ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিনা পাসপোর্টে যাতায়াত সুবিধা-সীমান্ত গ্রামে আনন্দের বন্যা

প্রকাশিত: ১১:০৮, ৯ জানুয়ারি ২০২০

বিনা পাসপোর্টে যাতায়াত সুবিধা-সীমান্ত গ্রামে আনন্দের বন্যা

জাহাঙ্গীর আলম শাহীন ॥ সূর্য ডুবলেই দেশের বাইরে থেকে যান লালমনিরহাট জেলা সদরের মোগলহাট সীমান্তের পাশে ১০ মিনিটের দূরত্বে থাকা ভারতের নগদটারী গ্রামের পাঁচ শতাধিক জনবসতির সকলে। সন্ধ্যা নামলেই বন্ধ হয়ে যায় কাঁটাতারের বেড়ার ফটক। আর তাতেই দেশ থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন ভারতের কুচবিহার জেলার দিনহাটার ধরলা নদীর পাড়ের গ্রাম নগদটারী মানুষ। বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতের কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে এই জনবসতিপূর্ণ গ্রামটি। গ্রামটি তাই প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে সীমান্তের বেড়ার গেট বন্ধ হলেই কার্যত নিজ ভূমিতে পরবাসী হয়ে যান নগদটারী গ্রামের মানুষেরা। রাতে জরুরী প্রয়োজনে নিজ দেশে যেতে পারে না। অনেক সময় চুপিসারে জরুরী প্রয়োজনে বাংলাদেশের দুর্গাপুর ও মোগলহাটে ঢুকে পড়তে হয়। অত্যন্ত মানবিক কারণে বাংলাদেশের সীমান্ত গ্রামের অধিবাসীরা জানলেও বিজিবিকে বা কোন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে খবর দেয় না। ভারতীয়রা তাদের প্রয়োজন সেরে নিজ গ্রামে চলে যায়। নগদটারী গ্রামটি ধরলা নদীর দুর্গম চরে। এই গ্রামের মানুষ তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যসহ নানা সামগ্রী বাংলাদেশের দুর্গাপুর ও মোগলহাট বাজার হতে সংগ্রহ করে। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) গ্রামটি হতে বেশ দূরে থাকে। তবে দিনের বেলায় তারা কয়েকবার টহলে আসে। গ্রামের মানুষের খোঁজখবর নিয়ে যায়। এখন গ্রামের মানুষকে তারা জানিয়ে দিয়ে গেছে নতুন কেউ বা আত্মীয়স্বজন তাদের বাড়িতে এলে তাদের খবর তাৎক্ষণিকভাবে স্থানীয় বিএসএফ ক্যাম্পে দিতে হবে। এই গ্রামের মানুষ মূলত কোন দেশেরই নাগরিক সেবা ঠিকমতো পায় না। দুর্গম ধরলা নদীর চর নাগরিক সেবা পেতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। বিনা পাসপোর্টে সীমান্ত গ্রামের মানুষ দুই দেশে যেতে পারবে এমন ঘোষণার কথা শুনে আনন্দের বন্যা বইছে গ্রামগুলোতে। তারা বলছে, দুই দেশের সীমান্ত গ্রামের মানুষদের মধ্য এই আইন সেতু বন্ধন সৃষ্টি করবে। ভারতের নতুন নাগরিকত্ব আইনের কথা শুনে দেশ হারানোর আতঙ্ক কয়েকগুণ বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে বেড়ার ওপারের ওই সংখ্যালঘু মুসলিম বাসিন্দাদের। চিন্তায় পড়েছে নগদটারী গ্রামের পাঁচ শতাধিক দরিদ্র পরিবার। নগদটারী গ্রামের ইসরাইলের সঙ্গে কথা হয় মোগলহাট বাজারে, তিনি জানান, স্বাধীন ভারতের মাটিতে থাকি। কিন্তু প্রতি দিন সন্ধ্যার পর থেকে সকাল পর্যন্ত আমরা পরাধীন ও অবরুদ্ধ থাকি। যেন ঘড়ির কাঁটায় বাঁধা আমাদের স্বাধীনতা। পানীয় জল, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সবই থেকে বঞ্চিত। এখন বাড়তি নতুন করে চিন্তা বাড়িয়েছে ভারতীয় নাগরিক আইন। তারা মুক্তি চায় এমন বন্দী জীবন থেকে। যেতে