ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ধর্ষকের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দাবিতে উত্তাল ঢাবি ক্যাম্পাস

প্রকাশিত: ১১:০৯, ৯ জানুয়ারি ২০২০

ধর্ষকের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দাবিতে উত্তাল ঢাবি ক্যাম্পাস

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ধর্ষকের শাস্তি মৃত্যুদ- করার দাবিতে এবার রাজপথে নেমেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে ধর্ষকের শাস্তি দাবিতে বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত মানববন্ধন থেকে ফাঁসির দাবি তুলেছেন শিক্ষকরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি আয়োজিত এ কর্মসূচী ছাড়াও টানা তৃতীয় দিনের মতো প্রতিবাদ বিক্ষোভ সমাবেশসহ নানা কর্মসূচী পালন করেছেন শিক্ষার্থীরা। প্রতিটি কর্মসূচীতেই ধর্ষকের শাস্তি মৃত্যুদ- করার দাবি উঠেছে। বুধবার সকাল ১১টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে মানববন্ধন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামালের সভাপতিত্বে কর্মসূচীতে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ আখতারুজ্জামান। শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মোঃ নিজামুল হক ভূঁইয়ার সঞ্চালনায় মানববন্ধনে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট এ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মাহবুবা নাসরিন, উইমেন এ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজের চেয়ারপার্সন ড. সানজিদা আক্তার, ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক হুমায়ুন কবির, সাবেক প্রক্টর ড. আমজাদ আলী, রোকেয়া হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা, শিক্ষক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক জেড এম পারভেজ সাজ্জাদ, গণিত বিভাগের অধ্যাপক ড. চন্দ্রনাথ পোদ্দার, ইতিহাস বিভাগের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক শরিফুল্লাহ ভূইয়া, কুয়েতমৈত্রী হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক মাহবুবা নাসরিন, সহকারী প্রক্টর আব্দুর রহিম প্রমুখ। উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ আখতারুজ্জামান বলেন, তিনিও ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-ের পক্ষে। আমাদের মেয়েটি যে পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে, এর নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের নেই। এই ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার সংক্ষুব্ধ। বিভিন্ন উপায় ও ভাষায় আন্দোলন চলছে। সবার একই উদ্দেশ্য বিচারের মাধ্যমে দ্রুততম সময়ের মধ্যে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। সমাজে যেন পাশবিকতা সংঘটিত না হয়, তার জন্য সমাজ-সচেতনতা সৃষ্টি করা একটি বড় কাজ। সেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে সূচিত হলো। এমন পাশবিক নির্যাতনের ঘটনায় সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রাখা মনে হয় খুবই জরুরী হয়ে পড়েছে। কারণ, কঠিন অবস্থানে না গেলে সমাজে এসব পাশবিক ঘটনা আরও ঘটার সম্ভাবনা থেকে যাবে। একজন ধর্ষক আর একজন রাজাকারের মধ্যে কোন তফাৎ নেই বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল। মানবতাবিরোধী অপরাধের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদ-। তাই ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন নয়, মৃত্যুদ- হওয়া উচিত। এর জন্য বিদ্যমান আইনের সংস্কার প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, আমাদের সন্তানতুল্য ছাত্রীকে ধর্ষণের প্রতিবাদ ও অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি এই মানববন্ধনের আয়োজন করেছে। যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সংস্কারের কাজ করে, সেই প্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষার্থী যখন এয়ারপোর্টের কাছাকাছি একটি জায়গায় ধর্ষণের শিকার হয়; তখন সমগ্র জাতির সামনে একটি প্রশ্ন এসে দাঁড়ায়ে যায় দেশ কি ধর্ষকদের জন্য নিরাপদ হয়ে গেছে? আদালতের দীর্ঘসূত্রতার কারণে বিচার বিলম্বিত হয়। