ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সিডনির মেলব্যাগ ॥ অস্ট্রেলিয়ায় দাবানল, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৯:০৭, ৭ জানুয়ারি ২০২০

সিডনির মেলব্যাগ ॥ অস্ট্রেলিয়ায় দাবানল, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

শেখ হাসিনা জাতিকে এমন এক জায়গায় পৌঁছে দিয়েছেন, যা একসময় ছিল অধরা। বিএনপি-জামায়াত ও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দেশকে নব্য পাকিস্তান করার শেষ পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাল ধরে বাংলাদেশকে আজ এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, যা অভাবনীয়। নতুন বছরে সিডনি যখন দাবানলে পুড়ছে, তখন এটা বুঝতে পারি কাকে বলে বলিষ্ঠ নেতা! সমস্যাপীড়িত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যা পারেন, এসব উন্নত দেশের পিএমরা তা পারেন না। দাবানল নেভানোর শক্তি কতটা! তাও বোঝা হয়ে গিয়েছে। এসব বিবেচনায় শেখ হাসিনার বাংলাদেশ নতুন বছরে অনেক এগিয়ে। অভিভাবকরা বলেন, যায় দিন ভাল যায়। আগত দিন কেমন হবে সেটাই ভাবনার বিষয়। তখন না বুঝলেও এখন এর অর্থ বুঝি। অনাগত ভবিষ্যত বিষয়ে দুশ্চিন্তা আর অতীত হজম করার কথা বলা হয়েছে। ২০১৯ এ আমি বাংলাদেশ ঘুরে এসেছি। আমার দেখা ভুল না হলে মানুষ রাজনীতি নিয়ে তেমন মাথা ঘামায় না। বৈশ্বিক আর দেশের যাবতীয় সুখ-সুবিধা ভোগের কারণে তাদের মগজে এখন অন্য ধরনের চিন্তা। জীবনের মান বেড়েছে। কিভাবে জানি না, একশ্রেণীর মানুষের হাতে অঢেল টাকা। এক কাপ কফি বা এক বাটি স্যুপের দামও অনেক। তাতে কি? মানুষ খাচ্ছে। দেদার বিক্রি হচ্ছে। চট্টগ্রামে, ঢাকায় বড় বড় দোকানে জিনিস উপচে পড়ছে। আমার মনে আছে যৌবনে কলকাতা থেকে ফিরে মন খারাপ হতো। তাদের ফলের দোকানগুলোতে উপচে পড়া থোকা থোকা আঙ্গুর, ঝুরির ভেতর আপেল-কমলা। আর আমাদের কি করুণ দশা। এমনও মনে হতো পুষ্টির কারণে দরকার হলেও পাব না কোথাও। সে সময় কলকাতায় এক কেজি আঙ্গুর ছিল দশ টাকা। আর আমাদের এখানে এক শ’ টাকা। আর আজ? পুরো চিত্রই পাল্টে গেছে। আজ আমাদের দোকানে উপচে পড়া ফল, সবজি এমনকি স্ট্রবেরির মতো বিদেশী ফলেও ছেয়ে গেছে দেশের বাজার। তাও আবার দেশেই উৎপাদিত। খাদ্যে আমাদের যে পরিপূর্ণতা, তা আশা ও আনন্দের। কিন্তু দুটো বিষয়ে উন্নতি হয়নি। অগ্রগতি ও উন্নতি কিন্তু এক বিষয় নয়। সড়কমন্ত্রী মুখে যাই বলুন যানবাহন দুর্ঘটনা কমেনি। আগের চেয়ে কমেছে বলে আত্মসন্তুষ্টির জায়গা দেখি না। ভয়াবহ যানজটে প্রায় অচল ঢাকা। বনানী থেকে প্রেসক্লাব যাওয়ার পথে যেখানেই জ্যামে পড়েছি অসহায়ভাবে দেখি, সামনে-পেছনে হাজার গাড়ির ভিড়। পাশেই মেট্রোরেলের কাজ হচ্ছে বলে কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। আতঙ্ক থেকেই প্রশ্ন করেছিলাম, কারও যদি শরীর খারাপ হয় বা বেরুতে না পারে, প্রাণ সংশয় হয়, তো কি হবে? ড্রাইভার যেমন দ্বিধাহীনভাবে