ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ছন্দে মুস্তাফিজ, জাতীয় দলে কড়া নাড়ছেন মেহেদী হাসান রানা

জমে উঠেছে দুই বাঁহাতি পেসারের লড়াই

প্রকাশিত: ১০:২৩, ৬ জানুয়ারি ২০২০

 জমে উঠেছে দুই বাঁহাতি পেসারের লড়াই

মোঃ মামুন রশীদ ॥ গত বছর আন্তর্জাতিক টি২০ ক্রিকেটে দারুণ ব্যর্থতা দেখিয়েছেন বাঁহাতি পেসার মুস্তাফিজুর রহমান। ২০১৯ সালে ৭টি টি২০ ম্যাচ খেলে তিনি মাত্র ৪ উইকেট নিতে সক্ষম হন। যেভাবে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন এবং বাংলাদেশ দলের অপরিহার্য হয়ে উঠেছিলেন সেই মুস্তাফিজের এমন করুণ দশা অব্যাহত ছিল এবার বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগের (বিপিএল) শুরু থেকেই। তবে নিজেকে পুরনো ছন্দে ফিরে পেয়েছেন আবার এই কাটার মাস্টার। সর্বশেষ ৫ ম্যাচে ১০ উইকেট নিয়েছেন। সবমিলিয়ে ১০ ম্যাচে ১৬ উইকেট নিয়ে এখন উইকেট শিকারির তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে তিনি। তাকে টেক্কা দিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই শীর্ষে উদীয়মান আরেক বাঁহাতি পেসার মেহেদী হাসান রানা। প্রথম থেকেই চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের হয়ে আলো ছড়ানো এ পেসার ৮ ম্যাচেই ১৭ উইকেট নিয়ে আছেন এককভাবে শীর্ষে। শুরুতে তিনি দুর্দান্ত বোলিং করার পর জাতীয় দলের প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নু অবশ্য লম্বা সময় পরীক্ষা নিরীক্ষা করেই জাতীয় দলের জন্য বিবেচনা করার কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু মেহেদী রানা ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন। নিশ্চিতভাবেই কড়া নাড়ছেন জাতীয় দলের দরজায়। এমন নৈপুণ্যের পর তার জন্য জাতীয় দলের দুয়ার খুলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। দুই বাঁহাতির এ শীর্ষস্থান দখলের লড়াইটা উপভোগ করছেন মেহেদী নিজেও। বঙ্গবন্ধু বিপিএলে এবার শুরু থেকেই পেসাররা দুর্দান্ত পারফর্মেন্স করে যাচ্ছেন। তবে বিশেষভাবে সবার নজর কেড়ে আলোচনায় এসেছেন তিন তরুণ পেসার মেহেদী হাসান রানা, হাসান মাহমুদ ও মুকিদুল ইসলাম মুগ্ধ। এদের মধ্যে সবচেয়ে সফল হয়েছেন দুর্দান্ত বোলিং করে যাওয়া মেহেদী রানা। আর গতির দিক থেকে এগিয়ে ঢাকা প্লাটুনের ডানহাতি পেসার হাসান। লাইন-লেন্থে মুকিদুলও মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন। বঙ্গবন্ধু বিপিএলে এখন সর্বত্রই তাদের নিয়ে আলোচনা। তবে মাত্র কয়েকটি ম্যাচ দেখেই এই তরুণদের বিবেচনা করতে চাননি জাতীয় দলের প্রধান নির্বাচক নান্নু। কারণ অতীতে এমন সুযোগ দেয়ার পর ভাল পারফর্মাররা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পারেননি। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে ২০১৫ বিপিএলে তরুণ ডানহাতি পেসার আবু হায়দার রনির কথা। তিনি সেই বিপিএলে ১২ ম্যাচে ২১ উইকেট নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন রনি। সেই সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে জাতীয় দলে প্রায় নিয়মিত সদস্য হয়ে যান তিনি। কিন্তু ১৩ টি২০ খেলে মাত্র ৬ উইকেট এবং ২ ওয়ানডে খেলে ৩ উইকেট নিয়ে সেভাবে প্রমাণ করতে পারেননি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। আপাতত তাই জাতীয় দলের হয়ে খেলার সুযোগটাই পাচ্ছেন না তিনি। এছাড়া তরুণ ক্রিকেটারদের মধ্যে নাজমুল হোসেন শান্তও বেশ কয়েকবার সুযোগ পেয়েও মেলে ধরতে পারেননি। এ কারণেই মেহেদী রানা, হাসান ও মুগ্ধ দুর্দান্ত বোলিং করলেও পুরনো অভিজ্ঞতার নিরিখে নান্নু বলেছিলেন, ‘একজন ক্রিকেটারের ঘরোয়া ক্রিকেটে ১৫ বছরের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য অন্তত ১০ বছরের একটা লক্ষ্য স্থির করতে হবে। সে যেন একবার দলে ঢুকলে দশ বছর দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। সুতরাং একটি দুটি ম্যাচ দেখে, একটি বল করে বা দুর্দান্ত ডেলিভারি দিয়ে একজন ক্রিকেটারকে বিবেচনা করা যায় না। দুই-তিন বছর স্বাধীনভাবে খেলতে দেন, আপনি এমনিই বুঝতে পারবেন কে আসছে না কে বাদ পড়ছে।’ এ বছর বাংলাদেশ দল দারুণ ব্যস্ত থাকবে মূলত টি২০ ক্রিকেট ও টেস্ট নিয়ে। সবমিলিয়ে প্রায় ২৫ টি২০ ও ৯ টেস্ট আছে চলতি বছর। এর অধিকাংশই হবে এমন কন্ডিশনে যেখানে পেসারদেরই সহায়ক উইকেট থাকবে। টি২০ ফরমেটে এশিয়া কাপ ও বিশ্বকাপ আছে। তাই ভালমানের বেশ কয়েকজন পেসারকে রাখতে হবে ব্যাকআপ হিসেবে। এবার বঙ্গবন্ধু বিপিএল তাই অন্য যে কোন আসরের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নতুন কাউকে খুঁজে নেয়ার জন্য। সেদিক থেকে ইতোমধ্যেই নিজেকে দারুণভাবে প্রমাণ করেছেন মেহেদী রানা। বাংলাদেশ দলে দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষা শেষে বাঁহাতি পেসার হিসেবে মুস্তাফিজকে পাওয়া গেছে। ২০১৫ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত টানা অপরিহার্য হিসেবে নিজেকে প্রমাণও করেছেন তিনি। বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তুলেছেন ভয়ঙ্কর সব স্লোয়ার ও কাটার ডেলিভারির জন্য। স্লগ ওভারগুলোয় মুস্তাফিজ হয়ে ওঠেন অন্যতম নির্ভরতার নাম। কারণ ২০১৮ পর্যন্ত ৩০টি আন্তর্জাতিক টি২০ ম্যাচে তিনি ১১০.৩ ওভার বোলিং করে ৭.৬৭ ইকোনমিতে মাত্র ৮৪৮ রান দিয়েই শিকার করেন ৪৮ উইকেট। গড় ছিল ১৭.৬৭, স্ট্রাইকরেট ১৩.৮১। তবে গত বছর থেকে যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলেন ইনজুরি থেকে ফিরে আসা মুস্তাফিজ। গত বছর তিনি ৭ টি২০ খেলে ২৪.৪ ওভারেই ২১৭ রান দিয়েছেন, সাকুল্যে শিকার মাত্র ৪ উইকেট। ইকোনমি ৮.৭৯, গড় ৫৪.২৫ এবং স্ট্রাইকরেট ৩৭। নিজেকে ফেরাতে এবার বঙ্গবন্ধু বিপিএলকে মঞ্চ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন মুস্তাফিজ। নির্বাচক, কোচসহ সবারই নজর ছিল তার দিকে। কিন্তু প্রথম ৫ ম্যাচে বেদম পিটুনি হজম করে মাত্র ৬ উইকেট নিতে সক্ষম হন তিনি। অথচ তারই বন্ধু মেহেদী রানা এই সময়ে চমকে দিয়েছেন সবাইকে। মুস্তাফিজের বয়স ২৪, মেহেদীর ২৩, দু’জনই বাঁহাতি এবং উচ্চতা সমান ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি। দু’জনের আশ্চর্য এই মিল থাকলেও মাঠের পারফর্মেন্সে মুস্তাফিজকে পেছনে ফেলেন মেহেদী। চলতি আসরের প্রথম ৫ ম্যাচেই ১৩ উইকেট নিয়ে শীর্ষ বোলার হয়ে ওঠেন। সেই পারফর্মেন্স ধরেই রেখেছেন তিনি। পরবর্তী ৩ ম্যাচে মাত্র ৪ উইকেট নিতে পারলেও ব্যাটসম্যানদের নাজেহাল ঠিকই করে গেছেন। বন্ধু মেহেদীর এমন আলোড়ন তোলা বোলিংয়ের পর মুস্তাফিজও জ্বলে ওঠেন। পরবর্তী ৫ ম্যাচে তিনি ১০ উইকেট শিকার করেন, ধারাবাহিক আলগা বোলিংয়ের পরিস্থিতিরও ব্যাপক উন্নতি ঘটে। পুরনো মুস্তাফিজকেই সর্বশেষ ৫ ম্যাচে দেখেছেন সবাই। এখন ১০ ম্যাচে ৬.৭৬ ইকোনমিতে ১৬ উইকেট নিয়ে তিনি মেহেদীর ঠিক পেছনেই। ইকোনমিতে বন্ধু মেহেদীর (৬.৯৬ ইকোনমি) চেয়ে এখন ভাল অবস্থানে মুস্তাফিজ। উইকেট সংখ্যায়ও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু আবার মেহেদী সর্বশেষ ম্যাচে ৩ উইকেট নিয়ে মুস্তাফিজকে পেছনে ফেলেছেন। মুস্তাফিজ ১০ ম্যাচ খেলে যেখানে ১৬ উইকেট, মেহেদীর সেখানে ৮ ম্যাচে ১৭ উইকেট। দুই বাঁহাতি পেসারের এই লড়াইটা দারুণভাবেই জমে উঠেছে। এমন ধারাবাহিক নৈপুণ্যের পর নিশ্চিতভাবেই মেহেদী জাতীয় দলের দরজায় জোরালোভাবে করাঘাত করছেন। মুস্তাফিজের সঙ্গে লড়াইটাও উপভোগ করছেন। কিন্তু তিনি নিজেই বলেছেন, ‘একেকটা ম্যাচ ধরে কিভাবে ভাল করা যায় সেটাই শুধু ভাবি। বোলিংয়ের সময় কয়টা উইকেট হলো, তা আমি মাথায় আনি না। তবে ব্যাপারটা উপভোগ করছি। ম্যাচ বাই ম্যাচ যেহেতু উন্নতি করছি। ভাল বোলিং করছি, দেশের ক্রিকেটে ভাল ভবিষ্যত আছে বলে মনে করি।’ সেই ভবিষ্যতটা হয়তো জাতীয় দলের নির্বাচক, কোচরাও মেহেদী রানার মধ্যে দেখতে শুরু করেছেন। হয়তো অচিরেই দেখা যাবে জাতীয় দলের জার্সিতে মুস্তাফিজ-মেহেদীর বাঁহাতি পেস আক্রমণ।
×