ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পাট ও চিনি শিল্পকে রক্ষা করতে হবে

প্রকাশিত: ০৯:২২, ৯ জানুয়ারি ২০২০

পাট ও চিনি শিল্পকে রক্ষা করতে হবে

আমাদের সোনালি আঁশ পাটের অর্থে পশ্চিম পাকিস্তান তার আধুনিক অবকাঠামো গড়ে তুলেছে এবং সম্পদশালী হয়েছেÑ এটি ছিল ষাট ও সত্তুরের দশকের পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক ইস্যু এবং পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনের বীজস্বরূপ। সে অবস্থা থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ অনেক দূর পথ হেঁটেছে। বঙ্গবন্ধু সমাজতান্ত্রিক ধাঁচে পাট, চিনি, সুতা, বস্ত্র এসব কারখানা রাষ্ট্রের অধীনে নিয়ে আসেন। কিন্তু লোভী এবং দেশপ্রেমহীন, অদক্ষ বাঙালী প্রশাসক-কর্মকর্তা-কর্মচারী এসব কারখানাকে প্রথমে লোকসানি সংস্থায় পরিণত করে এবং পরে এসব ভারি শিল্প-কারখানার মূল্যবান যন্ত্র, যন্ত্রাংশ স্বল্পমূল্যে বিক্রি করে দিয়ে দেশকে প্রায় শিল্পহীন করে পলাতক হয়! আমার জানা নেই গবেষণার প্রতি আগ্রহহীন বাঙালী কখনও এদের তালিকা, পরিচয় অনুসন্ধান করেছে কিনা! অথবা ভবিষ্যতে অনুসন্ধান করে দেখবে কিনা কারা কিভাবে চালু কারখানাগুলোকে লোকসানি করে দেশের উন্নয়নের শুরুতেই সব ভারি শিল্পকে ধ্বংস করেছিল। এ কথাও তো ভুলতে পারি না যে, বঙ্গবন্ধু ভাঙ্গা পথ, ঘাট, সেতু পুনর্নিমাণ করছেন, কোটি শরণার্থীকে পুনর্বাসন করছেন, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও পেশাজীবীদের জন্য কর্মসংস্থান, আর্থিক সহায়তা, বাসস্থানের ব্যবস্থা করছেন, পাকিস্তানে আটক বাঙালীদের ফেরত আনাসহ নানা ব্যবস্থা করছেন, সংবিধান প্রণয়ন করছেন। অপরদিকে দেশের শত্রুÑ রাজনৈতিক, আমলা, সামরিক, বেসামরিক, ব্যবসায়ী ব্যক্তিরা সারাদেশে হত্যা, কলকারখানায়, গুদামে অগ্নিসংযোগ, লুট-ডাকাতিসহ নানারকম নাশকতামূলক কর্মকা- করে চলেছে! তার মধ্যে যখন সব পেশার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টায় বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন ও প্রশাসনকে জনমানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেবার পদক্ষেপ গ্রহণ করে জেলা গবর্নর চালু করতে যাচ্ছিলেন, তখনই দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের ফলে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এবং ৩ নবেম্বর ১৯৭৫-এর হত্যাকা- সংঘটিত হয়! হায়, বঙ্গবন্ধুর ’৭৪ সালে সূচিত সবুজ বিপ্লবের সোনালি ফসল ঘরে তুলল জিয়া! এরপর পাট ক্রমাগত দেশী-বিদেশী চক্রান্তের মুখে পড়ে অর্থকরী সোনালি আঁশ থেকে লোকসানি পণ্যে নামাঙ্কিত হয়! কিন্তু কেন? পাটের সর্বোচ্চ উন্নত প্রজাতি আমাদের কৃষি গবেষকেরা আবিষ্কার করে পাটকে আন্তর্জাতিক মর্যাদার আসনে বসানোর আরেকটি সুযোগ করে দিয়েছেন। তাছাড়া পাটের জিনোম আবিষ্কার করেছেন আমাদেরই কৃষি বিজ্ঞানী। যার ফলে পাটের উন্নত প্রজাতি তৈরি, রোগ-বালাইমুক্ত প্রজাতি আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে। উপরন্তু, বর্তমান বিশ্ব যখন প্লাষ্টিকের ভয়াবহ দূষণ থেকে রক্ষা পেতে প্রাকৃতিক পচনশীল পাটের পণ্য, ব্যাগ ব্যবহারে আগ্রহী হয়েছে, সেখানে পাট এখন একটি কাক্সিক্ষত কৃষিপণ্য হয়ে ওঠার কথা- তা বলাই বাহুল্য। পাট থেকে যে পাতলা সুতার ব্যাগ তৈরি হচ্ছে, পাটের নানা পণ্য তৈরি হচ্ছে, পাটের আঁশ থেকে যে সিল্ক সুতা ও বস্ত্র তৈরি সম্ভব, গাড়ির ভেতরের বডিতে পাটজাত উপকরণ প্রস্তুত হচ্ছে, এসবের সম্ভাবনা কি তাহলে সঠিকভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে না? সবার মনে প্রশ্ন, কেন বারবার পাটকলের শ্রমিকরা রাস্তায় নামে? কেন তাদের লোকসানি কর্মস্থলে কাজ করতে হয়? রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা কি কার্যকর পরিকল্পনা দ্বারা লাভজনক হতে পারে না? আমলা বা প্রশাসকদের মধ্য থেকে দেশপ্রেমিক এবং চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার মতো কিছু ব্যক্তি কি নেই, যারা পাটের দুর্ভাগ্য বদলে দিয়ে সৌভাগ্য আনতে পারে? অথবা অন্য কোন ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, শিক্ষক শ্রেণী থেকেও কয়েকজন পেশাজীবী এই চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করতে পারেন নাকি? সেদিন টিভিতে দেখা টকশোর এক ব্যক্তির মত ছিল, শ্রমিকদের কো-অপারেটিভ তৈরি করে কারখানার পরিচালনা তাদের হাতে ছেড়ে দেয়া হলে পাটকল লাভজনক হতে পারে। কেননা, তারাই জানে কেন পাটকল মুনাফা করতে পারছে না। এর দুর্বলতাগুলো প্রশাসকদের চাইতে তারাই ভাল জানে যেমন, পাটকলগুলোর প্রশাসক পাট মৌসুমে পাট কেনে না। কৃষক তাদের উৎপাদিত পাট কারখানায় বিক্রি করতে পারে না বলে মধ্য-স্বত্বভোগীদের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হয়। মধ্যস্বত্বভোগীর কাছ থেকে পরে পাটকল প্রশাসন উচ্চমূল্যে পাট কেনে। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, পাটশিল্প একটি ‘দুষ্টচক্রে’র ভেতরে বন্দী হয়ে আছে। বন্দী হয়ে আছে পাটশিল্প, পাট শ্রমিক ও সরকার! এসব অসঙ্গত, অকার্যকর পলিসি, ব্যবস্থা পরিবর্তন করা সম্ভব আন্তরিক, কমিটেড ব্যক্তি দ্বারা। বিমান বাংলাদেশকে একটি দুষ্টচক্র থেকে উদ্ধার করতে বদ্ধপরিকর একজন সচিবের কথা জানতে পেরেছি, তাই আশা হচ্ছে, আন্তরিক ব্যক্তি ও কার্যকর ব্যবস্থা অনুসন্ধান করে শীঘ্রই সরকার-শ্রমিক ঐক্যবদ্ধভাবে পাটের দুরবস্থা দূর করে জনগণকে তার গর্বের শিল্পকে রক্ষা করে নিজেকে, শ্রমিক ও কৃষককে শান্তি এবং স্বস্তিতে রাখবে। চিনিশিল্প নিয়ে আমি আগেও লিখেছি। দেশী মিলের পুষ্টি সমৃদ্ধ চিনি, লাল চিনি খুঁজে খুঁজে আমি কিনি বহু আগে থেকে। এখন কৃষি মন্ত্রণালয়ের দোকান থেকে কিনি। এ তথ্য আমাদের জানা যে, সব কিছু ধ্বংসের নায়ক জিয়ার সময় থেকে বিদেশ থেকে সাদা চিনি আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। আমাদের দেশের দীর্ঘকালের ব্যবসার ঐতিহ্য হচ্ছে পণ্য আমদানি করে দেশে উচ্চমূল্যে বিক্রি করা। আর দেশী পণ্যের বাজার বিদেশে থাকলে সেই পণ্য বিদেশে বিক্রি করা। অর্থাৎ, সওদাগরি কাজটি ব্যবসা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে! কিন্তু নিজ দেশের উৎপাদিত পণ্য মজুদ থাকতে সে পণ্যকে বিনষ্ট হতে দিয়ে বাজারে বিদেশ থেকে সেই একই পুষ্টিহীন পণ্য দেশী বাজারে এনে উচ্চ মুনাফা রেখে বিক্রি করার নাম কি রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত হবে না? চিনির ক্ষেত্রে জিয়া, এরশাদ, খালেদার আমলের দেশপ্রেমহীন, স্বদেশী পণ্যের বাজার বিনষ্ট করে চিনিকল মালিক, শ্রমিক, আখ কৃষককে একত্রে ধ্বংস করা হয়। এই পুঁজিবাদী