ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

আমরা কি বিলুপ্তির দিকে চলেছি

প্রকাশিত: ০৯:১১, ৬ জানুয়ারি ২০২০

আমরা কি বিলুপ্তির দিকে চলেছি

মূল : সারা কাপলান, রূপান্তর : এনামুল হক পৃথিবীর ইতিহাসকে যদি ঘনীভূত করে ২৪ ঘণ্টার একটি দিবসের মধ্যে আনা যায় তাহলে দেখা যাবে প্রাণের উদ্ভব ঘটছে প্রভাতের কিছু আগে, আলোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার আবির্ভাব ঘটছে মাঝ সকালের দিকে এবং বায়ুমন্ডল অক্সিজেন সমৃদ্ধ হচ্ছে মধ্যাহ্নের ঠিক আগে। তবে দিবসের অধিকাংশ সময়টাই চরম একঘেয়ে। সমস্ত প্রাণই অতি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম। এদের কাজ গ্যাস উদগীরণ করা ও আঠাল পদার্থ বের করে দেয়া ছাড়া আর কিছু নয়। তখনও রাত নয়টা হয়নি। অর্থাৎ বর্তমান সময় থেকে প্রায় ৫০ কোটি বছর আগের কথা। এ সময়ই আমরা প্রথম জটিল, বহুকোষবিশিষ্ট প্রাণের আবির্ভাব দেখি। বিজ্ঞানীরা এই সময়টিকে ‘ক্যাম্ব্রিয়ান এক্সপ্লোশন’ নাম দিয়েছেন। এটা এমন এক সময় যখন শত শত কোটি বছরের ব্যাকটেরিয়ার জায়গায় দ্রুত বিবর্তনশীল প্রাণ স্থান করে নিয়েছে। প্রতিটি হাতি, প্রতিটি মাছি, প্রতিটি উভচর প্রাণী, কেঁচো এবং পৃথিবীর বুকে হেঁটে বেরিয়েছে, সাঁতরেছে, উড়েছে কিংবা দ্রুত ছুটে চলেছে এমন প্রতিটি জটিল প্রাণীর জন্য এই বিবর্তনগত বিস্ফোরণ দায়ী। ‘সেই সময়টাতে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত আছেন?’ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার ইয়োহো ন্যাশনাল পার্কে, বেঞ্জার আর্ডেল হাইনস। জুলাইয়ের এক সকাল। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। আমি হাইনসের সঙ্গে হাঁপাতে হাঁপাতে আরোহণ করে চলেছি কানাডার রকি পর্বতমালার ধার দিয়ে। আমাদের গন্তব্য একটা খাড়া পাহাড়ের সম্মুখভাগ। এটি বার্জেস শেল নামে পরিচিত ৫১ কোটি বছরের পুরনো মিশ্র শিলারাশি। ক্যাম্ব্রিয়ান যুগের মাঝামাঝি সময়ে গঠিত এই শেল পাথর ধারণ করে আছে জীবজন্তুর রাজত্বের ঊষালগ্ন থেকে নিখুঁতভাবে সংরক্ষিত হাজার হাজার জীবাশ্ম। এদের অনেকই ছিল কোমল অঙ্গের প্রাণী-অন্যান্য বেশিরভাগ স্থানে যাদের অস্তিত্ব কালের কষাঘাতে হারিয়ে গেছে। ছোট ছোট বিচিত্র নমুনার এই সম্পদ বিবর্তন সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের ধারণা দিতে সাহায্য করেছে এবং পৃথিবীর জলবায়ু ও প্রাণের মধ্যে যে একটা যোগসূত্র আছে সে সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি দান করেছে। বার্জেস শেল হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ ফসিল ক্ষেত্রগুলোর একটি। এই অসাধারণ রেকর্ডের অস্তিত্ব আছে শুধু এই কারণে যে পানির নিচে এক প্রলয়ঙ্করী ভূমিধসের ফলে এই প্রাণীগুলো পলল বা পলির প্লাবনে চাপা পড়ে গিয়েছিল। পললের বালি ছিল এত সূক্ষ্ম যে প্রাণীদের কান বা কানকোয় এবং পায়ের ভাঁজগুলোতে ভরে গিয়েছিল। ফলে সেগুলো আটকা পড়ে যায় এবং শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায়। সাগরের পানি ছিল তখন অতিমাত্রায় এলকালাইন যুক্ত। সেই সঙ্গে অক্সিজেনের তীব্র অভাব ছিল যার ফলে প্রাণীগুলোর নরম ও কোমল অংশগুলো পচে যায়নি। হাইনস বলেন, প্রাণীগুলোকে এমনভাবে মরতে হয়েছিল যার ফলে তারা জীবাশ্মের রূপ ধারণ করেছিল। ওই অবস্থাবলীকে লাখ লাখ বছর ধরে বিরাজ করতে হয়েছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, শিলারাশি সমুদ্রের তলদেশেই যদি ছিল তাহলে ভূপৃষ্ঠের ওপরে উঠে এলো কিভাবে? সেটা হয়েছিল টেকটোনিক্সের ক্রিয়ায়। তারপর এর ওপর দিয়ে হিমবাহের ধীর গতিতে গমনজনিত মৃদু ঘর্ষণে এর ভেতরকার ঐশ্বর্য উন্মোচিত হয়ে পড়েছিল। অবশেষে বনমানুষ গোত্রের এক উদ্যমী প্রজাতির বিবর্তনের মধ্য দিয়ে পর্যাপ্ত বুদ্ধিবৃত্তির অধিকারী হতে হয়েছিল যার বদৌলতে সে জীববিজ্ঞানের জগত আবিষ্কার করে, এই পর্বতে আরোহণ এবং তারা কি খুঁজে পেয়েছে তার তাৎপর্য অনুধাবন করে। হাইনস বলেন, ‘আমরা ভাগ্যবান নইকি।’ আমরা কষ্টসহকারে পাহাড়ের পথে চড়াই-উতরাই দিয়ে হেঁটে চলেছিলাম। হাইনস বলতে লাগলেন ৫০ কোটি বছর আগের দৃশ্যপট অবশ্যই এমন ছিল না। মহাদেশগুলো দুটো বিশাল স্থলভাগে মিশে ছিল। তবে বার্জেস শেলে যে জটিল প্রাণীগুলো দেখতে পাওয়া গেছে প্রোটাবোজোয়িক যুগের এক কোষী, মাইক্রবগুলোর বা সরল প্রাণের কিভাবে জটিল প্রাণে বিবর্তন ঘটল তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে বিতর্ক আছে। সম্ভবত এই বিবর্তনটা হয়েছিল জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে। পৃথিবী তখন তীব্র বরফ যুগ থেকে ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠছিল। অথবা বায়ুমন্ডলে অপেক্ষাকৃত বেশি মাত্রায় অক্সিজেন পাওয়া যাচ্ছিল। অন্যদের মত হচ্ছে, কিছু মৌলিক জৈবিক উদ্ভাবন ঘটে গিয়েছিল। যেমন দৃষ্টিশক্তির বিকাশ কিংবা শিকারি প্রাণীর আবির্ভাব। এ থেকে বিবর্তনগত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় যার পরিণতিতে আরও জটিল প্রাণীর উদ্ভব ঘটেছে। বার্জেস শেলের এক স্থানে পর্বতের ধারে ফুটবল মাঠের সমান সাইজের একটা কোয়ারি বা খনির মতো স্থান আছে সেখানে ধূসর ও বাদামি রঙের শেল পাথরের সø্যাস ছড়ানো ছিটানো। প্রায় প্রতিটি পথেরই প্রাচীন জীবজন্তুর অন্তত একটা খ-াংশ ধারণ করে আছে। হাইনস একটা ফসিল দেখালেন আনারসের একটা টুকরোর মতো দেখতে। এগুলো হলো এনোমালোকারিসের মুখের অংশবিশেষ। এনোমালোকারিস হচ্ছে ক্যাম্ব্রিয়ান সাগরের কুকুরের সাইজের অদ্ভুত ধরনের শিকারি প্রাণী। ওপাবিনিয়া নামে এক প্রাণীর প্রতিকৃতি দেখানো হলো। উদ্ভট প্রাণী। বিদঘুুটে পাঁচটা চোখ। ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের নোজলের মতো নাক। দানবাকৃতির হালুসিজেনিয়া যার আট জোড়া পা ও সমসংখ্যক মোচাকৃতির মেরুদ-। আছে মাছ, পাখি ও মানুষসহ সকল আধুনিক মেরুদন্ডী প্রাণীর পূর্বপুরুষ পিকাইয়া। এটি হচ্ছে শরীর মুচড়িয়ে চলা ঈল জাতীয় প্রাণী, যার আকার আপনার পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের চেয়ে বড় হবে না। ট্রাইলোবাইট নামে আজকের লালকাঁকড়ার দূর সম্পর্কের আত্মীয় আছে যার পাগুলো জোড়া লাগানো এবং দেখতে পাঁজরের হাড়ের মতো। এগুলো ৩০ কোটি বছর ধরে বেঁচেছিল। এই সময়ের মধ্যে মহাসাগরগুলো আস্তে আস্তে ভেসে ভেসে দূরে সরে গেছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার হ্রাসবৃদ্ধি ঘটেছে, কয়লা যুগের উদ্ভিদের আবির্ভাব ঘটেছে এবং মেরুদন্ডের উদ্ভব ঘটেছে। পরিশেষে যেটা তাদের সংহারের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তা হলো জলবায়ুর পরিবর্তন। পারমিয়ান যুগের শেষদিকে প্রাণীদের গণবিলুপ্তির সময় ট্রাইলোবাইটরা মরে যায়। এ সময় আগ্নেয়গিরির বিশাল বিশাল ও ভয়ঙ্কর ধরনের উদগীরণে তাপমাত্রা বেড়ে যায়। সাগরের জলরাশি অম্লত্ব ধারণ করে এবং পৃথিবীর প্রায় ৯০ শতাংশ প্রাণী মারা পড়ে। ট্রাইলোবাইটরা যতদিন বেঁচে ছিল ভৌগোলিক সময়ের বিচারে হোমোসেপিয়ানরা তার মাত্রা ০.০৬ শতাংশ সময় বেঁচে আছে। পরিবেশগত যে সঙ্কট আমরা সৃষ্টি করেছি তাতে আর কতদিন আমরা বেঁচে থাকব তা পরিষ্কার নয়। ওয়াশিংটনের স্মিথসোনিয়ান ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব নেচারাল হিস্ট্রি হাজার হাজার বার্জেস শেলের নমুনা ধারণ করে আছে। ৫০ কোটি বছর আগের ঘটনাবলী বার্জেস শেলের কাহিনীর সূচনামাত্র। বিজ্ঞানীরা এগুলোর সন্ধান পাওয়ার পর কি ঘটেছিল সম্ভবত তা আরও বেশি সুগভীর। চার্লস ডুলিটল ওয়ালকট ১৯০৯ সালে প্রথম এই ফসিল ক্ষেত্রটি খনন করেন। তিনি খনন কাজে এত ব্যস্ত ছিলেন যে সেগুলোর রহস্যোদ্ধার করার মতো সময় তার ছিল না। কয়েক দশক পর বিজ্ঞানীরা উপলব্ধি করতে শুরু করেন বার্জেস শেলের নমুনাগুলো সত্যিই কত অসাধারণ বৈচিত্র্যময় ও অমূল্য। প্যালিয়নটোলজিস্ট স্টিফেন জে গোল্ড লক্ষ্য করেন ফসিলগুলো এত অদ্ভুত যে সেগুলো জানা কোন প্রাণী গোত্রের পক্ষে সম্ভব হতে পারে না। ১৯৮৯ সালে ‘ওয়ান্ডারফুল লাইফ‘ নামক গ্রন্থে তিনি এই ধারণা ব্যক্ত করেন যে ক্যাম্ব্রিয়ান প্রাণীগুলো ছিল পৃথিবীর ইতিহাসের অসাধারণ পরীক্ষামূলক অধ্যায়ের অংশ। এই প্রাণীগুলো শুধু যে আদিম ছিল তা নয়, এরা এবং এদের ইকোসিস্টেম ছিল এতই জটিল যে এ ধরনের জটিল কোন কিছু আজ দেখতে পাওয়া সম্ভব নয়। ভৌগোলিক ঘড়িকে রিমাইন্ড করা গেলে বিবর্তনের ধারা হয়ত সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে অগ্রসর হতো। মানুষের জায়গায় হয়ত হালুসিজিনিয়ার বহুপদ বিশিষ্ট বংশধররাই পৃথিবীতে আধিপত্য