ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ স্বাধীনতা জন্মগত অধিকার

প্রকাশিত: ০৯:০৫, ১০ জানুয়ারি ২০২০

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ স্বাধীনতা জন্মগত অধিকার

স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। মানুষকে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু সৃষ্টি করেছেন তাঁর খলিফা বা প্রতিনিধি করে। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্- আল্লাহ্ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এটা যেমন সত্য, তেমনি সত্য লা মালিকা ইল্লাল্লাহ্- আল্লাহ্ ছাড়া কোন মালিক নেই। তিনি রব্বুল আলামীন-বিশ্ব জগতের রব। রব শব্দের অর্থ এক কথায় বলা যায় না। এই কারণে রব শব্দের অর্থ করা হয় স্রষ্টা, সংরক্ষক, বিবর্ধক, প্রতিপালক, নিয়ন্ত্রণকারী, বিধানদাতা, রিয্কদাতা, তত্ত্বাবধায়ক, সর্বশক্তিমান। সার্বভৌমত্ব একমাত্র তাঁরই। তিনি অদ্বিতীয়। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহুর সেরা সৃষ্টি হচ্ছে মানুষ। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : ওয়া লাকাদ কাররামনা বনী আদাম- আমি তো আদম সন্তানদের (মানুষকে) মর্যাদা দান করেছি। (সূরা বনী ইসরাইল : আয়াত ৭০)। আরও ইরশাদ হয়েছে : ওয়া লিল্লাহি মুলকুস্ সামাওয়াতি ওয়াল আরদ, ওয়াল্লাহু ‘আলা কুল্লি­শায়য়িন কাদীর- আকাশ ম-লী ও পৃথিবীর সার্বভৌম ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ্রই। আর আল্লাহ্ সব কিছুর ওপর সর্বশক্তিমান। (সূরা আল-ইমরান : আয়াত ১৮৯)। ওয়া লিল্লাহি মাফিস্ সামাওয়াতি ওয়ামা ফিল্ আরদ- আসমানসমূহে যা কিছু আছে এবং জমিনে যা কিছু আছে সব আল্লাহ্রই। (সূরা নিসা : আয়াত ১৩১)। সেই মহান সৃষ্টিকর্তা খালিক মালিক আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষকে দান করেছেন জ্ঞান-বুদ্ধি, বিবেক-বিবেচনা, দান করেছেন অন্যান্য সৃষ্টির ওপর কর্তৃত্ব। তিনি মানুষকে চিন্তার স্বাধীনতা, কথা বলার স্বাধীনতা, উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহের স্বাধীনতা, পছন্দমতো ঘর-সংসার গড়ার স্বাধীনতা, সুন্দর জীবন গড়ার স্বাধীনতা, প্রকৃতি থেকে সুস্থ ও সৎ পন্থায় সম্পদ আহরণের স্বাধীনতা, জীবনের স্তরে স্তরে ক্রমবর্ধমান সমস্যা সমাধানের স্বাধীনতা, শত্রুতা নিরসন করে বন্ধুত্ব স্থাপনের স্বাধীনতা দিয়েছেন। মানুষের এই স্বাধীনতার নানামাত্রিক দিকের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ইসলাম স্বাধীনতা বলতে বুঝিয়েছে এটা কোন যথেচ্ছ জীবনযাপন করার নাম নয়। মানুষ অবাধে, নির্বিঘেœ এবং সুখ-শান্তিতে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, ভৌগোলিক নিজস্ব সীমানার মধ্যে, আপন মজবুত গণ্ডির মধ্যে সম্মিলিত প্রয়াসে পারস্পরিক সমঝোতা ও সহযোগিতার মধ্য দিয়ে হায়াতুন্ দুনিয়া বা পার্থিব জীবন গড়ে তুলবে খালিক মালিক রব্বুল ‘আলামীনের দেয়া বিধান অনুযায়ী নিয়মতান্ত্রিক পন্থায়। যে কারণে ইসলাম স্বেচ্ছাচারিতা এবং স্বৈর মানসিকতা সমর্থন করে না। মানুষের