ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রুমেল খান

পবিত্র গুহার দেশে গেমসের নানা অভিজ্ঞতা

প্রকাশিত: ১২:২৭, ৮ জানুয়ারি ২০২০

পবিত্র গুহার দেশে গেমসের নানা অভিজ্ঞতা

(গত সংখ্যার পর) দক্ষিণ এশিয়ার অলিম্পিক গেমস খ্যাত সাউথ এশিয়ান গেমস নেপালে কভার করতে গিয়ে নানা অভিজ্ঞতা হয়েছিল এবার। গেমসের সময়সীমা ছিল ১০ দিন। তবে যাওয়া-আসা সব মিলিয়ে সেখানে থাকতে হয়েছিল মোট ১৪ দিন। নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৪০০ মিটার (৪৬০০ ফুট) উচ্চতায় অবস্থিত। যে সময়টায় ওখানে ছিলাম, তখন সেখানে ছিল ভয়াবহ শীত। দিনে তাপমাত্রা থাকে ১০-১২ ডিগ্রী সেলসিয়াস, কিন্তু রাতে তা নেমে আসে অর্ধেকে! চার-পাঁচটি জামা, মাফলার, হাতমোজা ও কান টুপি পরেও রেহাই পাবার জো নেই। ঠা-া একেবারে হাড়ের ভেতরে গিয়ে যেন সুঁইয়ের মতো খোঁচা দিয়ে অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দেয়। দুপুর ২টার পর থেকে সূর্যের আলো আর পাওয়া যায় না। সঙ্গে সঙ্গেই বাড়তে থাকে শীতের মাত্রা। এখানকার কুকুর ও বিড়ালগুলোর গায়ের পশম বেশ বড় ও খাড়া, অনেকটা ভালুকের লোমের মতো। প্রকৃতি তাদের শীত মোকাবেলায় এরকম সক্ষমতা দিয়ে দিয়েছে। এখানে শীত থেকে বাঁচার দুটি উপায়। একটি হচ্ছে বিশেষ ধরনের তরল পানীয় পান করা (যাকে অনেকেই মজা করে ‘পাগলা পানি’ বলে), আরেকটি হচ্ছে গরম চা বা কফি পান করা। সঙ্গত কারণেই দ্বিতীয় উপায়ের ওপর ভরসা করতে হয়েছে। কাঠমান্ডুর সুন্দরা এলাকার একটি হোটেলে উঠেছিলাম। সেখান থেকে মাত্র দুই মিনিট হাঁটা দূরত্বে তিন রাস্তার মোড়ে একটি ভ্রাম্যমাণ চা-কফির স্টল খুঁজে বের করি। স্টলের কোন নাম নেই। ওখানকার চা-কফি বেশ সুস্বাদু, দামেও কম; তাই সারাক্ষণই কাস্টমারের ভিড় লেগেই থাকে। ওখানেই পরিচয় ভারতীয় দম্পত্তি সন্দ্বীপ সিং এবং মানদীপের সঙ্গে। এই টি স্টলের মালিক তারা। বছরখানেক হলো কিশোর বয়সের প্রতিবেশী-প্রেমিকা মানদীপকে বিয়ে করে পালিয়ে ভারতের চ-িগড় থেকে পালিয়ে নেপালে চলে এসেছেন তারা। সন্দ্বীপ বিভাগীয় পর্যায়ে কাবাডি এবং মানদীপ রাজ্য পর্যায়ে খো খো খেলেছেন। তাদের লক্ষ্য নিজেদের বিয়ে এবং বর্তমান অবস্থানের খবরটা উভয় পরিবারের কাছেই গোপন রাখা এবং চা বিক্রির জমানো টাকায় আমেরিকা গিয়ে থিতু হওয়া। প্রতিদিন সকালে চা পান করতে গিয়ে একটু একটু করে তাদের জীবন-কাহিনী শুনতাম এবং পরে ঢাকায় ফিরে তাদের নিয়ে একটি স্টোরি করি, যা দৈনিক জনকণ্ঠের খেলার পাতায় প্রকাশিত হয়। এছাড়া পরিচয় হয় নেপালী ক্রীড়া সাংবাদিক দীপক জিনাওয়ালির সঙ্গে। কাঠমান্ডুর দশরথের বাস্কেটবল স্টেডিয়ামের পাশে মিডিয়া সেন্টারে বসে রোজ কাজ করতাম (একে এসএ গেমসে বলা হতো