ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

’১৯ সাল চাষীর জন্য ছিল ভাল বছর ॥ কৃষিমন্ত্রী

কৃষিতে কমেছে সারের দাম, বেড়েছে প্রণোদনা

প্রকাশিত: ১০:১১, ৬ জানুয়ারি ২০২০

  কৃষিতে কমেছে সারের দাম, বেড়েছে প্রণোদনা

ওয়াজেদ হীরা ॥ সরকারের অর্জন ও পরিকল্পনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভাল বছরই পার করেছে কৃষি সেক্টর। সরকারের দেয়া সুবিধার কারণে কৃষকের জন্যও ছিল ভাল প্রাপ্তি। কৃষি প্রণোদনা, ডিএপি সারের দাম কমানো, এ্যাপভিত্তিক অনেক কৃষিসেবা চালু করেছে সরকার। এছাড়াও বোরো মৌসুমে কৃষকের ধানের মূল্যের কষ্ট কিছুটা হলেও দূর করেছে আমনের দাম। সব মিলিয়ে কৃষি খাতে ভালই কেটেছে ’১৯ সাল। রোদে-বৃষ্টিতে পুড়ে ভিজে কৃষক ফসল ফলায়। সারাবছরই ব্যস্ত থাকে কোন না কোন চাষাবাদে। বছর শেষে কৃষি সালতামামিতে দেখা গেছে, এবার বোরো মৌসুমে ধানের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে কোথাও কোথাও খেতে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। তবে বছরের শেষে এসে ওই কৃষকদের মুখে এখন হাসির ঝিলিক। কেননা আমনের নিশ্চিত ফলনে ভাল দাম পেয়েছে চাষী। কৃষক এখন রবি ফসল নিয়ে ব্যস্ত। ’১৯ সালে কৃষির জন্য কেমন ছিল প্রশ্নের উত্তরে কৃষিমন্ত্রী ড. রাজ্জাক জনকণ্ঠকে বলেন, চাষীর জন্য বছরটি খুবই ভাল ছিল। বিশেষ করে সারের দাম কমার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ামী লীগ সরকার চাষীর কথা সব সময়ই ভাবে। কৃষি সচিব মোঃ নাসিরুজ্জামান বলেন, কৃষকদের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের জন্য বছরটি খুবই ভাল। কয়েকটি কথা উল্লেখ করে সচিব বলেন, ‘বুলবুল’ সামান্য ক্ষতি করেছিল ফসলের। এর আগে ‘ফণী’ নামে ঘূর্ণিঝড়েও মাঠে উল্লেখযোগ্য ফসল ছিল না। ফলে তেমন ক্ষতিও হয়নি ফসলের। শুধু আগাম বন্যা কুড়িগ্রাম গাইবান্ধায় কিছু বীজতলা নষ্ট হয়েছিল। আমরা বীজতলা তৈরি করে দিয়েছিলাম। সারের দাম কমার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ এতে ডিএডি সারের ব্যবহার বাড়বে আর ইউরিয়া টিএসপির ব্যবহার কমবে। এছাড়াও আমাদের কৃষি, কৃষকের বাজার, তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়টিও উল্লেখ করেন সচিব। কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ নীতিমালা হয়েছে সেটিও বিরাট উল্লেখযোগ্য। জানা গেছে, কৃষি উৎপাদন বাড়াতে নয়টি ফসল উৎপাদনে সারাদেশের ৬ লাখ ৮৬ হাজার ৭০০ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষককে ৮০ কোটি ৭৬ লাখ ৯১ হাজার ৮০০ টাকা প্রণোদনা দেয়া হয়। অক্টোবরে দেয়া এ প্রণোদনা সম্পর্কে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, কৃষককে প্রণোদনা হিসেবে চলতি রবি মৌসুমে গম, ভুট্টা, সরিষা, সূর্যমুখী, চীনাবাদাম, শীতকালীন মুগ, পেঁয়াজ ও পরবর্তী খরিপ-১ মৌসুমে গ্রীষ্মকালীন মুগ ও গ্রীষ্মকালীন তিল উৎপাদনে বীজ ও রাসায়নিক সার (ডিএপি ও এমওপি) দেয়া হয়। রবি মৌসুমে গম, ভুট্টা, সরিষা, সূর্যমুখী, চীনাবাদাম, শীতকালীন মুগ, পেঁয়াজ ও পরবর্তী খরিপ-১ মৌসুমে গ্রীষ্মকালীন মুগ ও গ্রীষ্মকালীন তিল উৎপাদন বৃদ্ধিতে ৬৪ জেলায় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের প্রণোদনার মাধ্যমে প্রতিটি