ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

৪ কোটি টাকা দুর্নীতির মামলা

সিনহার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা

প্রকাশিত: ১০:০৯, ৬ জানুয়ারি ২০২০

সিনহার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা

ফরিদা ইয়াসমিন জেসি ॥ সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমান পদ্মা ব্যাংক) ৪ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির দুর্নীতি মামলায় পরোয়ানা জারি করেছে আদালত। রবিবার ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ কে এম ইমরুল কায়েশ এ পরোয়ানা জারি করে আগামী ১০ জানুয়ারি পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেছেন। দুদকের প্রসিকিউটর মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর বলেছেন, আসামিরা পলাতক থাকায় আদালত পরোয়ানা জারির আদেশ দিয়েছে। নানা নাটকীয় ঘটনার মধ্যে দুই বছর আগে সাবেক প্রধান বিচারপতি সিনহা বিদেশে পাড়ি জমানোর পর দুদক অভিযোগ পায়, তিনি ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ব্যবসায়ী পরিচয়ে দুই ব্যক্তির নেয়া ঋণের চার কোটি টাকা নিজের এ্যাকাউন্টে নিয়েছেন। অভিযোগ পেয়ে ওই বছরই তদন্তে নামে দুদক। দীর্ঘ তদন্তের পর গত বছরের ১০ জুলাই সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি সিনহা দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় অবস্থান করছেন। আসামিদের মধ্যে কেবল বাবুল চিশতী অন্য মামলায় কারাগারে আছেন। ঋণ জালিয়াতির এই মামলায় এখনও তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়নি বলে আদালত তার বিরুদ্ধেও পরোয়ানা জারির আদেশ দিয়েছে। রীতি অনুযায়ী তা এখন হাজতি পরোয়ানা হিসেবে গণ্য হবে। মামলার বিবরণে বলা হয়েছে, ’১৬ সালের ৬ নবেম্বর আসামি শাহজাহান ও নিরঞ্জন সাহা ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখায় আলাদা দু’টি এ্যাকাউন্ট খোলেন। ব্যবসা বাড়ানোর জন্য পরদিন তারা ওই ব্যাংক থেকে দুই কোটি করে মোট চার কোটি টাকা ঋণের আবেদন করেন। তাদের ব্যাংক এ্যাকাউন্ট ও ঋণের আবেদনে উত্তরার ১০ নম্বর সেক্টরের ১২ নম্বর রোডের ৫১ নম্বর বাড়ির ঠিকানা ব্যবহার করা হয়, যার মালিক ছিলেন তখনকার প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। ঋণের জামানত হিসেবে আসামি রণজিৎ চন্দ্রের স্ত্রী সান্ত্রী রায়ের নামে সাভারের ৩২ শতাংশ জমির কথা উল্লেখ করা হয় ঋণের আবেদনে। ওই দম্পতি এসকে সিনহার পূর্ব পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। দুদক বলছে, ব্যাংকটির তৎকালীন এমডি এ কে এম শামীম কোন ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই, ব্যাংকের নিয়ম-নীতি না মেনে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঋণ দুটি অনুমোদন করেন। দুদক কর্মকর্তা বেনজীর আহমেদ গত ৯ ডিসেম্বর এই ১১ জনকে আসামি করে ঋণ জালিয়াতির এ মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেন। তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনে এস কে সিনহার ব্যাংক হিসাবের চার কোটি টাকা জব্দ করা হয়। ১০ ডিসেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের পরিচালক বেনজীর আহমেদ আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশীট দাখিল করেন। চার্জশীটে বলা হয়, ফারমার্স ব্যাংকে শাহজাহান ও নিরঞ্জন সাহার নামে মঞ্জুরকৃত ঋণের ৪ কোটি টাকা সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সুপ্রীমকোর্ট সোনালী ব্যাংক শাখার হিসাবে জমা হয় (সঞ্চয়ী হিসাব নং : ৪৪৩৫৪৩৪০০৪৪৭৫) জমা হওয়ার পর ওই টাকা বিভিন্ন ভাবে স্থানান্তর করে উত্তোলন করা হয়। আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে অসৎ উদ্দেশ্যে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করে নিজেরা লাভবান ও অন্যদের লাভবান করতে এ ধরনের অপরাধ করেন। অবৈধভাবে ভুয়া ঋণ সৃষ্টির মাধ্যমে তারা ৪ কোটি টাকা বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করে নগদে উত্তোলন ও বিভিন্ন পে-অর্ডারের মাধ্যমে নিজ আত্মীয়র নামীয় হিসাবে হস্তান্তরের মাধ্যমে আত্মসাত করেন। পরে ওই অর্থ নিজেদের ভোগ দখলে রেখে তার অবৈধ প্রকৃতি, উৎস অবস্থান গোপন বা এর ছদ্মাবরণে পাচার করেছেন মর্মে তদন্তে প্রমাণিত হয়, যা দন্ডবিধির ৪০৯/৪২০/১০৯ ধারা ও ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা ও ২০১২ সালের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ৪(২)(৩) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পরোয়ানা জারি হওয়া অপর আসামিরা হলেন ফারমার্স ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক ও অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মোঃ মাহবুবুল হক চিশতী (বাবুল চিশতী), ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম শামীম, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সাবেক ক্রেডিট প্রধান গাজী সালাহউদ্দিন, ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বপন রায়, শাফিউদ্দিন আসকারী, ভাইস প্রেসিডেন্ট মোঃ লুৎফুল হক, টাঙ্গাইলের ব্যবসায়ী মোঃ শাহজাহান, একই এলাকার নিরঞ্জন সাহা, সান্ত্রী রায় ওরফে সিমি ও তার স্বামী রণজিৎ সাহা। আসামিদের মধ্যে বাবুল চিশতী ছাড়া অপর দশ জনই এহাজারের আসামি ছিলেন। তবে ব্যাংকটির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সাবেক শাখা ব্যবস্থাপক মোঃ জিয়াউদ্দিন আহমেদ এজাহারনামীয় আসামি ছিলেন। তিনি মামলা তদন্তাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করায় তাকে মামলার দায় হতে অব্যাহতি দেয়ার আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা। সেই অনুযায়ী আদালত তাকে অব্যাহতি দেয়। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় ও কিছু পর্যবেক্ষণের কারণে ক্ষমতাসীনদের তোপের মুখে ’১৭ সালের অক্টোবরের শুরুতে ছুটিতে যান তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। পরে বিদেশ থেকেই তিনি পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। তিনি বর্তমানে আছেন যুক্তরাষ্ট্র হয়ে কানাডায়। তবে দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে আসা বিচারপতি সিনহা গতবছর যুক্তরাষ্ট্রে বসেই একটি বই প্রকাশ করেন। তাতে তিনি দাবি করেন, তাকে পদত্যাগে বাধ্য করে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। বিচারপতি সিনহা ছুটি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থপাচার, আর্থিক অনিয়ম ও নৈতিক স্খলনসহ সুনির্দিষ্ট ১১ অভিযোগ পাওয়ার কথা সুপ্রীমকোর্টের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল।
×