শংকর কুমার দে ॥ গত ২০১৯ সালে ধর্ষণ বেড়েছে দ্বিগুণ। ২০১৯ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১ হাজার ৪১৩ জন নারী। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭৩২ জন। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে দ্বিগুণ যা ভয়াবহ। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এই পরিসংখ্যান দিয়ে বলেছে, ধর্ষণ বাড়ার ঘটনা ভয়াবহ। ধর্ষণের পর ধর্ষণকারী গ্রেফতার হচ্ছে, বিচারও হচ্ছে। তারপরও ধর্ষণ ঠেকানো যাচ্ছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রী রবিবার রাতে কুর্মিটোলায় বাস থেকে নামার পরপরই তাকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করার ঘটনায় ধর্ষণকারীকে শনাক্ত করে গ্রেফতারের জন্য কাজ করছে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার টিম। ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় বিচারের দাবিতে প্রতিবাদ, বিক্ষোভের মুখে আবারও ধর্ষণের ঘটনা সামনে চলে আসায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ধর্ষনণ তো বেড়েছেই। বেড়েছে নারীর প্রতি সহিংসতা ও নিষ্ঠুরতাও। কঠোর আইন, প্রচার ও উচ্চ আদালতের নানা নির্দেশনার পরও নারীর প্রতি সহিংসতা ও নিষ্ঠুরতা কমানো যাচ্ছে না। ধর্ষণের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। কিন্তু ধর্ষণকারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হচ্ছে না। কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না ধর্ষণ।
মানবাধিকার সংগঠন আসকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৮ সালের চেয়ে গত ২০১৯ সালের ধর্ষণ বেড়েছে দ্বিগুণ। ২০১৭ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮১৮ নারী। এদিকে ২০১৯ সালে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৬ জনকে। আর আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ১০ নারী। নারীর প্রতি সহিংসতার অন্য চিত্রগুলোও ভয়াবহ। ২০১৯ সালে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ২৫৮ জন নারী। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৭০ জন। ২০১৯ যৌন হয়রানির শিকার ১৮ জন নারী আত্মহত্যা করেছেন। প্রতিবাদ করতে গিয়ে চারজন নারীসহ ১৭ জন হত্যার শিকার হয়েছেন। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৪৪ পুরুষ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
বিদায়ী বছর ২০১৯ সালের মার্চ মাসে নরসিংদীর শিবপুরে বাসে তুলে দেয়ার কথা বলে মা-মেয়েকে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। পুলিশের কাছে মামলার বাদী এজাহারে উল্লেখ করেছেন, ঘটনার দিন বেলা তিনটার দিকে রাজধানীর সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে করে হবিগঞ্জে ফিরছিলেন তারা মা-মেয়ে। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের শিবপুরের সৃষ্টিগড় বাসস্ট্যান্ডের কাছাকাছি যাত্রীবাহী বাসটি বিকল হয়ে যায়। এ সময় স্থানীয় ছয়জন ব্যক্তি তাদের আরেকটি বাসে তুলে দেয়ার কথা বলে সামনের দিকে নিয়ে যান। একপর্যায়ে তারা মেয়েকে টেনে নিয়ে যান। মেয়েকে ফেরাতে মা দৌড়ে যান। এরপর স্থানীয় একটি পাটকলের পরিত্যক্ত ঘরের দুটি কক্ষে মা ও মেয়েকে ধর্ষণ করে ওই ছয় ব্যক্তি। মা-মেয়ের চিৎকারে আসামিরা পালিয়ে যান। ছয়জনকে অভিযুক্ত করে মামলা দায়েরের পর দুই জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