চায় কাঁটাতারের বেড়ার ভেতরে। সীমান্তের নোমান্সল্যান্ডের ৯২৭ নম্বর পেইন পিলারের ৪এস পিলারটি থেকে ১০ মিনিটের দূরত্বে গ্রামটি। পিলারটি এখন নেই। ধরলা নদী গর্ভে বিলিন হয়েছে। ধরলা নদীর চরে গ্রামটি হওয়ায় ভারতীয় গ্রামটির নাম দিয়েছে নগদটারী। এ ধরনের গ্রাম বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ি উপজেলার বালারহাট সীমান্তে রয়েছে। গ্রামগুলো ভারতীয় ঘেরা কাঁটাতারের বাহিরে পড়েছে। টিনশেড ছোট ছোট গ্রামের ঘরগুলো। তবে গ্রামের বসতির মধ্যেই তিনতলা উঁচু বিএসএফর ফ্লাডলাইট রয়েছে। সেই কাঠামোর ওপরে উঠলে দেখা যায়, দুই বাংলার সীমান্ত ছুঁয়ে যাওয়া ধরলা নদী, বাংলাদেশের চর। বাংলাদেশের সীমান্তের গ্রাম। শুধু ভারতীরা নগদটারী হতে দুর্গাপুর ও মোগলহাট আসে তা কিন্তু নয়। দুর্গাপুর ও মোগলহাট সীমান্তের মানুষজনও ভারতের নগদটারী গ্রামে তাদের আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে যান। গ্রামবাসী শহীদুল ইসলাম জানান, তাদের ১২ মাস ভোটার কার্ড বুকে আগলে রেখে ঘুরতে হয়। তবেই কাঁটাতারের কয়েকটি গেট দিয়ে মূল ভূখ-ে যাতায়াত করা যায়। তবে কাজ সেরে সন্ধ্যার আগে ফিরতে হয়। সন্ধ্যার পরে ফিরলে কাঁটাতারের বেড়া পার হওয়া যায় না। তবে কোন প্রয়োজনে এ বাড়ি ও বাড়ি যাতায়াত করলে সন্ধ্যার পর সীমান্তঘেরা গ্রামের মানুষকে হারিকেনের আলো নিয়ে বিএসএফ ঘুরতে বলেছে। গ্রামের বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম বলেন, ভারতের নতুন নাগরিকত্ব আইনের কথা যত শুনছি, এই আইনের কথা যত শুনেছি ততই ভয় বাড়ছে। শুধু এই ভোটার কার্ডই তো আমাদের নাগরিকত্বের প্রমাণ। পুরনো নথি কোথায়, কিভাবে পাব? আমরা নদীভাঙ্গা মানুষ। ধরলা নদীর তীরে আমাদের বসবাস। কয়েক বার বাড়ি পরিবর্তন করতে হয়েছে। তাতে জমি-জমার কাগজ হারিয়ে গেছে। অনেকের জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। তাদের কোন জমি নেই। তারা কোথায় পাবে জমির নথিপত্র। লালমনিরহাট জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, লালমনিরহাট জেলায় বাংলাদেশ ভারতীয় সীমান্ত রয়েছে প্রায় ২৮৫ কিলোমিটারজুড়ে। এই সীমান্তের প্রায় ৮০ কিলোমিটারে কোন কাঁটাতারের বেড়া নেই। নদ-নদী ঘেরা এই সীমান্ত। তাই কাঁটাতারের বেড়ার বাহিরে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত রয়েছে কয়েকটি ভারতীয় গ্রাম। আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার সময় ওপারে থেকে যায় ভারতের বেশ কিছু গ্রাম। সীমান্তের কোথাও কৃষিজমি, চা বাগানও রয়েছে। তবে কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার সময় ভারত সরকার কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাদের কাঁটাতারের এপারে নিয়ে গিয়ে ছিল। ওই সময় জেলা সদরের মোগলহাট সীমান্তের পাশে ধরলা নদীর তীরে থাকা নগদটারী গ্রামটি বেড়ার ওপারে থেকে গিয়েছে। গ্রামের আরও এক বাসিন্দা মহম্মদ সলিমউদ্দিন বলেন, ‘বেড়ার ওপারে আমাদের জমি নেই। প্রশাসনের তরফে আশ্বাস দেয়া হচ্ছে ঘর দেয়া হবে। কিন্ত জমি কে দেবে? গ্রামে আরও অনেকে ছিলেন। যাদের জমি ওপারে ছিল, তারা চলে গিয়েছেন। আমার মতো অসহায় কয়েকজন থেকে গিয়েছি। নগদটারী গ্রামের