কৃষক পরিবারকে সর্বোচ্চ এক বিঘা জমির জন্য বিনামূল্যে বীজ ও রাসায়নিক সার প্রণোদনা দেয়া হয়। এছাড়াও কৃষকের স্বার্থে ডিএপি (ডাই-এ্যামোনিয়াম ফসফেট) সারের দাম প্রতিকেজিতে ৯ টাকা কমানো হয়েছে, যা বিজয় দিবস থেকে (১৬ ডিসেম্বর) কার্যকর হয়েছে। কৃষক পর্যায়ে ডিএপি সারের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য হবে প্রতিকেজি ১৬ টাকা, যা আগে ছিল ২৫ টাকা। আর ডিলার পর্যায়ে প্রতিকেজি ২৩ টাকা থেকে কমিয়ে ১৪ টাকা করা হবে। বিজয় দিবসের উপহার হিসেবে ডিএপি সারের মূল্য হ্রাস করা হয়েছে। গত ৪ ডিসেম্বর সচিবালয়ে সারের মূল্য হ্রাসের বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক এ ঘোষণা দেন। কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, কৃষকবান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষকের জন্য উপহার অর্থাৎ হ্রাসকৃত মূল্যে ডিএপি সারের বিক্রি বিজয় দিবস থেকে কার্যকর হয়েছে। এর ফলে সুষম সার ব্যবহারে কৃষক অধিক ফলন পাবে। পরিবেশবান্ধব টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার হবে। ডিপিতে ফসফরাসের পাশাপাশি ক্যালসিয়াম ও নাইট্রোজেন যুক্ত থাকে, যা গাছের রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ ঠেকাই। ফুল ফল ও বীজে গুণগতমান বাড়ায়। ফলে এ সার প্রয়োগে একদিকে যেমন ইউরিয়া ও টিএসপি উভয় সারের সুফল পাওয়া যাবে আবার অর্থ ও শ্রম উভয়ের সাশ্রয় হবে। দেশে বছরে ৪ থেকে ৫ লাখ টন ডিএপি সারের চাহিদা রয়েছে। দাম কমানোর ফলে ডিএপি সারের ব্যবহার আরও বাড়বে। চলতি বছরেই কৃষি তথ্য সার্ভিসে নতুন প্রেস ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন এবং কৃষি যোগাযোগ ও তথ্য সেবা কেন্দ্র, এআইএস টিউব (ডিজিটাল আর্কাইভ) ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি উদ্বোধন করেন কৃষিমন্ত্রী ড. রাজ্জাক। মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ ও সংস্থা প্রধান ড. নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে এআইএস এখন আরও আধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তোলা হয়েছে, যা গণমাধ্যমের কাছে আরও তথ্যবহুল ও উপকারী সংস্থায় পরিণত হয়েছে। আবহাওয়ার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কোন ধরনের বালাই আক্রমণ করতে পারে সে বিষয়ে ঘরে বসেই তথ্য পেয়েছে কৃষক। ফসলের উৎপাদন কখন কী পর্যায়ে রয়েছে সে নির্দেশও চলে যাচ্ছে কৃষকের মোবাইল ফোনে। নির্দিষ্ট সময়ে সঠিক তথ্য পাওয়ায় বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পোকার আক্রমণ থেকে ফসলের ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি কমছে। এতে ফসলের উৎপাদনশীলতা ১৫ শতাংশ বেড়েছে। সরকারী-বেসরকারী কিছু কৃষিভিত্তিক মোবাইল এ্যাপস চালু রয়েছে। এসব এ্যাপের মাধ্যমে দেশে এ বছর প্রায় ৪০ লাখের বেশি কৃষক সরাসরি সেবা নিয়েছে। এছাড়া পরোক্ষে আরও কয়েক লাখ উপকৃত হয়েছে। কৃষিসেবা কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে কাজ করছে কৃষি বাতায়ন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক্সেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) কর্মসূচীর আওতায় ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের যৌথ উদ্যোগে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি চালু করা হয়। কৃষি বাতায়নে নিবন্ধিত যে কোন কৃষক ‘৩৩৩১’ নম্বরে ফোন করে তাদের সমস্যার কথা জানাতে পারছে। গ্রামের কৃষকদের তথ্যপ্রাপ্তি সহজ করতে কৃষি প্রযুুক্তি ভা-ার চালু করে কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বারি)। এ্যাপের মাধ্যমে উদ্ভাবিত ফসলের জাত ও উৎপাদন প্রযুক্তি, বিশেষ করে রোগবালাই, পোকামাকড় ও সার ব্যবস্থাপনাসহ যাবতীয় তথ্য পাওয়া যায়। তথ্য জানার জন্য প্রশ্ন করার সুযোগ আছে। প্রশ্ন করার পর সর্বোচ্চ ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে উত্তর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার, সমস্যা ও সমাধানের উপায় বিশেষ করে রোগ-পোকামাকড়ের ছবিসহ চিকিৎসাপত্র, সার, বীজ ও বালাইনাশকের তথ্যাবলী, উপজেলার শস্যবিন্যাস, ভেজাল সার শনাক্তকরণের ভিডিও চিত্র রয়েছে ‘কৃষক জানালা’ এ্যাপে। ছবি দেখে কৃষক নিজেই তার সমস্যা চিহ্নিত করতে পারে। চিহ্নিত ছবিতে ক্লিক করলেই সমস্যার সমাধানের ছবি ভেসে উঠবে। প্রতিটি সমস্যার একাধিক ছবি কমপক্ষে একটি প্রতিনিধিত্বপূর্ণ ছবি যুক্ত আছে। এর মাধ্যমে কৃষক সহজেই তার সমস্যা চিহ্নিত করে। ১২০ ফসলের এক হাজারের বেশি সমস্যার সমাধান দেয়া আছে। তবে কৃষির জন্য ’১৯ সালে কিছু কিছু দুর্যোগও এলেও কৃষিতে তেমন একটা ক্ষতির প্রভাব পড়েনি। গত নবেম্বরে ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ দেশের উপকূলীয় দক্ষিণাঞ্চলের জেলাসমূহের ওপর আঘাত হানে। আঘাতের ফলে উপকূলীয় ও পার্শ্ববর্তী ১৬ জেলার ১০৩ উপজেলায় এর প্রভাব পড়ে। আবাদকৃত ২০ লাখ ৮৩ হাজার ৮শ’ ৬৮ হেক্টর জমির মধ্যে ২ লাখ ৮৯ হাজার ০৬ হেক্টর (মোট আবাদকৃত জমির ১৪%) জমি আক্রান্ত হয়, যা কমই বলেছিলেন কর্মকর্তারা। এরপরও দ্রুত ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বিভিন্ন সহায়তা দেয় কৃষি মন্ত্রণালয় তথা মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা। সে সময় কৃষি মন্ত্রী জানান, দ্রুত যাতে কৃষকরা ক্ষতি কাটিয়ে উঠে সেজন্য যা করণীয় কৃষি মন্ত্রণালয় সবই করবে। এর আগে মে মাসে আসা ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’র আঘাতেও খুব একটা ক্ষয়ক্ষতি ছিল না কৃষিতে। মন্ত্রণালয়ে সে সময় সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয় ৩৮ কোটি ৫৪ লাখ দুই হাজার ৫০০ টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে। দেশের ৩৫ জেলার ৬৩ হাজার হেক্টর জমির বোরো, সবজি, ভুট্টা, পাট ও পান ফসলের আংশিক ক্ষতি হয়েছে। এ বছরই মন্ত্রণালয় কৃষি যান্ত্রিকীকরণ নীতিমালা তৈরি করেছে, যা কৃষিতে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে। মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ‘কৃষকের বাজার’ তৈরি করা হয়েছে যেখানে কৃষক নিজেই ‘বিষমুক্ত’ নিরাপদ সবজি বিক্রি করছেন। গত ডিসেম্বর মাসেই এ বাজার চালু করা হয়। ইতোমধ্যেই সাড়াও বেশ ভাল। ভবিষ্যতে এটি নিয়ে আরও সম্প্রসারণের চিন্তা রয়েছে। মন্দের চেয়ে ভালর বিচার বেশিতে সবভাবেই কৃষির জন্য ভাল ছিল ’১৯। আগামী বছরও যেন কৃষি কৃষকের জন্য কল্যাণ বয়ে আসে সে প্রত্যাশাই থাকবে।
×