এর আগের বছর ২০১৮ সালে রূপা ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যা করে জঙ্গলে ফেলে রাখার ঘটনায়ও তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ময়মনসিংহের একটি প্রতিষ্ঠানে মার্কেটিং বিভাগে কাজ করতেন রূপা, পাশাপাশি পড়তেন একটি ল’ কলেজে। বগুড়ায় শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ২০১৮ সালের ২৫ আগস্ট বাসে ময়মনসিংহ ফিরছিলেন তিনি। পরে তার মৃতদেহ পাওয়া যায় মধুপুর এলাকার জঙ্গলে। মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই সেই ঘটনার বিচার হয়েছে ওই ধর্ষণ ও হত্যাকা-ের ঘটনায়। ঘটনার পরপরই বাসটির চালক হেলপারসহ ৫ জনকে আটক করে মামলা দায়ের করে পুলিশ। টাঙ্গাইলের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ধর্ষণ ও হত্যাকা-ের ঘটনার ১৭৩ দিনের মধ্যে মাত্র ১৪ কর্মদিবসেই সব কার্যক্রম শেষ করে চাঞ্চল্যকর এ মামলার রায় দেয় আদালত। পাঁচ আসামির মধ্যে ৪ জনের মৃত্যুদ- আর একজনের সাত বছরের কারাদণ্ড দিয়ে তাকে এক লাখ জরিমানা করেছে আদালত। এ টাকা এবং যে বাসে ঘটনাটি ঘটেছে সে বাসটি আদালতের আয়ত্তে নিয়ে রূপার পরিবারকে দেয়ার নির্দেশও দেয় আদালত। মাত্র ১৪ কর্মদিবসে মামলাটি নিষ্পত্তি করে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এ ট্রাইব্যুনাল। রূপাকে ধর্ষণ-হত্যার ঘটনাও একইভাবে আলোড়িত করে বাংলাদেশের মানুষকে।
ঢাকায় চলন্ত মাইক্রোবাসে গারো তরুণীকে গণধর্ষণের ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয় ২০১৫ সালের মে মাসে। কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফেরার পথে গণধর্ষণের শিকার হলেন ২২ বছর বয়সী গারো জাতিগোষ্ঠীর এক তরুণী। রাজধানীর ভাটারা থানার কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কর্মী ওই তরুণী রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ তার উত্তরার বাসায় যাওয়ার জন্য রাস্তার পাশে বাসের অপেক্ষায় ছিলেন। ওই সময় সেখানে হঠাৎ একটি মাইক্রোবাস এসে দাঁড়ায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দরজা খুলে দু’জন যুবক নেমে এসে মেয়েটিকে মাইক্রোবাসে তুলে নেয়। প্রথমেই গামছা দিয়ে তার চোখ-মুখ বেঁধে ফেলা হয়। তারপর চলে পালাক্রমে ধর্ষণ। এরপর ওই তরুণীকে উত্তরায় তার বাসার কাছাকাছি ফেলে রেখে পালিয়ে যায় ধর্ষকরা। এ ঘটনায় অজ্ঞাতনামা পাঁচজনের বিরুদ্ধে ভাটারা থানায় মামলা দায়ের করেছেন ধর্ষিতা তরুণী। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন তিনি। ধর্ষিত এ তরুণীর গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলায়। ধর্ষিতার তরুণীর জবানবন্দীতে জানা যায়, মাইক্রোবাসের চালক বাদে তিন যুবক তাকে ধর্ষণ করেছে। ওই সময় তার চোখ-মুখ বাঁধা থাকায় তিনি কাউকে চিনতে পারেননি। তিনি আরও জানান, তিনি উত্তরার জসিমউদ্দিন রোডের দলিপাড়ায় পরিবারের সঙ্গে থাকেন। রাতে কর্মস্থল থেকে বের হয়ে বাসায় যাওয়ার জন্য কুড়িল বিশ্বরোডে সিনহা সিএনজি মোটর্সের সামনে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এ সময় ওই মাইক্রোবাসটি এসে তার সামনে থামে। দুজন যুবক নেমে এসে তাকে জোর করে গাড়িতে তুলে নেয়। পরে গামছা দিয়ে তার পুরো মুখ বেঁধে ফেলে। চলন্ত গাড়িতে তিন যুবক তাকে ধর্ষণ করে। এ সময় তিনি বাধা দেয়ার চেষ্টা চালান। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে যুবকদের একজন তাকে এই বলে শাসায় যে, বেশি ধস্তাধস্তি করলে তাকে মেরে ফেলা হবে। ধর্ষণের পর যুবকরা তার কাছ থেকে বাসার এলাকা জেনে নিয়ে রাত পৌনে ১১টার দিকে তাকে সেখানে ফেলে রেখে চলে যায়। যাওয়ার সময় হুমকি দিয়ে যায়, এ ঘটনা নিয়ে যাতে থানা-পুলিশ যেন না করে। ওই ঘটনায় ২২ বছর বয়সী এ তরুণী অজ্ঞাতনামা পাঁচজনের বিরুদ্ধে তাকে ধর্ষণের অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করেন। এরপর ধর্ষণকারীদের গ্রেফতার করে পুলিশ।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিচারহীনতাকেই দায়ী করেন। ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সহিংসতার যেসব ঘটনা ঘটে তার একটি অংশ জানা যায় না। এ বিষয়ে কোন মামলা হয় না। আর যেগুলোর মামলা হয় বিশেষ করে ধর্ষণের ক্ষেত্রে সেখানে শতকরা মাত্র তিন ভাগ ঘটনায় শেষ পর্যন্ত অপরাধী শাস্তি পায়। আর ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনায় শাস্তি হয় মাত্র শূন্য দশমিক তিন ভাগ। তাহলে বোঝা যাচ্ছে এ ধরনের কোন ঘটনায় বিচার হয় না। যারা ধর্ষক তারা ধর্ষণের শিকার নারীর চেয়ে শক্তিশালী। অন্যদিক বাদ দিলেও লৈঙ্গিকভাবে পুরুষ শক্তিশালী।