প্রক্রিয়া থেকে কেন মুক্তিযুদ্ধপন্থী সরকার সরে আসবে না? কেন সরকার আখ কৃষক, চিনি শ্রমিকের স্বার্থরক্ষা করবে না? চিনি আমদানিকারী সওদাগরেরা দীর্ঘকাল বিদেশী চিনি আমদানি করে আমাদের দেশী চিনিকে গুদামে নষ্ট করেছে। শ্রমিককে মজুরির বিনিময়ে চিনি দিয়ে চরম অমানবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। চিনি আমদানি এ কারণে নিরুৎসাহিত করা এবং দেশী চিনির পুষ্টিগুণের প্রচারণা করে ক্রেতাদের উৎসাহিত ও সচেতন করার কাজটি প্রচারক সংস্থা এবং সরকারকে গ্রহণ করতে অনুরোধ করব। অবস্থাটা এমন হয়েছে যেন কৃষক আখ চাষ করে বিশাল অপরাধ করেছে। মিল শ্রমিক চিনি উৎপন্ন করে আরেক অপরাধ করেছে! বিশ্বায়ন বা বিশ্ব বাণিজ্যে অংশগ্রহণের জন্য এশিয়া, লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকার অনুন্নত দেশগুলোতে অকারণে অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করা এবং সে কারণে দেশীয় পণ্য বিনষ্ট করার অদ্ভুত, কদর্য, অমানবিক নীতিগুলোকে আমাদের প্রত্যাখ্যান করার সময় এসেছে। অর্থমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী যৌথভাবে দেশী চিনির উৎপাদন বৃদ্ধি ও বাজারজাতকরণে আন্তরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে আশা করি। এ প্রসঙ্গে ‘ভারি চিনি’ নামের একরকম ক্যান্সার সৃষ্টিকারী সস্তা চিনি বাজারে দেখেছি। পরে এটি ক্যান্সার সৃষ্টি করে এমন তথ্য প্রচার হলে ঐ চিনি নিষিদ্ধ করা হয়। এর মানে এই নয় যে, এটি আর দেশে আসছে না। আমার গভীর সন্দেহ, ঐ পণ্যটি আমাদের দেশের মিষ্টি তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলো এই সস্তা, ভারি চিনি দিয়ে মিষ্টি তৈরি করছে। এটি চীন থেকে আসছে। চীনে গিয়ে আমাদের দেশের উঠতি সওদাগরেরা বিভিন্ন নিম্নমানের চীনে উৎপাদিত খেলনা, যন্ত্রপাতি, মোবাইল কিনে দেশে এনে বিক্রি করে। তাদের কারও হাত দিয়ে ঐ ভয়ঙ্কর ভারি চিনি দেশে আসছে না এবং মিষ্টান্ন বিক্রেতা কোম্পানি/ দোকান মালিক ঐ চিনি দিয়ে সস্তার মিষ্টান্ন বানাচ্ছে না তা বিশ্বাস করা কঠিন। কারণ, ভেজাল মেশানো খাদ্য, ওষুধ, পানীয়, প্রসাধনী সামগ্রী তৈরি করা ও বিক্রি করতে মানুষ যখন বিন্দুমাত্র চিন্তা করছে না যে, এসব তার সন্তানও খেতে এবং ব্যবহার করতে পারে এবং ফলে তার মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে! তারা ঐ ভারি চিনি দিয়ে মিষ্টান্ন, পানীয়, হাওয়াই মিঠাই ইত্যাদি বানাচ্ছে না এটা কি হতে পারে? কিছুকাল আগে যুক্তরাষ্ট্রে চীন থেকে আমদানি করা খেলনায় অস্বাভাবিক পরিমাণ লিড বা সীসার উপস্থিতি শনাক্ত হলে হৈ চৈ হয়েছিলÑ মনে পড়ে। আমাদের দেশে চীন থেকে সওদাগরেরা শিশুদের খেলনা সামগ্রীই বেশি কিনে আনে, যাতে শিশুদের জন্য জীবনহানিকর সীসার অস্তিত্ব এ দেশে কোন সংস্থা পরীক্ষা করে দেখেছে বলে মনে হয় না। মনে পড়ল একবার গুঁড়া দুধে ট্যালকম পাউডার, সোডা আছে বলে সন্দেহ হওয়ায় বিসিএসআইআরে বহু ঘোরাঘুরি করে জানলাম, দুধের ভেজাল পরীক্ষার মূল্য ১৩,০০০/- টাকা!অবিশ্বাস্য! পারিনি, ব্যর্থ হয়ে ফিরেছিলাম। বিএসটিআই কি করে? এর লোকবল, দক্ষতা, প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতির কি অবস্থা আমার জানা নেই। ভাগ্যের হাতে জীবনকে ছেড়ে দিয়ে জনগণ চলছে, তাই নয় কি? লেখক : শিক্ষাবিদ
×