করত। তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে গোল্ডের ব্যাখ্যা সঠিক নয়। হান্স সুয়েস নামে এক প্যালিওবায়োলজিস্ট বলেন যে বার্জেস শেলের বেশিরভাগ নমুনা বিবর্তন বৃক্ষের বর্তমান শ্রেণী বা গোত্রগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে এই ধারণাটি এখনও প্রযোজ্য যে বিবর্তনের ব্যাপারটা অনিশ্চিত। এটা কোন্ রূপ ধারণ করবে ও কোন্ পথ ধরে অগ্রসর হবে আগে থেকে কিছুই বলা যায় না। মানুষের আবির্ভাব লাখ লাখ বছরের বিবর্তনের ক্রমবর্ধমান জটিলতার অনিবার্য ফল নয় বরং এ এক আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত ঘটনা। এ ধরনের আরও অনেক বিশ্বও তো আছে। আমাদের বিশ্ব স্রেফ সেগুলোর একটি। মুয়েস বলেন, বার্জেস শেলের জগতটা যদি একেবারেই ভিনজাতের জগত বলে মনে হয় তেমনটা মনে হবে শুধু এই কারণে যে আমরা আমাদের নিজেদের বিশ্বের প্রতি যথেষ্ট মাত্রায় নজর দেইনি। আমাদের এই অজ্ঞতা, এই নজর না দেয়ার যথেষ্ট মূল্য দিতে হবে। আমাদের এই ভূমিকার কারণেই যে পরিবেশ-প্রতিবেশের জন্য পৃথিবীতে এমন অসাধারণ প্রাণবৈচিত্র্য সম্ভব হয়ে উঠেছে তা বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে কীটপতঙ্গ, মাকড়সা, কাঁকড়া, চিংড়ির মতো আর্থোপড বা অমেরুদন্ডী প্রাণীদের পরিবার লাখ লাখ বছরের বিপর্যয় ও টালমাটাল অবস্থার মধ্যে টিকে থাকতে পারলেও আমাদের এই যুগে অতি ভয়াবহ আকারে বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে চলেছে। আবাসস্থল হারানো ও জলবায়ু পরিবর্তনের যৌথ প্রভাব প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের এত দ্রুত রূপান্তর ঘটিয়ে দিচ্ছে যে বিজ্ঞানীরা তা নিয়ে গবেষণা করার মতো সময়ও পাচ্ছেন না। আমরা কি হারাচ্ছি তা আমরা জানতেও পর্যন্ত পারছি না। বার্জেস শেলের প্রাণীরা কাদামাটি থেকে হামাগুঁড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসতে শুরু করার সময় ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের প্রাণীরাও কখনও স্থির অবস্থায় ছিল না। তাদের ওপর গ্রহাণুর আঘাত এসেছে, বরফ যুগের ধাক্কা লেগেছে। তাদের অনেকেই বিলুপ্ত হয়েছে। তার পরও জীবন থেমে থাকেনি। এর আবির্ভাব ঘটেছে, রূপান্তর ঘটেছে, পরিবর্তন ঘটেছে। এই মুহূর্তে জলবায়ুর পরিবর্তন এমন গতিতে ঘটে চলেছে যা পৃথিবীর ৪৬০ কোটি বছরের মধ্যে হয়নি। বর্তমান জলবায়ুর ওপর নির্ভরশীল প্রাণীরা বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তিমির মতো সুবৃহৎ প্রাণী, অর্কিডের মতো নাজুক ফুল, সুদূর সুমেরুর কিছু কিছু বৃক্ষের গায়ে জন্ম নেয়া ধূসর বর্ণের অজ্ঞাতনামা ক্ষুদে শৈবাল এমন হারে মারা যাচ্ছে যা বিশ্বে ঘটে যাওয়া সর্ববৃহৎ বিলুপ্তির হারের কাছাকাছি। আমাদের এই গ্রহ এমন এক অবস্থার দিকে ছুটে চলেছে যেখান থেকে ফিরে আসার আর উপায় নেই। সূত্র : ওয়াশিংটন পোস্ট
×