাহায্যের জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানান। ১০ জানুয়ারি বিজয়ীর বেশে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে তাঁর প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে ফিরে আসেন বাঙালীর নয়নমণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর লন্ডন-দিল্লী হয়ে তিনি ঢাকায় পৌঁছান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হানাদারমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন বিজয়ের মালা পরে। সেদিন বাংলাদেশে ছিল এক মহাউৎসবের আমেজ। গোটা বাঙালী জাতি রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছিল কখন তাঁদের প্রিয় নেতা, স্বাধীনবাংলার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীন দেশের মাটিতে পা রাখবেন। পুরো দেশের মানুষই যেন জড়ো হয়েছিল ঢাকা বিমানবন্দর এলাকায়। বিমানবন্দর থেকে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পর্যন্ত রাস্তা ছিল লোকেলোকারণ্য। অবশেষে বন্দীর নাগপাশ ছিন্ন করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বিজয়ের বেশে নামলেন বিমান থেকে। পা রাখলেন লাখো শহীদের রক্তস্নাত স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে। গোটা জাতি হর্ষধ্বনি দিয়ে তেজোদীপ্ত ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ সেøাগানে তাঁদের অবিসংবাদিত প্রিয় নেতাকে স্বাগত জানায়। বিকেল পাঁচটায় রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১০ লাখ লোকের উপস্থিতিতে ভাষণ দেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু। পরের দিন বিভিন্ন পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিয়ে এভাবেই লেখা হয়- ‘স্বদেশের মাটি ছুঁয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসের নির্মাতা শিশুর মতো আবেগে আকুল হলেন। আনন্দ-বেদনার অশ্রুধারা নামলো তাঁর দু’চোখ বেয়ে। প্রিয় নেতাকে ফিরে পেয়ে সেদিন সাড়ে সাত কোটি বাঙালী আনন্দাশ্রুতে সিক্ত হয়ে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু ধ্বনিতে প্রকম্পিত করে তোলে বাংলার আকাশ বাতাস।’ জনগণ-মন-নন্দিত শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দাঁড়িয়ে তাঁর ঐতিহাসিক ধ্রুপদী বক্তৃতায় বলেন- ‘যে মাটিকে আমি এত ভালবাসি, যে মানুষকে আমি এত ভালবাসি, আমি জানতাম না সে বাংলায় আমি যেতে পারবো কি-না। আজ আমি বাংলায় ফিরে এসেছি বাংলার ভাইয়েদের কাছে, মায়েদের কাছে, বোনদের কাছে। বাংলা আমার স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।’ সশ্রদ্ধচিত্তে তিনি সবার ত্যাগের কথা স্মরণ করেন এবং সবাইকে দেশ গড়ার কাজে উদ্বুদ্ধ করে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেন, ‘রক্ত দিয়ে হলেও আমি বাঙালী জাতির এই ভালবাসার ঋণ শোধ করে যাব’। কথা রেখেছেন জাতির পিতা। হিংস্র পাকহানাদাররাও যাঁর গায়ে আঁচড় দেওয়ারও সাহস দেখাতে পারেনি, স্বাধীন দেশে বাঙালী নামক একশ্রেণীর কুলাঙ্গার-বিশ্বাসঘাতকদের হাতেই তাঁকে জীবন দিতে হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিজের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর কথা রেখে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। যথাযোগ্য মর্যাদায় স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস পালনে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন সংগঠন নিয়েছে বিস্তারিত কর্মসূচী। আওয়ামী লীগের কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে- ভোরে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, বঙ্গবন্ধু ভবনসহ সারাদেশে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল সাতটায় বঙ্গবন্ধু ভবনে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন এবং বিকেল তিনটায় জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে ক্ষণগণনা কার্যক্রমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগদান। ক্ষণগণনা কার্যক্রম উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এক বিবৃতিতে ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে আয়োজিত ক্ষণগণনার কার্যক্রম উদ্বোধনী অনুষ্ঠানসহ সব কর্মসূচী যথাযথভাবে পালনের জন্য দল ও সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
×