মানুষ এত অসহায় যে, রাত হলে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের খোঁজ নেয় না। ২০১৮ সালের বর্ষা মৌসুমে ধরলা নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়। তখন ভারতের নগদটারী গ্রামের ৪শ’ পরিবার বাংলাদেশের এসে মোগলহাটের উঁচু রাস্তায় আশ্রয় নেয়। বাংলাদেশীরা তাদের প্রায় সাতদিন খাবারসহ নানা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়ে সাহায্য করেছে। বিজিবিও সাহায্য করেছে। এ বছর বন্যায় ভারতীয় ছয়জন বিএসএফ সদস্য স্পিডবোট নিয়ে সীমান্তের ধরলা নদীতে টহল দিতে এসে পানির তোড়ে ভেসে বাংলাদেশের ভেতরে চরে আটকাপড়ে। সারারাত ধরে বিজিবি তাদের উদ্ধারে চেষ্টা চালায়। পরে ভোরে তাদের উদ্ধার করে ভারতে ফিরে যেতে সহায়তা করে। এদিকে কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ি উপজেলার নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের ৯৩১ মেন পিলারেরর ২এস সাব-পিলারের পাশে ভারতীয় কাঁটাতারের বাইরে রয়েছে প্রায় ২০টির মতো পরিবার। তারা সন্ধ্যার পরে কাঁটাতারের বেড়ার গেট বন্ধ হলে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। এসব ভারতীয় গ্রামবাসী দিন ও রাতে বাংলাদেশের বালারহাটে তাদের উৎপাদিত কৃষি পণ্য বিক্রি করে। এছাড়াও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস বালারহাট বাজার হতে সংগ্রহ করে। বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। নামপ্রকাশ না করার শর্তে তৃণমূল জেলা পরিষদ সদস্য মোবাইল ফোনে জানান, ওই গ্রামের সমস্যার কথা জেলা প্রশাসনকে জানানো হয়েছে। তবে সন্ধ্যার পরে কোন সমস্যা হলে বিএসএফকে জানালে কাঁটাতারের বেড়ার গেট খুলে দেয়া হয় বলে জানান। গ্রামবাসীরা জানান, বিএসএফের, নিরাপত্তার স্বার্থে কিছু কড়াকড়ি করে। তবে গ্রামবাসীদের হয়রানি করে না। বিপদে বিএসএফ ওই গ্রামের মানুষের পাশে থাকে। গ্রামবাসীরা জানান, শুনেছি জেলা প্রশাসন, সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে থাকা ‘গ্রামকে কাঁটাতারের বেড়ার এপারে নিয়ে আসতে উদ্যোগ নেয়া হবে।’ সেই সময় যদি গ্রামটি ভারতের মূল ভূখ-ের ভেতর চলে যায়। সেটা ভাল হবে। এদিকে বিজিবির মহাপরিচালক বিনা পাসপোর্টে ভারতে যাওয়া যাবে। এ লক্ষ্যে কাজ করছেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এতে ভারতীয় সীমান্ত গ্রামে আনন্দের বন্যা বইছে। তারা জানান, শুধু বাংলাদেশীরা আসবে তা নয়। আমরাও বাংলাদেশে আত্মীয়-স্বজনকে দেখতে যাব। তখন বৈধতা থাকবে। এখন যাই অবৈধভাবে। মোগলহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ হাবিবুর রহমান জানান, সীমান্ত গ্রামের মানুষের আত্মীয়-স্বজন দুই দেশের সীমান্তের গ্রামগুলোতে থাকে। তারা সুযোগ পেলে অবৈধ পথে আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে বেড়াতে আসে। ২০১৮ সালের বন্যায় ভারতীয় নগদটারীর প্রায় ৪শ’ পরিবার মোগলহাটের উঁচু রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছিল। তখন তাদের আমরা নিরাপত্তা, খাদ্যসহ সকল ধরনের সহায়তা দিয়েছি। তিনি জানান, সত্যই কাঁটাতারের বেড়ার বাহিরে থাকা ভারতীয় গ্রামগুলো বাংলাদেশের হাটবাজারের ওপর নির্ভরশীল।
×