ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

তিন মাসেও পেঁয়াজের দামের রশি টেনে ধরা গেল না কেন?

প্রকাশিত: ১০:১৪, ৬ জানুয়ারি ২০২০

  তিন মাসেও পেঁয়াজের  দামের রশি টেনে ধরা গেল না  কেন?

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ বাজারে পেঁয়াজের কোন ঘাটতি নেই। প্রতিটি আড়তে বস্তা বস্তা পেঁয়াজের সারিবদ্ধ লাইন। আমদানির পেঁয়াজও নিয়মিত আসছে। এরপরও পেঁয়াজের বাজারমূল্য এখনও অস্বাভাবিক পর্যায়ে রয়েছে। শুধু তাই নয়, গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার পেঁয়াজের পাইকারি বাজারমূল্য আবারও ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। সে পেঁয়াজ আবার রবিবার কমে গেছে। আজ সোমবার আরও কমতে পারে বলে বাজার সূত্রে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। পেঁয়াজের এ অস্বাভাবিক মূল্য বিরাজমান থাকার পাশাপাশি এরমধ্যে আবার বাজারদর ওঠানামার নেপথ্যের ঘটনা নিয়ে ব্যবসায়ীদের কোন আকার ইঙ্গিত পর্যন্ত নেই। আকাশ পথে শুধু একবারই পেঁয়াজের চালান এলো। এরপর কেন থেমে গেল। কয়েকটি শিল্প গ্রুপ বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করে কমমূল্যে বিক্রি করে বাজারকে স্থিতিশীল করার সরকারী যে প্রয়াস তার সবই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। টিসিবির মাধ্যমে কেজি প্রতি ৪৫ টাকা পেঁয়াজ বিক্রি চললেও তা ক্রেতা মহলে তেমন কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। কেননা, দীর্ঘ সময় লাইন ধরে পেঁয়াজ সংগ্রহের ধৈর্য অনেকের নেই। এর ফলে যারা নেয়ার নিয়েছে। এছাড়া টিসিবিও বিক্রি করেছে ইচ্ছামত সময় ও স্থান নিয়ে। ফলে গত তিন মাসের অধিক সময়ের পর পেঁয়াজের বাজার মূল্যের লাগাম টেনে ধরা গেল না। এরই মাঝে দেশীয় পেঁয়াজ বাজারে আসলে তাতেও কোন লাভ হয়নি। এতে করে চাষীরা অবশ্য ভাল দাম পাচ্ছে। অর্থাৎ চাষীরা খুশি। ভোক্তাদের মনে বেজার মনোভাব। মাঝপথে সরকার পক্ষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বা অন্য সংস্থাগুলো এ পর্যন্ত যত উদ্যোগ বা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তার কোন কার্যকর সুফল মেলেনি। দেশীয় বাজারে পেঁয়াজের মূল্য না কমায় বড় বড় কিছু আমদানিকারক এ সুযোগে বিদেশ থেকে পেঁয়াজ এনে ভাল ফায়দা হাসিল করে নিয়েছে বলে বাজার চাউর হয়ে আছে। কারা কিভাবে এ সুযোগ নিয়েছে এ বিষয়ে তদন্তের দাবিও উঠেছে। তবে এ কথা সত্য যে, বাজারে প্রশাসনের পক্ষে হানা দিলে বিপদ ভারি হয়ে যায়। পেঁয়াজের বাজার সাম্প্রতিক সময়ে অস্থিতিশীল হয়ে প্রশাসনের নির্দেশে ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে যা কিছু করা হয়েছে সবই বুমেরাং হয়ে ঠেকেছে। এর ফলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার দুদিন পেঁয়াজের বাজার ব্যাপকভাবে বাড়তি অবস্থানে চলে গেলেও আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, রবিবার দেশের বৃহত্তম পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজের আড়তগুলোতে তেমন কোন ক্রেতা সমাগম ঘটেনি বলে জানিয়েছেন খাতুনগঞ্জের পেঁয়াজের বড় পাইকারি বাজার হামিদউল্লাহ মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোঃ ইদ্রিস। তিনি অভিযোগ করেন, বড় বড় কয়েকটি শিল্প গ্রুপ পেঁয়াজ আনার কথা চাউর করে কি ঘটনা ঘটাল তাও প্রশাসনের ভেবে দেখা উচিত। একটি শিল্প গ্রুপের পেঁয়াজ আকাশ পথে শুধু এক চালান এসেছে বলে শোনা গেছে। এরপর আর কোন চালান আসার খবর তাদের কাছে নেই। এছাড়া ঢাকা ও চট্টগ্রামের আরও তিনটি গ্রুপ পেঁয়াজ আনার ঘোষণা দিয়েছিল। তারা মূলত কি পরিমাণ পেঁয়াজ এনেছে এবং তা কিভাবে টিসিবির কাছে হস্তান্তর করেছে না পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি করে দিয়েছে এর কোন উত্তর তাদের কাছে মেলেনি। ইতোমধ্যে আরও দুটি শিল্প গ্রুপ ২ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করে আনার ঘোষণা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে গত বৃহস্পতি থেকে শুক্রবার পর্যন্ত পেঁয়াজের পাইকারি বাজারমূল্য আকাশচুম্বী হয়ে যায়। এ বাজার দর ভারতীয় পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের পর যে মাত্রায় উঠেছিল তার চেয়েও খানিক বেশি বাড়তি হয়। কিন্তু দুদিন পর অর্থাৎ রবিবার থেকে তা আবার কমে যায়। বাজার চিত্রে দেখা যায়, রবিবার মিয়ানমারের পেঁয়াজ পাইকারি পর্যায়ে কেজি প্রতি বিক্রি হয়েছে ১৫০ টাকা। চীনা পেঁয়াজ ৬০ টাকা, তুরস্কের পেঁয়াজ ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। তুরস্কের পেঁয়াজ ৮০-৮৫ টাকা। হল্যান্ডের পেঁয়াজ ৮০-৮৫ টাকা। এছাড়া দেশীয় পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে কেজি প্রতি ১শ’ টাকা। অথচ, এ দেশীয় পেঁয়াজ গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার মণ প্রতি ৭ হাজার টাকায় উন্নীত হয়েছিল। রবিবার খাতুনগঞ্জের বাজারে মিয়ানমারের পেঁয়াজ এসেছে ১২ ট্রাক। সে পেঁয়াজ কেনার ক্রেতাও মেলেনি বলে জানানো হয়েছে বাজার সূত্রে। বন্দর সূত্রে জানা গেছে, বন্দরের বিভিন্ন জেটিতে প্রতিনিয়ত পেঁয়াজের ছোট ছোট চালান খালাস হচ্ছে। বন্দর থেকে শুধু খাতুনগঞ্জ নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে ট্রাকযোগে এ পেঁয়াজ পৌঁছে যাচ্ছে। কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয়টি হচ্ছে এ পেঁয়াজের মূল্য কোনভাবেই স্বাভাবিক পর্যায়ে আসছে না। অনেকের মতে, পেঁয়াজের উচ্চমূল্যের এ বাজার দর অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। দেশীয় পেঁয়াজ সম্পূর্ণভাবে মাঠ থেকে উঠে আসার পর কি পরিস্থিতি দাঁড়ায় তা অবশ্য দেখার বিষয়। তবে বাজার সূত্রে আরও ধারণা দেয়া হয়েছে, ভারতের পেঁয়াজের বাজার পরিস্থিতি দেশীয় বাজারকে অস্থিতিশীল করে রাখার ক্ষেত্রে অন্যতম একটি অনুষঙ্গ। এখনও ভারতীয় পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ রয়েছে। তাই পেঁয়াজের বাজারও উচ্চমূল্যে রয়েছে। আর যখনই ভারতীয় পেঁয়াজের রফতানি উন্মুক্ত করা হবে পরদিনই দেশীয় পেঁয়াজের বাজার পূর্বেকার অবস্থায় চলে আসবে নিমিষেই। এ বিষয়টি ম্যাজিকের মতো কাজ করবে বলে খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের ধারণা। তবে ভারতে গত মৌসুমে পেঁয়াজের উৎপাদন বিভিন্ন কারণে ভাল হয়নি বিধায় সে দেশের সরকার আগে ভাগেই তা আঁচ করতে পেরে গত ২৯ সেপ্টেম্বর পেঁয়াজ রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এতে করে শুধু বাংলাদেশ নয়, যেসব দেশ ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করে সর্বত্র পেঁয়াজের মূল্য একলাফে বেড়ে যায়। এ ঘটনায় বাজার সূত্রে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পেঁয়াজের চাহিদা বছরে ৩০ থেকে ৩২ লাখ মেট্রিক টন। এরমধ্যে ১৮ থেকে ২০ লাখ টন দেশীয় উৎপাদন থেকে আসে। অবশিষ্ট চাহিদার পেঁয়াজ বিদেশ থেকে আমদানি হয়ে আসে। তার মধ্যে বড় অংশটি আসে ভারত থেকে। এছাড়া মিয়ানমারও বাংলাদেশের জন্য অন্যতম পেঁয়াজ রফতানিকারক। এসব ছাড়াও তুরস্ক, মিসর, চীন এমনকি হল্যান্ড থেকে পেঁয়াজ যে আসে তার প্রমাণ এবার দেখা গেছে। এরপরও দেশে পেঁয়াজের বাজারমূল্য এত অস্বাভাবিক পর্যায়ে কেন উঠানামায় থাকছে তা একটি বড় ধরনের প্রশ্নবোধক হয়ে আছে।
×