বললেন, কি আর হবে স্যার? মারা যাব। তেমনি আমার ঘনিষ্ঠজন যিনি ডাক্তার, তিনিও একই রায় দিলেন, কি আর করা, মরতে হবে। এই অবস্থা থেকে দেশকে মুক্ত করা সহজ কাজ নয়। তবে এটিই বাস্তবতা। আরও একটি বিষয় হলো উত্তেজনা। নানা কারণে, এমনকি বিনা কারণেও মানুষকে উত্তেজিত হতে দেখেছি। নরম শিল্প-সাহিত্য থেকে কঠিন রাজনীতি সব বিষয়ে মানুষ তপ্ত। যে কয়টা ঘটনা সামাজিক মাধ্যম ও দেশ তোলপাড় করে দিয়ে গেছে, তার একটি নির্বাচনোত্তর বাংলাদেশ। যদিও নির্বাচন হয়েছে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের শেষে। কিন্তু তার ফল নিয়ে মানুষের মতামত আর তর্ক-বিতর্ক চলছে সারা বছর ধরে। প্রায় সব মানুষই এই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ মনে করে। তবে শেখ হাসিনার প্রতি আস্থা আর ভালবাসা যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি। তাঁর জনপ্রিয়তা গগনচুম্বী। কিন্তু প্রশ্ন থাকছে নির্বাচন কমিশন নিয়ে। যারা মনে করেন সঠিকভাবে ভোট হলেও আওয়ামী লীগই আসত, তারাও তেমন সন্তুষ্ট নয়। এই ঘটনাটি বছরের প্রথম থেকে শেষ অবধি তুষের আগুনের মতো ধিক ধিক জ্বলছে। গত বছরে আমরা যাদের হারিয়েছি, তাদের শূন্যস্থান পূরণ হওয়ার মতো নয়। তাদের মধ্যে আমি কয়েকজনের কথা অবশ্যই মনে করব। বছরের শুরুতেই হারিয়েছিলাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফকে। মাটির মানুষ এই নেতা কি পরিমাণ জনপ্রিয় ছিলেন, তা তাঁর মৃত্যুর পরই বোঝা গিয়েছিল। যে পরিমাণ মানুষের ঢল নেমেছিল, তা এখন বা অতীতের রেকর্ড। ভবিষ্যতেও সে রেকর্ড ভাঙা সহজ হবে না। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুবাদে এ কথা বলতে পারি, তিনি আওয়ামী লীগের স্মরণকালের এক কিংবদন্তিতুল্য নেতা। তাঁর বলে যাওয়া কথা, আওয়ামী লীগ একটি অনুভূতির নাম এখন প্রবাদ। গত বছর দেশের রাজনীতির ‘বিস্ময়বালক’ এরশাদ সাহেবও ইন্তেকাল করেন। মুখে, কলমে স্বৈরাচার-একনায়ক যাই বলি না কেন, মানতে হবে তিনিই মূলত কারিশম্যাটিক লিডার। ১৯৯১ সালে সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, কেউ তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলানো দূরে থাক, মারতেও পারবে না। নব্বই বছরের দীর্ঘ জীবনে সেটাই প্রমাণ করেছেন তিনি। সরকার থেকে বিদায়ের পর দশকের পর দশক টিকে থাকা আর সকালে-বিকেলে মত বদলানো, নিজেকে গুলি করে হত্যা করার ভয় দেখিয়ে হাসপাতাল থেকে সোজা গল্ফ খেলতে যাওয়া নেতা বা সামরিক শাসক আর একজনও নেই। এমনকি পরিবার, সন্তান এমন সব স্পর্শকাতর বিষয়েও তিনি ছিলেন রহস্যময়। তাঁর মৃত্যুর ঘটনাটি নিঃসন্দেহে বছরের বড় ঘটনা। এরপর স্মরণ করব অজয় রায়কে। তাঁর মৃত্যু বার্ধক্যজনিত কারণে। তাঁর পুত্রের নির্মম হত্যাকা-ের বিচারহীনতা মানুষকে স্পর্শ করেছে ব্যাপক। সভ্য সমাজে এমন জঘন্য হত্যাকা- মানা কঠিন। তাঁর বুকের সাহস পুত্রকে বড় কাজে উৎসর্গ করার যে কথা বলে গেছেন, তা চিরকাল সাহস যোগাবে আমাদের। বছরের শেষে মারা গেলেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। কথায় বড় না হয়ে কাজে বড় হওয়া বিশ্ব বাঙালী। