ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

মৃত্যুঞ্জয়ের জয় ॥ শুভ মুজিববর্ষ

প্রকাশিত: ০৯:২৯, ৮ জানুয়ারি ২০২০

মৃত্যুঞ্জয়ের জয় ॥ শুভ মুজিববর্ষ

বাঙালীর বঙ্গবন্ধু বিশ্ববন্ধু শেখ মুজিব। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী। ১৭ মার্চ ১৯২০ সাল ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামের মধ্যবিত্ত সম্ভ্রান্ত শেখ পরিবারে তাঁর জন্ম। এক মহান আধ্যাত্মিক পুরুষ শেখ বোরহান উদ্দিন এই শেখ বংশের গোড়াপত্তন করেছিলেন। মোগল আমলের স্মৃতিময় দালানগুলোই অতীতের এই পরিবারের সুদিনের সাক্ষ্য বহন করে চলেছিল। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘একটা দালানে আমার এক মামা আজও কোনমতে দিন কাটাচ্ছেন। আর একটা দালান ভেঙ্গে পড়েছে, যেখানে বিষাক্ত সর্পকুল দয়া করে আশ্রয় নিয়েছে। এই সকল দালান চুনকাম করার ক্ষমতা আজ তাদের অনেকেরই নেই। এই বংশের অনেকেই এখন এ বাড়ির চারপাশে টিনের ঘরে বাস করেন। আমি এই টিনের ঘরের এক ঘরেই জন্মগ্রহণ করি।’ আমরা অবগত আছি যে, ভারতের জাতির পিতা পরম শ্রদ্ধেয় মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধীকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সত্য আত্মার অমিয় শক্তিতে বিশ্বাসী অহিংস সংগ্রাম, শান্তি ও কালজয়ী মানবতার জন্য ‘মহাত্মা’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা প-িত জওহরলাল নেহরুর উদ্দেশে বিশ্বজয়ী বিজ্ঞানী প্রফেসর আইনস্টাইন বলেছিলেন, ‘আমাদের তুমিই একমাত্র ভরসা, তোমার পদচিহ্নই আগামীকালের পৃথিবীর কক্ষপথ’। রবি ঠাকুর তাঁকে ‘ঋতুরাজ’ বলে অভিহিত করেছিলেন। আজ বাঙালীর বঙ্গবন্ধু বিশ্ব পরিম-লে একই ধারাবাহিকতায় স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা ভাবনা-সংগ্রাম-ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর, শোষিত-বঞ্চিত-স্বাধীনতাকামী জনগোষ্ঠীর বিশ্ববন্ধু হিসেবে নন্দিত ও সমাদৃত। বঙ্গবন্ধুর জন্মেই যেন বাঙালী জাতি শুনতে পেয়েছিল রবি ঠাকুরের সেই ‘অচেনা’ কবিতার পাঠ, ‘রে অচেনা, মোরমুষ্টি ছাড়াবি কীক’রে/যতক্ষণ চিনি নাই তোরে?/কোন অন্ধক্ষণে বিজড়িত তন্দ্রাজাগরণে/রাত্রি যবে সবে হয় ভোর, মুখ দেখিলাম তোর।’ বস্তুতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর জীবন চরিত, জীবন-সমাজ-রাষ্ট্র-শিক্ষাদর্শন, বৈশ্বিক সম্পর্ক ইত্যাদি পর্যালোচনায় এটি বরাবরই প্রতীয়মান হয়েছে, তিনি ছিলেন অনগ্রসর বাঙালী সমাজে বিদ্যমান সকল কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামী, মানবাধিকার বিরোধী কার্যকলাপ, শোষণ-বঞ্চনার কঠিন অন্ধকার দূরীভূত করে বাঙালী জাতি-সত্তার ভিত্তিতে আধুনিক-গণতান্ত্রিক-সমাজতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা। তাঁর সততা, সত্যবাদিতা, নির্ভীক সাহসিকতা, অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা, দেশপ্রেম, মাটি ও মানুষের প্রতি নিখাদ ভালবাসা ছিল অতুলনীয়। এদেশের সমগ্র জনগণ তাঁর নেতৃত্বে আস্থাশীল হয়ে অকাতরে ত্রিশ লাখ প্রাণ এবং দুই লাখ জননী-জায়া-কন্যার সর্বোচ্চ প্রপতন বিসর্জনে অর্জন করেছে এই স্বাধীন মাতৃভূমি। রবি ঠাকুরের ভাষায় আবারও ব্রততীচরণে বলতে হয়, ‘হে অচেনা, দিন যায়, সন্ধ্যা হয়, সময় রবে না,/ মহা আকস্মিক বাধা বন্ধ ছিন্ন করি দিক,/তোমারে চেনার অগ্নি দীপ্তশিখা উঠুক উজ্জ্বলি,/দিব তা হে জীবন অঞ্জলি।’ ১৯৬৯, ৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক রাজনীতিক বাংলার দুই অবিসংবাদিত জননেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেরে বাংলা ফজলুল হকের মাজার সংলগ্ন আয়োজিত শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীর ভাষণে অত্যন্ত আবেগভরা কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এ দেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে ‘বাংলা’ কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকুও চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে।... একমাত্র বঙ্গোপসাগর ছাড়া আর কোন কিছুর নামের ‘বাংলা’ কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায়নি।’ তাই সেইদিন বাঙালী জাতির চিরায়ত ঐতিহ্যিক এই আবাসভূমিকে পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব বাংলা নয়, ‘বাংলাদেশ’ নামেই এটির নামকরণ করেছিলেন। জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের ভাষায়, এই ঘোষণার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু তাঁর এবং বাঙালী জাতির মধ্যে অবিচ্ছেদ্য আঙ্গিক সম্পর্ক নির্মাণ করেছেন। এটিই ছিল বাঙালী জাতীয়তাবাদের অভীষ্টতম চারণ ক্ষেত্র। ৬ জানুয়ারি ১৯৭০ বঙ্গবন্ধু এবং শ্রদ্ধেয় নেতা এইচএম কামারুজ্জামান যথাক্রমে পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সকলের জানা আছে যে, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে মনোনয়ন নিয়ে প্রচ- মনোবেদনায় বঙ্গবন্ধু ছিলেন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এবং বিরূপ অভিজ্ঞতায় ক্ষুব্ধ। সে সময় নির্বাচনী প্রচার অভিযানে বঙ্গবন্ধু তাঁর অপরিমেয় জনপ্রিয়তা সম্পর্কে সম্যক উপলব্ধি-ঋদ্ধ হলেন। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আমি যে গ্রামেই যেতাম, জনসাধারণ শুধু আমাকে ভোট দেওয়ার ওয়াদা করতেন না, আমাকে বসিয়ে পানদানের পান এবং কিছু টাকা আমার সামনে নজরানা হিসেবে হাজির করত এবং না নিলে রাগ করত। তারা বলত, এ টাকা নির্বাচনের খরচ বাবদ দিচ্ছে। আমার মনে আছে খুবই গরিব এক বৃদ্ধ মহিলা কয়েক ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে, শুনেছে এই পথে আমি যাব, আমাকে দেখে আমার হাত ধরে বলল, ‘বাবা আমার এই কুঁড়ে ঘরে তোমায় একটু বসতে হবে।’ বঙ্গবন্ধু আরও লিখেছেন, ‘আমি তার হাত ধরেই তার বাড়িতে যাই। অনেক লোক আমার সঙ্গে, আমাকে মাটিতে একটা পাটি বিছিয়ে বসতে দিয়ে একবাটি দুধ, একটা পান ও চার আনা পয়সা এনে আমার সামনে ধরে বলল, ‘খাও বাবা, আর পয়সা কয়টা তুমি নেও, আমার তো কিছুই নাই।’ আমার চোখ দিয়ে পানি এলো। আমি দুধ একটু মুখে নিয়ে, সেই পয়সার সঙ্গে কিছু টাকা তার হাতে দিয়ে বললাম, ‘তোমার দোয়া আমার জন্য যথেষ্ট, তোমার দোয়ার মূল্য টাকা দিয়ে শোধ করা যায় না।’ টাকা সে নিল না, আমার মাথায় মুখে হাত দিয়ে বলল, ‘গরিবের দোয়া তোমার জন্য আছে বাবা।’ নীরবে আমার চক্ষু দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়েছিল, যখন তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। সেই দিনই আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, মানুষকে ধোঁকা আমি দিতে পারব না।’ নিঃসংকোচে, নিঃসেন্দেহে, দৃঢ়ভাবে বলা যায়, এই ব্রত ব্যঞ্জনার কোথাও কখনো ন্যূনতম ব্যত্যয় ঘটেনি এই মহান নেতার জীবনে। রবি ঠাকুরের ‘বিস্ময়’ কবিতায় আবারও ফিরে যেতে হয়, ‘আবার জাগিনু আমি।/রাত্রি হ’ল ক্ষয়।/পাপড়ি মেলিল বিশ্ব।/এই তো বিস্ময় অন্তহীন।’ ভারতের প্রাক্তন মহামান্য রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু প্রণব মুখার্জী তাঁর The Dramatic Decade– The Indira Gandhi Years’ গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে (Muktijuddho : The Making of Bangladesh) খ্যাতিমান মার্কিন কূটনীতিক Archer K. Blood গ্রন্থের (The Cruel Birth of Bangladesh) উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছেন। Archer বলেছেন, ÔSince independence real political control of Pakistan had been in the hands of the Pakistani military, the upper ranks of the civil servants and a small number of wealthy industrialists, with all three groups from West Pakistan. East Pakistan’s numerical superiority was nullified by the failure of parliamentary democracy to take effective root in Pakistan, as it had in India. The highly centralized, often authoritarian structure of Pakistan government in the West Wing resulted in West Pakistan getting the lion’s share of foreign assistance and internal development funds.’ প্রসঙ্গত প্রণব মুখার্জী লিখেছেন, ’Lack of development, undemocratic practices, and the arbitrary manipulation of parliamentary democratic systems led to the final revolt of the people of East Pakistan against the ruling West Pakistan. Mujibur Rahman emerged as the leader of this revolution. If one studies his eventful life during these years, one can understand how he gradually prepared himself and his people for the creation of the sovereign nation of Bangladesh.’ ১৯৭০ এর নির্বাচনে ছয় দফাকে ধারণ করে দেশের আপামর জনগণ অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে আওয়ামী লীগকে শুধু জয়যুক্ত করেছিলেন তা নয়, মূলত বঙ্গবন্ধুকেই এই বিপুল জনগোষ্ঠী মুক্তির সাহসী দার্শনিক ও পথনির্দেশক হিসেবেই দৃঢ়চিত্তে সমাসীন করেছেন। এখানেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের যথার্থ সার্থকতা। স্বল্প পরিসরে বিশদ ব্যাখ্যার অবকাশ না থাকলেও এটুকু মননীয় সমীকরণ নির্ধারণ করা যায় যে, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক এবং প্রচীয়মান নেতৃত্বের কীর্তিতুল্য বিশ্বব্যাপী বঙ্গবন্ধুর বিকল্প শুধু বঙ্গবন্ধুই। ভারতের মুক্তিকামী মানুষের প্রগত প্রাণ সত্তাখ্যাত নেতাজী সুভাষ বসু বলেছিলেন, ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব।’ ১৯৭১ সালে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধুও দৃপ্তকণ্ঠে বলেছিলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, তবুও এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’ মৃত্যুদ-/ফাঁসিকে আলিঙ্গন করার পরিপূর্ণ মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও গণধর্ষণের শুরুতেই ২৬ মার্চ মধ্যরাতে ৭ মার্চ ঘোষিত স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করলেন এক অনবদ্য বার্তার মাধ্যমে- ÔThis may be my last message. From today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved.’ ১৯৭৫, ১৫ আগস্ট। যে পাকিস্তানী সেনারা বঙ্গবন্ধুকে সামান্যতম স্পর্শ করার সাহস করেনি, বিচারপতি মাহমুদ হোসেনের ভাষায় বিপথগামী ও উচ্চাভিলাষী বাঙালী সেনা সদস্যরা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কুখ্যাত ইয়াহিয়া খানের আদেশ বাস্তবায়ন করল ইতিহাসের বর্বর ও নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞ দিয়ে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে প্রাণে নিঃশেষ করার মাধ্যমে। কিন্তু ইতিহাস বড় কঠিন এবং সত্য প্রতিষ্ঠায় ইতিহাস বড় নির্মম। ইতিহাস বরাবরই সঠিক অবস্থানে সমুজ্জ্বল থাকে, এটিই ইতিহাসের শিক্ষা। মুজিববর্ষ উদযাপনের দিনক্ষণ গণনার সূচনাতে রবি ঠাকুরের ‘শিশুতীর্থ’ কবিতার কিছু পঙক্তি নিবেদন করতে চাই- ‘কেউ বা অলক্ষিতে পালিয়ে যেতে চায়, পারে না;/অপরাধের শৃঙ্খলে আপন বলির কাছে তারা বাঁধা।/পরস্পরকে তারা শুধায়, ‘কে আমাদের পথ দেখাবে।’/পূর্ব দেশের বৃদ্ধ বললে, ‘আমরা যাকে মেরেছি সেই দেখাবে।’/সবাই নিরুত্তর ও নতশির।/বৃদ্ধ আবার বললে, ‘সংশয়ে তাকে আমরা অস্বীকার করেছি,/ক্রোধে তাকে আমরা হনন করেছি,/প্রেমে এখন আমরা তাকে গ্রহণ করব,/কেননা, মৃত্যুর দ্বারা সে আমাদের সকলের জীবনের মধ্যে সঞ্জীবিত, সেই মহামৃত্যুঞ্জয়।’/সকলে দাঁড়িয়ে উঠল, কণ্ঠ মিলিয়ে গান করল, ‘জয় মৃত্যুঞ্জয়ের জয়।’ লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
×