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাধ্যমে যখন আমরা একটি মানবিক সমাজ গঠন করতে চাইছি। সেখানে নারীরা যদি নিরাপদ না হন, সেই লক্ষ্য কি আমরা অর্জন করতে পারব? বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী যখন ধর্ষণের শিকার হন, তখন আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের অপমানিত হতে হয়। দেশের সর্বোচ্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীও নিরাপদ নয়। আমরা চাই এমন একটা সামাজিক বিপ্লব, যেখানে সব শ্রেণী-পেশার মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি নিরাপদ সমাজ গড়ে তুলবেন। আইনের প্রসঙ্গ টেনে এই শিক্ষক নেতা বলেন, ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংস্কারের প্রয়োজন আছে। আইনটিতে বলা আছে ধর্ষণের পর যদি হত্যা করা হয়, সে ক্ষেত্রে ধর্ষককে আইনে থাকা সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া যেতে পারে। ধর্ষক যদি স্বীকার করে যে সে ধর্ষণ করেছে, সে ক্ষেত্রে তার শাস্তি হবে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদ-। ধর্ষণের চেষ্টা করলে অনধিক ১০ বছর ও অন্যূন পাঁচ বছর সশ্রম কারাদ-ের বিধান আছে। ১০ বছরের সাজা পরে কমে কমে গিয়ে দাঁড়ায় পাঁচ বছরে। এই হলো আইনে ধর্ষকের শাস্তি। এই আইন সংস্কারের প্রয়োজন। মুজিববর্ষে আমাদের শপথ হোক দেশ হবে ধর্ষকমুক্ত। দেশকে ধর্ষকমুক্ত করার জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাব এবং সরকারকে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেয়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে গোলটেবিল বৈঠক করে আইন সংস্কারের সুপারিশ করব। অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০ বছর ধরে শিক্ষকতা করছি। ছাত্রজীবন মেলালে প্রায় ৪০ বছর হয়ে গেছে। এই ৪০ বছরে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনও এ ধরনের ঘটনা ঘটতে দেখিনি। সে জন্য আমরা অত্যন্ত মর্মাহত এবং সেই ছাত্রীর পরিবারের প্রতি আমরা গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। ঘটনাটি জানার পর প্রশাসনিক পর্যায় থেকে যতটুকু করা সম্ভব, তার চেয়ে বেশি আমরা করার চেষ্টা করছি। ছাত্রীটি মানসিক ও স্বাস্থ্যগতভাবে এখন কিছুটা উন্নতি লাভ করেছে। কিন্তু সে এখন এমন পরিস্থিতিতে আসেনি যে তাকে মিনিটে মিনিটে জেরা করা হচ্ছে, একই কথা তার মুখ দিয়ে বলানো হচ্ছে। পর্যাপ্ত ঘুমের সময়ও সে পাচ্ছে না। মেয়েটি অত্যন্ত ছোট। কিন্তু মেয়েটির যে মনোবল, তা আমাদের অনেক শিক্ষককে অভিভূত করেছে। সে বন্ধুদের সঙ্গে হলে বসে পরীক্ষা দিতে চায়। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি। নারী, পুরুষ, অভিভাবকসহ সকলের জন্য কাউন্সিলিং প্রয়োজন। এদিকে প্রতিবাদ বিক্ষোভ সমাবেশসহ নানা কর্মসূচী পালন করেছেন শিক্ষার্থীরা। বিভিন্ন ছাত্র ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দও বলেছেন, অপরাধীকে কেবল গ্রেফতার নয়। সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে। একই সঙ্গে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- দিতে হবে। ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-ের দাবিতে সামাজিক আন্দোলন চলবেও বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। বুধবার সকাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সেশন, ব্যাচ ও বিভাগের শিক্ষার্থীরা আলাদা আলাদা প্রতিবাদ কর্মসূচী পালন করেছেন। ধর্ষক গ্রেফতারের প্রতিক্রিয়ায় ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস বলেন, আমাদের স্বস্তি এখনও ফেরেনি। শুধু ধর্ষক গ্রেফতার হলেই চলবে না। তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। বাংলাদেশে এ ধরনের বিকৃত মন-মানসিকতা পোষণকারী যারা রয়েছে, এ শাস্তি দেখে তারা যেন ভয়ে ভীত থাকে এবং এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে ভয় পায়। রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ধর্ষণের প্রতিবাদে আয়োজিত মানববন্ধনে রোকেয়া হলের ছাত্রী সানজিদা বলেন, আমরা নারীরা আজ কোথায়ও নিরাপদ নই। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থী হয়েও ধর্ষণের শিকার হতে হয়। বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান নারীর জন্য অনিরাপদ। আমরা একটি সামাজিক বিপ্লব চাই। যেই সমাজে ধর্ষকের ঠাঁই হবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ওমর ফারুক বলেন, ধর্ষক গ্রেফতার হওয়ায় আমি আনন্দিত নই। হালকা একটুখানি স্বস্তি কাজ করছে। কিন্তু পুলকিত হওয়ার মতো কিছু ঘটেনি। চাপে পড়লে দুইদিনে গ্রেফতার, কয়েক মাসে বিচার হয়। ঢাবির ওই ছাত্রীই শুধু আমার বোন নয়। এই দেশের প্রতিটা নারীর সঙ্গে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের বিচার চাই আমি। ধর্ষক গ্রেফতার হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-ডাকসুর সদস্য তিলোত্তমা সিকদার বলছিলেন, আমরা জেনেছি ধর্ষককে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমরা এই ঘটনার এমন দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই, যাতে আর কোন বোনকে ধর্ষণের শিকার হতে না হয়। এই ধর্ষণই যাতে শেষ ধর্ষণের ঘটনা হয়। মুজিববর্ষে আমাদের শপথ হোক দেশ হবে ধর্ষকমুক্ত। টানা ৪৮ ঘণ্টা অনশনকারী সিফাতুল ইসলাম বলেন, আমরা মনে করি ধর্ষকের গ্রেফতারের মাধ্যমে আমাদের চার দফা দাবির প্রথম দুটি পূরণ হয়েছে। আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানাই। একটি সামাজিক পরিবর্তনের জন্য আমরা বাকি দুই দফা দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাব।
×