ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

লাবুশেনের অবিশ্বাস্য উত্থানের গল্প

প্রকাশিত: ১২:২৬, ৮ জানুয়ারি ২০২০

লাবুশেনের অবিশ্বাস্য উত্থানের গল্প

গত আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহের ঘটনা। লর্ডসে এ্যাশেজের দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে মাথায় আঘাত পান স্টিভেন স্মিথ। দ্বিতীয় ইনিংসে তার পরিবর্তে মাঠে নামেন মর্নাস লাবুশেন। ইতিহাসের প্রথম কনকাশন (বদলি) ব্যাটসম্যান যে নতুন ইতিহাস গড়তে চলেছেন, তখনও হয়ত কেউ ভাবতে পারেননি। ২০১৯, পরের পাঁচ মাসে ২৫ বছর বয়সী অস্ট্রেলিয়ানের অবিশ্বাস্য পুনরুত্থান দেখেছে ক্রিকেটবিশ্ব। ১৩ ইনিংসে ৩ সেঞ্চুরি, হাফ সেঞ্চুরি ৬টি; জানুয়ারিতে যার র‌্যাঙ্কিং ছির ১১০, ডিসেম্বরে সেই তিনি বছর শেষে করেছেন চতুর্থ স্থানে থেকে! অবিশ্বাস্য বললেও কম বলা হবে। ২০২০ নতুন বছরেও শুরুটা করেছেন ঠিক সেখান থেকে। সিডনিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের শেষ টেস্টের প্রথম দিনেই তুলে নেন সেঞ্চুরি। শেষ পর্যন্ত সেটিকে ডবল সেঞ্চুরিতে রূপ দেন দক্ষিণ আফ্রিকান বংশোদ্ভূত এ অস্ট্রেলিয়ান। খেলেন ২১৫ রানের মন মাতানো ইনিংস। এক গ্রীষ্মে অন্তত পাঁচ টেস্টে গড় রানের হিসেবে স্যার ডন ব্র্যাডম্যান ও নিল হার্ভেকে পেছনে ফেলে দিয়েছেন লাবুশেন। নাড়িয়ে দিয়েছেন রেকর্ডবইয়ের আরও অনেক পরিসংখ্যান। ১৯৯ রানে আটকে ছিলেন প্রায় মিনিট বিশেক। এক রানের অপেক্ষা যেন শেষ হচ্ছিল না আর। অবশেষে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। কলিন ডি গ্র্যান্ডহোমের অফ স্টাম্পের বলটা কাভারের দিকে খেলতে চেয়েছিলেন। যদিও ঠিকমতো খেলতে পারেননি। ব্যাটের কানায় লেগে কিপারের সামনে দিয়ে হয়ে যায় চার। দৌড়ে পেরিয়ে গেলেন নন-স্ট্রাইকার প্রান্ত। প্রথমে ব্যাটটা যেন এক হাতে ছুড়ে মারলেন বাতাসে। ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে দর্শকদের করতালি। লাবুশেন এক হাতে ব্যাট, অন্য হাতে হেলমেট উঁচিয়ে ধরে দর্শক অভিবাদনের জবাব দিলেন। টিভি ক্যামেরা খুঁজে নিল সিডনির ভিআইপি বক্সে থাকা তার বাবা-মাকেও। ৩৪৬ বলে করেন ডবল সেঞ্চুরি। শেষ পর্যন্ত ১৯টি চার ও এক ছক্কায় ৩৬৩ বলে থামেন ২১৫ রানে। পার করেন তার আগের সেরা ১৮৫ রান। ডবল সেঞ্চুরি ছোঁয়ার পর অবশ্য আর বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি। আউট হয়েছেন কিউই লেগস্পিনার টড এ্যাস্টলকে ফিরতি ক্যাচ দিয়ে। দুর্দান্ত এ ইনিংসটির মধ্য দিয়ে ব্যাটিং গড়ে লাবুশেন টপকে গেছেন এ সময়ের অন্যতম সেরা স্মিথকেও (৬২.৮৪)। অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ৫ টেস্টের মৌসুমে রান তোলায় পেছনে ফেলেছে প্রয়াত স্যার ডন ব্র্যাডম্যান (৮১০) ও আরেক কিংবদন্তি নিল হার্ভেকে (৮৩৪)। ৬০ বছর আগে ৮৩৪ রান তোলা হার্ভেকে টপকে ৮৩৭ রান তুলেছেন লাবুশেন। এ ছাড়া প্রথম অসি হিসেবে অস্ট্রেলিয়ান গ্রীষ্মকালীন টেস্টে চারটি ১৪০ বা তার বেশি রানের ইনিংস খেলেছেন। মোট ব্যাটিং করেছেন ৩৩ ঘণ্টা। আর সিডনির ডাবলে তিনি তৃতীয়বার ১৫০ বা তার বেশি রানের ইনিংস খেলেছেন। মাত্র ২২ ইনিংসেই এই কীর্তি গড়েন তিনি। যে তালিকায় তার সামনে কেবল ওই ব্র্যাডম্যান (১৫) আর হার্ভেই (১০)। গত এ্যাশেজে স্টিভেন স্মিথের বদলি হিসেবে নামার পর থেকেই দুর্দান্ত ফর্মে আছেন লাবুশেন। গত বছর ১১ টেস্টে করেছিলেন ১১০৪ রান। যেখানে হাজার ছুঁতে পারেননি বিশ্বের আর কেউ। এবার তিনি নতুন বছর শুরু করলেন ডবল সেঞ্চুরি দিয়ে। অথচ ক্যারিয়ারের প্রথম ১৫ ইনিংসে লাবুশেনের ছিল না কোন সেঞ্চুরি। সেখানে সবশেষ সাত ইনিংসে তিন অঙ্ক ছুঁলেন চারবার। যার একটি আবার ডবল! প্রথম তিনটি সেঞ্চুরিই ছিল টানা তিন ইনিংসে। এর মধ্যে দুটিতেই পেরিয়েছিলেন দেড় শ’। কিন্তু ডাবল সেঞ্চুরিটা ছোঁয়া হচ্ছিল না। এবার সেই আক্ষেপও ঘুচল। অস্ট্রেলিয়া দলে প্রথম যখন এসেছিলেন, সতীর্থরাই নাকি তার নামটা ভালভাবে উচ্চারণ করতে পারত না, সমর্থকদের কাছে তিনি ছিলেন অপরিচিত একটা নাম। অনেকটা বাধ্য হয়েই ইউটিউবে একটা ভিডিও বানিয়েছিলেন। বলেছিলেন তার নামের সত্যিকারের উচ্চারণ হলো- মার্নাস লাবুশেন! ২০১৯ শেষে এসে সেই লাবুশেনের নাম উচ্চারণ করতে আর কেউ কোন ভুল করেন না। ভুল করার আর কোনো উপায় নেই। তিনি যে, ক্রিকেট ইতিহাসে রীতিমতো বিপ্লবই ঘটিয়ে বসেছেন। ক্রিকেটের খবরের পাতায় তিনি এখন নিয়মিত মুখ। ২০১৯ সালে তিনিই একমাত্র ব্যাটসম্যান যিনি টেস্টে করেছেন এক হাজার রান। এর চেয়েও বড় ব্যাপার হলো, ক্যারিয়ারের প্রথম ১৪ টেস্ট খেলার পরই তিনি চলে এসেছেন ব্যাটসম্যানদের র‌্যাঙ্কিংয়ের সেরা পাঁচে। এই অর্জনটা আসলে চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। মার্নাস লাবুশেনের শুরুটা শুনলে সবার মুখ থেকেই একটা শব্দ বের হবে- দ্যেজা ভ্যু! কারণ, অস্ট্রেলিয়ার সম্প্রতি অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান স্টিভেন স্মিথের মতো তিনিও শুরুটা করেছিলেন লেগস্পিনার হিসেবেই। স্মিথ কালক্রমে ব্যাটসম্যান বনে গিয়ে এক গাদা রেকর্ডের মালিক বনে গেছেন। আর স্মিথেরই সতীর্থ আর ঘনিষ্ঠ বন্ধু লাবুশেনও সেই পথেই আছেন এখন। লেগস্পিনার থেকে ব্যাটসম্যান হয়ে গিয়ে লাবুশেন