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থেকে রানী এলিজাবেথ যাঁর গুণ ও কর্মমুগ্ধ, সেই কর্মবীর ছিলেন দেশের তথা বিশ্বের বড় এনজিও ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা। এমন বাঙালী আমাদের দেশে বিরল। তবে নুসরাত জাহান রাফির মৃত্যুটি সব মৃত্যুকে ছাপিয়ে দেশ ও দেশের বাইরের বাংলাদেশীদের কাঁপিয়ে দিয়েছিল। এমন নির্মম-পৈশাচিক ঘটনা জাতিকে স্তম্ভিত করে দেয়। মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাতের হত্যাকা- ছিল বর্বরতম। তাকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মারা হয়। এ ঘটনা এও প্রমাণ করেছিল, আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কত অমানবিকতা ও নিষ্ঠুরতা! সরকারকে সাধুবাদ। তারা দেশের মানুষের মনোভাব বুঝতে পেরে বিচারকার্য সমাধা করে এবং অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া হয়। বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাবি, জবিতে আন্দোলন, কোটা আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে মুখর সামাজিক ও দেশজ মিডিয়া এটাও মনে করিয়ে দেয়, সমাজে শৃঙ্খলা ও শান্তি এখনও ধরা দেয়নি। এমন অনেক ঘটনাই আমাদের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে বার বার। লোভের সীমানা পেরুনো সমাজে বালিশ-চাদর থেকে ব্যাংক, বীমা প্রায় সব খাতে কোটি কোটি টাকা লোপাট আর দুর্নীতি ভয়ঙ্কর। এর ভেতর আছে কঠিন লালসা আর অপরাধের হাতছানি। সমাজ জানে না কোথায় থামতে হয়। সবকিছুর সীমা আছে। রাজনীতি ও সমাজে সব একমুখী বলে কোন্টা যে আসল আর কোন্টা নকল, কেউ নির্ণয় করতে পারছে না। তবু শেষ করা সেই বালকটির কথা দিয়ে। যখন ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে বহুতল একটি ভবন পুড়ে ছাই হচ্ছিল, তখন হাজার হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখার পাশাপাশি মোবাইলে সে সব ছবি তুলে ভিডিও করে আপলোড করায় ব্যস্ত। মনে আছে, তাদের যন্ত্রণায় ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি, এ্যাম্বুলেন্সও ঢুকতে পারছিল না। তখন একটি বালক পানির পাইপ চেপে ধরেছিল প্রাণপণে, ফুটোওয়ালা পাইপটা দিয়ে যেন পানি বেরিয়ে না যায়। এই বিস্ময় বালককে কেউ তা করতে বলেনি। সে নিজেই তা করে দেশ-বিদেশে খবরের শিরোনাম হয়েছিল। জানি না সে কোথায়, কেমন আছে? তবে সে ছেলেটিই আমাদের পজেটিভ বাংলাদেশ। তার মতো মানুষকে ঘিরেই বাঁচে দেশ, বেঁচে থাকি আমরা। যতদিন শেখ হাসিনা আছেন, বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা চলবেই। রাজাকার, দালাল ও বিএনপির ষড়যন্ত্র এ বছর নির্মূল হোক। দেশ এগিয়ে চলুক অভীষ্ট লক্ষ্যে। নতুন বছর শুভ হোক সবার জীবনে। [email protected]
×