এমপিসি বা মেইন প্রেস সেন্টার হিসেবে। অনেকেই আবার একে বলতেন মিডিয়া এ্যান্ড পাবলিকেশন্স সেন্টার হিসেবেও)। আমার পাশেই বসতেন দীপক। কাঠমান্ডুর ‘দৈনিক হিমাল খবরপত্রিকা’র বিশেষ প্রতিনিধি। খুবই অমায়িক এবং বন্ধুবৎসল দীপক। বিভিন্ন বিষয়ে অনেক সাহায্যও করেছেন। দেশে ফিরেও এখনও তার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছি। কাঠমান্ডুতে আমার ছবি ছাপিয়ে নিজেদের পেপারে একটি নিউজও করেন দীপক। বাংলাদেশ থেকে আমরা কজন সাংবাদিক সেখানে গিয়েছি, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া সাংবাদিকদের সংগঠন বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস এ্যাসোসিয়েশন সম্পর্কে নানা তথ্য, আমি কোন্ খেলা বেশি কভার করতে পছন্দ করি, ফুটবলে প্রথম ম্যাচেই ভুটানের কাছে বাংলাদেশের অপ্রত্যাশিত হারের পর আমার মানসিক অবস্থা কেমন ছিল ... এসব প্রশ্ন নিয়েই দীপক প্রতিবেদনটি করেন। পত্রিকাটির একটি কপি দীপক আমকে উপহার দেন, সেটি পরে ঢাকায় এনে পরিবারকে দেখিয়েছি। নেপালে গিয়ে বাংলাদেশের ক্রীড়া সাংবাদিক মোরসালিন আহমেদের ‘দক্ষিণ এশীয় গেমসে বাংলাদেশ’ নামের বইটি সাংঘাতিক কাজে লেগেছে ওখানে যাওয়া সব বাংলাদেশী সাংবাদিকদের। ১৯৮৪-২০১৬ সাল পর্যন্ত ১২টি এসএ গেমসের সবরকম তথ্য ছিল এ বইটিতে। এছাড়া দৈনিক সমকালের শাখাওয়াত হোসেন জয়, রাইজিং বিডি ডটকমের আমিনুল ইসলাম, যুগান্তরের ওমর ফারুক রুবেল, নয়া দিগন্তের জসিম উদ্দিন রানা, ইনকিলাবের জাহেদ খোকন, গ্লোবাল স্পোর্টস ডটকম ডট বিডির শফিকুল আলম শিপলু, দেশ রূপান্তরের সুদীপ্ত আহমদ আনন্দ, বিডিনিউজ২৪ ডটকমের রুবেল জুবায়েরসহ অনেকের সাহায্য পেয়েছি, যা না উল্লেখ করলে অন্যায় হবে। আমরা সাংবাদিকরা খবরের জন্ম দেই। অথচ নেপালে এসে আমরাই কি না খবরের শিরোনাম হয়ে গেলাম! ১০ ডিসেম্বর কাঠমান্ডুর দশরথের রঙ্গশালা স্টেডিয়ামে পুরুষ ফুটবলের ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয়। খেলা শুরু হওয়ার আগে টিকেট বিক্রির সময় দর্শকদের প্রচ- ভিড় হয়। এ সময় আয়োজকরা টিকেটের মূল্য অনেক বাড়িয়ে দেন। এ নিয়ে দর্শকদের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। খবর পেয়ে এক নেপালি ক্রীড়া সাংবাদিক সেখানে সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে তাকে মেরে প্রচ- আহত করে পুলিস। গুরুতর আহত ওই সাংবাদিককে হাসপাতালে নেয়া হয়। এতে সব নেপালি সাংবাদিকরা ক্ষেপে যায় এবং পুলিস তাদের কাছে ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত কাজ না শুরু করার ঘোষণা দেয়। আমরা বাংলাদেশী সাংবাদিকরা তখন মিডিয়া সেন্টারে বসে কাজ করছিলাম। অন্য নেপালি সাংবাদিকরা এসে আমাদের সব ঘটনা জানিয়ে অনুরোধ জানায় বাইরে গিয়ে মিনিট দশেকের জন্য তাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করতে। তাই করলাম আমরা। সেই সঙ্গে হয়ে গেলাম নেপালের সংবাদপত্রের শিরোনাম! জীবনে যা শুনিনি, এবার নেপালে গিয়েই তা-ই শুনতে হয়েছে। আমার চেহারা নাকি নেপালিদের মতো! মিডিয়া সেন্টার কর্মরত স্থানীয় এক নারী কর্মী আমাকে নেপালি ভাষায় কিছু জিজ্ঞেস করলে আমি কিছু না বুঝে তাকিয়ে থাকি। তখন তিনি ইংরেজীতে জিজ্ঞেস করেন আমি কোন্ দেশের? উত্তরে বাংলাদেশের নাম বললে তিনি বিস্মিত হয়ে জানান, আমার চেহারা দেখে তিনি আমাকে নেপালি ভেবেছিলেন! কাঠমান্ডু থেকে চলে আসার আগের দিন সামান্য কিছু কেনাকাটা করেছিলাম। ‘বিশাল বাজার’ নামের একটি মার্কেটে গিয়ে ঘুরে একটি ঐতিহ্যবাহী নেপালি ছুরি কিনলাম। এই বিশেষ নকশা করা ছুরিকে নেপালিরা বলে ‘খুকুরি’। এই ছোরাটি ব্রিটিশ রাজের অধীন গুর্খা বাহিনীর মারাত্মক হাতিয়ার ছিল। ছুরি বিক্রেতার নাম রোশন। সে যখন জানতে পারলো আমি বাংলাদেশী ক্রীড়া সাংবাদিক এবং এসএ গেমস কভার করতে নেপালে এসেছি, তখন অনুরোধ জানালো আমি যেন তার ছবি উঠিয়ে ফেসবুকে দিয়ে তার দোকানের (নাম : গুড খুকুরি শপ) একটু পাবলিসিটি করে দিই। এবারের গেমসে বাংলাদেশকে প্রথম পদক এনে দিয়েছিলেন হুমায়রা আক্তার অন্তরা। তবে সেটি ছিল ব্রোঞ্জ। যেদিন তিনি স্বর্ণপদক জেতেন। সেদিন ম্যাচ শেষে তার ইন্টারভিউ নিই এবং ছবি তোলার পাশাপাশি আরেকটি কাজ করি। যে পাঞ্চিং গ্লাভস পড়ে অন্তরা সোনার পদক জেতেন, সেটা তার কাছ থেকে নিয়ে হাতে পড়ি এবং ছবি তুলি। গেমস কভার করতে গিয়ে আবিষ্কার করিÑ কোন ভেন্যুই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শতভাগ প্রস্তত ছিল না! এতে করে আয়োজকদের অদক্ষতার চিত্রটিই প্রকাশ পায়। যদিও ঢাকা থেকে দেড় ঘণ্টার বিমানযাত্রায় কাঠমান্ডুতে গিয়েই রাস্তায় রাস্তায় দেখা গেছে এসএ গেমসের নানা ব্যানার ও প্ল্যাকার্ড। বোঝা গেল প্রচারের দিক দিয়ে কোন কমতি রাখেনি আয়োজকরা। কিন্তু অবাক ও হতাশ হতে হলো বিভিন্ন ভেন্যুতে গিয়ে। কারণ একটি ভেন্যুও এবং এর আশেপাশের পরিবেশ কোন কিছুই পুরোপুরি প্রস্তত নেই বা অনুকূলে নেই। বিভিন্ন ভেন্যু ধুলাবালির দিয়ে ঢাকা ছিল। আসলে ২০১৫ সালে একটি প্রলয়ঙ্কারী ভূমিকম্পে এখানকার সবকিছুর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। সেগুলো তখন পর্যন্ত মেরামত করতে পারেনি আয়োজকরা। বিভিন্ন এ্যাথলেটের শ^াসকষ্ট ছিল এবারের আসরের আলোচিত সমস্যা। নিজের চোখেই দেখেছি মেয়েদের ১৫০০ মিটার দৌড়ের বিজয়ী শ্রীলঙ্কার উদা কুবুরালাগে দৌড় শেষ করার পরেই চোখমুখ উল্টে দম বন্ধ হয়ে প্রায় মারাই যেতে বসেছিলেন! বাংলাদেশ ফুটবল দল, বাংলাদেশের তিন সাইক্লিস্টসহ বিভিন্ন দেশের এ্যাথলেটরা এই সমস্যায় পড়েছেন। নেপাল এই আসরেই ইতিহাসের সেরা সাফল্য অর্জন করে (৫১ সোনা, ৬০ রূপা ও ৯৫ তা¤্র)। সবচেয়ে বেশি সোনাজয়ের পাশাপাশি পদক তালিকাতেও সবচেয়ে ভাল করে তারা। এর নেপথ্য কারণ ছিল একটাইÑ অবকাঠামোগত উন্নয়নে নজর না দিয়ে নেপাল নজর দিয়েছিল তাদের এ্যাথলেটদের নিরবিচ্ছিন্ন উন্নত প্রশিক্ষণের ওপর। বাংলাদেশ এবার ১৯ স্বর্ণ, ৩৩ রৌপ্য ও ৮৫ তা¤্রপদকসহ মোট ১৩৭ পদক জেতে। এসএ গেমসে পদক জেতায় যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় থেকে আকর্ষণীয় আর্থিক প্রণোদনা পাবেন পদকজয়ী এ্যাথলেটরা। ব্যক্তিগত ইভেন্টে স্বর্ণ, রৌপ্য এবং তা¤্রপদক জিতে তারা পাবেন যথাক্রমে ৬, ৩ এবং ১ লাখ টাকা করে। দলীয়ভাবে স্বর্ণ, রৌপ্য ও তা¤্রপদক জিতে দলের খেলোয়াড়সহ প্রতিটি কোচিং স্টাফ জনপ্রতি পাবেন যথাক্রমে ১ লাখ, ৫০ হাজার এবং ৩০ হাজার টাকা করে। এসএ গেমস উপলক্ষে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় মোট ৩১ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল। এর মধ্যে ১০ কোটি ২৫ লাখ টাকা অংশগ্রহণ খাতে এবং বাকি ২০ কোটি ৭৫ লাখ টাকা প্রশিক্ষণ খাতে। ২০১০ ঢাকা এসএ গেমসের সময় বাংলাদেশ ক্রীড়া দল প্রশিক্ষণ ক্যাম্প করেছিল পুরো এক বছর। এর সুফলও তারা পেয়েছিল গেমসে ১৮টি সোনা জিতে, যা গেমসের এক আসরে তাদের সেরা সাফল্য। কিন্তু সর্বশেষ ২০১৬ শিলং ও গুয়াহাটি এসএ গেমসের সময় বাংলাদেশ দলের অনুশীলন ক্যাম্পের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র ৫ মাস। ফলাফল? আগের ১৮ সোনা থেকে সেবার সোনার পদকের সংখ্যা নেমে এসেছিল মাত্র ৪-এ! অথচ আবার মাত্র সাড়ে তিন মাসের প্রশিক্ষণ নিয়েই কি না আগের সব সাফল্যকে অতিক্রম করেছে লাল-সবুজরা! সুন্দরা, হট ওয়াটার, বিসমিল্লাহ হোটেল, বাফো, চায়ে, কিতনা রুপিয়া, খানা, এমপিসি, সাতদোবাতো, ত্রিভূবন, দশরথ, রঙ্গশালা, এন.সি, আই.সি, থামেল, পোখারা, কাঠমান্ডু, এসএ গেমস, দীপেশ, আশিষ, দিদি, দুর্গাদা ... গত ২৯ নবেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই শব্দগুলোর সঙ্গে আষ্ট্রেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিলাম। নেপালে গেমস কাভার করতে এসে দেশটির প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। প্রচ- ঠা-ায়, প্রচ- চাপে, প্রচ- ব্যস্ততায় পার হয়েছে এক-একটি দিন। তারপরও দারুণভাবে উপভোগ করেছি প্রতিটি ক্ষণ, প্রতিটি মুহূর্ত। হৃদয়ে চিরদিন গেঁথে থাকবে হিমালয়ের দেশের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য, এখানকার মানুষদের আন্তরিকতা, সুন্দর ব্যবহার ও তাদের সহযোগিতার কথা। সময়-সুযোগ পেলে আবারও যেতে চাই এই দেশে। (সমাপ্ত)
×