সাফল্য পেয়েছেন টেস্টের তিন নম্বর পজিশনে। এবার তিনি অপেক্ষায় আছেন ওয়ানডে অভিষেকের। লাবুশেন এখন তিনে খেললেও প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে গেল ২০১৪ সালে তাঁর অভিষেকটা হয়েছিল ওপেনার হিসেবে। কুইন্সল্যান্ডের হয়ে প্রথম ম্যাচেই করেছিলেন ৮৩ রান। বোঝা গিয়েছিল, লেগস্পিনার পরিচয়ের আড়ালে ব্যাটসম্যান হিসেবেও সক্ষমতা আছে লাবুশেনের। কুইন্সল্যান্ডেই ব্যাটসম্যান হিসেবে তাঁর বিকাশ হতে থাকে। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি অবধিও লাবুশেনের নামটা অপরিচিতই ছিল। তখনও তিনি বড় কোন ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে উঠতে পারেননি। অন্তত বিশ্বকাপের আগ অবধি বোঝার কোন উপায় ছিল না যে, তিনিই বছরের অন্যতম সেরা তারকা হয়ে উঠতে যাচ্ছেন। লাবুশেন কেবল ২০১৯ সালেই টেস্টে সবার চেয়ে বেশি রান করেননি, তিনি ২০১৮ সাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত সময়ে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটেও সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। বোঝাই যাচ্ছে সাদা পোশাকে তার মতো দাপুটে ব্যাটসম্যান এই সময়ে আর খুব বেশি নেই! তবে, এখানে এটা যোগ করলেই নয় যে সাদা পোশাকেও তিনি সমান পারদর্শী। অন্তত অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেটে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে নিজের সক্ষমতার প্রমাণ রেখেছেন তিনি। কুইন্সল্যান্ডের হয়ে মার্শ ওয়ানডে কাপে মাত্র ছয় ম্যাচেই লাবুশেনের ব্যাট থেকে এসেছে ৩৬৪ রান, ব্যাটিং গড় ৬০.৬৬। সেই সুবাদে ওয়ানডে দলেও তাকে ডেকে পাঠিয়েছে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার (সিএ) নির্বাচক কমিটি। প্রথম ১৩ টেস্ট শেষে লাবুশেনের রান ১১৮৫। তিন সেঞ্চুরি আর সাত হাফ সেঞ্চুরি। গড় ৫৬.৪২। ব্যাপারটা এখন এমন যে, তিন নম্বর পজিশনে তাঁকে ছাড়া অন্য কাউকে ভাবতেই নারাজ অস্ট্রেলিয়া দল। লাবুশেন নিজের সক্ষমতাকে এমন একটা স্তরে নিয়ে গেছেন যে, সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ান গ্রেট ইয়ান চ্যাপেল তাঁর সঙ্গে তুলনা করেছেন সাবেক দুই ক্রিকেটার রিকি পন্টিং ও মাইকেল ক্লার্কের। ফলে, বলে না দিলেই চলে যে বড় কোনো অঘটন না ঘটলে নিজের তারকাখ্যাতিকে আরও বড় করেই ছাড়বেন লাবুশেন। অস্ট্রিয়ান ক্রিকেট তার উজ্জ্বল ভবিষ্যত দেখতে পাচ্ছে। লাল বলের মতো এবার সাদা বলেও যদি নিজেকে মেলে ধরতে পারেন নিজেকে, তাহলে বলে দেয়াই যায় ক্রিকেটের জাদুর কাঠি হাতে নিয়েই আবির্ভাব হয়েছে লাবুশেনের!
×