ইচ্ছাশক্তি আল্লাহ্রই দান। মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করতে যে ভাষাতেই কথা বলুক না কেন, যে শব্দ উচ্চারণের মাধ্যমেই মনের ভাব বোধগম্য করে প্রকাশ করুক না কেন, সে কথা বলার শক্তি, সে শব্দমালা তৈরির ক্ষমতা আল্লাহ্রই দান। পৃথিবীতে বিভিন্ন জাতি বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। একই অর্থসহ কথা ভিন্ন ভিন্ন শব্দ বা বাক্যে প্রকাশ করার এই যে বিস্ময়কর উপস্থিতি বিশ্বজুড়ে তা আল্লাহরই দান। কুরআন মজিদে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে : খালাকাল ইন্সানা ‘আল্লামাহুল বাইয়ান- তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনিই তাকে শিক্ষা দিয়েছেন মনের ভাব প্রকাশ করতে। (সূরা আর রহমান : আয়াত ৩-৪)। মানুষকে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু যে স্বাধীনতা নামক নিয়ামত দান করেছেন তাকে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পরিচর্যা করার বিধানও তিনিই দিয়েছেন। মানুষকে পানাহার করার স্বাধীনতা দিয়েছেন তার মানে এটা নয় যে, মানুষ যা ইচ্ছা তাই করবে, জীবিকা নির্বাহের জন্য, ধন-সম্পদ সঞ্চয়ের জন্য জুলুম নির্যাতনের পথ গ্রহণ করবে, ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য পেশীশক্তির অপব্যবহার করবে, ন্যায়-অন্যায় বিচার করবে না, হালাল-হারামের পার্থক্য নির্ণয় করবে না। ইসলামে স্বাধীনতা হচ্ছে সৎ চিন্তার বিকাশ ঘটানো, সৎকর্মের পথ করে দেয়া, সুন্দর পবিত্র জীবনযাপন ও মানবতার প্রসার ঘটানো, শান্তির দুনিয়া গড়ে তোলা। কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : তোমরা সকলে আল্লাহ্র রজ্জু সম্মিলিতভাবে মজবুত করে আঁকড়ে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর। স্মরণ কর তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু এবং তিনি তোমাদের হৃদয়ে সম্প্রীতি সঞ্চারিত করলেন, ফলে তাঁর অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেলে। তোমরা তো আগুনের কূপের প্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিলে, আল্লাহ্ তা থেকে তোমাদের রক্ষা করলেন। এইভাবে আল্লাহ্ তোমাদের তাঁর নিদর্শনসমূহ স্পষ্টভাবে বিবৃত করেন, যাতে তোমরা সৎপথ পেতে পার। (সূরা আল ইমরান, আয়াত ১০৩)। এই আয়াত নাজিলের প্রেক্ষাপট আইয়ামে জাহিলিয়াতের সেই শিরক, কুফর, কুসংস্কার আর অন্ধ বিশ্বাস জর্জরিতকাল হলেও, সেই সরদারশাসিত শতধাবিভক্ত কাল হলেও এর মধ্যে সেই অন্ধকার কাল থেকে আল্লাহ্র মেহেরবানীতে মুক্তি পাবার কথা বলা হয়েছে। আর এই স্বাধীনতার আলোকচ্ছটার যে ইশারা এতে বিধৃত হয়েছে তা সর্বকালের জন্য প্রযোজ্য। এখানে যে আগুনের কুয়োর কথা বলা হয়েছে, যে অগ্নিকু-ের উল্লেখ করা হয়েছে তার দ্বারা মানুষের প্রকাশ্য দুশমন শয়তান প্ররোচিত সমাজকে বোঝানো হয়েছে, পরাধীনতার ভয়াবহ চেহারা অগ্নিকু- এই উচ্চারণের মাধ্যমে প্রকটভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। (চলবে ) লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ
×