ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষিখাতে বর্তমান সরকারের সাফল্য

প্রকাশিত: ১২:২৯, ৫ জানুয়ারি ২০২০

কৃষিখাতে বর্তমান সরকারের সাফল্য

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী রাজধানী ফার্মগেটের কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ কেআইবির ষষ্ঠ জাতীয় কনভেনশন এবং এ উপলক্ষে আয়োজিত আন্তর্জাতিক সেমিনার উদ্বোধনকালে বলেছেন বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে এবং খাদ্যের জন্য যেন আর কোনদিন দেশকে কারও কাছে হাত পাততে না হয়। তিনি আরও বলেছেন, দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পন্ন এবং এর জন্য প্রধানমন্ত্রী দেশের কৃষি বিজ্ঞানীসহ কৃষিবিদ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। এছাড়াও কৃষি পণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণের দিকে মনোযোগ দিতে হবে, বহুমুখী ফসলের চাষাবাদের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে, কৃষিপণ্যের ভ্যালু এ্যাড করতে হবে, প্রক্রিয়াজাত করতে হবে এবং বিদেশে কৃষিপণ্যের রফতানি বাড়তে হবে। ২০২১ সালের মধ্যে ডেল্টা প্লান প্রণয়নের কাজ চলছে যেখানে কৃষি, পানি ও ব্লু-ইকোনমি সংযুক্ত রয়েছে। সরকার প্রথম প্রেক্ষিতে পরিকল্পনা (২০১০-২১), সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১৬-২০) এবং সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল (২০১৫-২০২৫) বাস্তবায়নের কাজ চলছে। জাতীয় কৃষি নীতি ২০১৮ এ ধারায় তৃতীয় সংস্করণ যা মন্ত্রিসভা সম্প্রতি অনুমোদন দিয়েছে। যার মূল লক্ষ্য কৃষিজাত উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন, লাভজনক টেকসই প্রবৃদ্ধি, কৃষি গবেষণা, শিক্ষা সম্প্রসারণ ও আধুনিকীকরণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানের দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে তোলা, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ উৎসাহিত করে কায়িক শ্রম হ্রাস ও সাশ্রয়ী কৃষি ব্যবস্থার প্রচলন করা। এখন আলোচনা আসে বর্তমান সরকারের বিগত প্রায় ১০ বছর শাসনামলে কৃষির বিভিন্ন ক্ষেত্রের সাফল্যগুলো কি হয়েছে এবং আরও কি কি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। আমাদের চাল উৎপাদন বর্তমানে ৩৩৮ দশমিক ১৩ লাখ টনে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনতার পর বিগত ৪৭ বছরে ধান উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে ৪ গুণ। শাকসবজি উৎপদানে বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয়। প্রাকৃতিক উৎস থেকে আসা মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের তৃতীয় যা চীন-ভারতের পরেই রয়েছে। এবং প্রাণিসম্পদ বিশেষত পোলট্রি শিল্প দেশে গার্মেন্টের পরই কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত হিসেবে বিবেচিত। কৃষি বিজ্ঞানীরা পাটের ওপর গবেষণা করে এ ফসলের জীবন রহস্য উদ্ভাবন করে যা এক যুগান্তকারী ঘটনা। আবার সম্প্রতি মৎস্য বিজ্ঞানীরা ইলিশের ওপর এ প্রজাতির জীবন রহস্য উদ্ভাবন আরও একটি যুগান্তকারী ঘটনা। ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ এবং তার প্রজনন, উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ইত্যাদিতে সরকার যথেষ্ট সক্রিয় রয়েছে বিশেষত আন্তর্জাতিক বাজারে যেখানে বাংলাদেশের ইলিশের সুনাম পৃথিবীব্যাপী কৃষি গবেষণা ও প্রযুক্তিতে দেশের অগ্রগতি লক্ষণীয়। স্বাস্থ্য ও পুষ্টিমানের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে এখন জৈব কৃষি ও তার সঙ্গে প্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তারের পথে রয়েছে। বিজ্ঞানীরা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে কাক্সিক্ষত বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী জিন বা জীনগুলোকে আবিষ্কার করে তা অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভিদের জিনোমে ঢুকিয়ে নতুন ক্ষমতা সম্পন্ন ফসল উদ্ভিদ তৈরি করে চলছে। এবারকার প্রণীত কৃষিনীতির নতুন সংযোজন হলো ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহার যা বাংলাদেশে খুব পরিচিত নয়। এটা হলো পদার্থের ক্ষুদ্রতম ব্যবহার যা পদার্থকে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষদ্রতর পর্যায়ে রূপান্তরের পর তা নিয়ন্ত্রণের কৌশল। এ প্রযুক্তি পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন ও জীব বিজ্ঞানকে সমন্বয় করে এক সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে যা ব্যবহৃত হয় ওষুধ তৈরিতে, রোগ শনাক্তকরণে, শিল্পে ও কৃষি উপকরণ তৈরিতে বিশেষত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক উৎপাদনে, মাটির গুণগত মান বৃদ্ধি, পানি পরিশোধনে, কৌলিতত্ব প্রজনন ও শনাক্তকরণে। এ বিষয়ে ভারতে ব্যাপক গবেষণা চলছে এবং বাংলাদেশে এর নতুন সংযোজন সূচনা হয়েছে যা একটি শুভ লক্ষণ মাত্র। প্রাথমিক পর্যায়ে ফসলের রোগ নির্ণয়, জাতিভিত্তিক পুষ্টি চাহিদা নির্ণয়, পুষ্টি আহরণের ক্ষমতা বৃদ্ধি, ভারি ধাতুর উপস্থিতি শনাক্তকরণ, বালাইনাশক উদ্ভাবন ইত্যাদিতে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। বিগত কয়েক দশকে কৃষিতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হলেও ভরণ-পোষণের কৃষি থেকে বেরিয়ে আসতে আমাদের আরও অনেক সময় লেগে যেতে পারে। কারণ আমাদের কৃষি শ্রমিকের একটা বড় অংশ অদক্ষ। যদিও কৃষি যান্ত্রিকীকরণের প্রক্রিয়া ধীরগতিতে চলছে যার জন্য দক্ষ শ্রম শক্তি অপরিহার্য। কিন্তু এ ধরনের কাজে ডিগ্রিধারী উদ্যোক্তাদের খুব কমই আকৃষ্ট করা যাচ্ছে বর্তমান অর্থবছরের বাজেটে কৃষি অর্থনীতি খাতে সর্বাধিক বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৫৮ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা যার মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর আওতায় রয়েছে ৩৭ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা। যা মূল এডিপির ২১ দশমিক ৮ শতাংশ। আবার উন্নয়ন-অনুন্নয়ন মিলে কৃষি খাতে যে বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে যা মূল বাজেটের ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। আমাদের কৃষিনীতিতে বরাবরই কৃষি ভর্তুকির কথা উল্লেখ থাকলেও তার পরিমাণ নির্ধারিত হয়নি। যার ফলে কৃষি ভর্তুকি সবসময়ই অবহেলিত থেকে যাচ্ছে। যেমন ২০১১-২০১২ অর্থবছরে কৃষি ভর্তুকিতে বরাদ্দ ছিল মূল বাজেটের প্রায় ৭ শতাংশ যা বর্তমানে নেমে এসেছে ২ শতাংশে। ফলে কৃষি খাতে বিনিয়োগ হ্রাস পাচ্ছে, তার সঙ্গে হ্রাস পাচ্ছে প্রবৃদ্ধির হার, কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য। সে যাই হোক না কেন প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণের মাধ্যমে জাতিকে যে স্বপ্ন দেখিয়েছেন তার বাস্তবায়নের আসন্ন চ্যালেঞ্জগুলোকে মনে রাখতে হবে। কারণ জনসংখ্যা বাড়ছে তার সঙ্গে বাড়াতে হবে খাদ্যপুষ্টির চাহিদা। যেখানে বৈজ্ঞানিক কৃষি ব্যবস্থা ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। কৃষি ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রতিষ্ঠান নার্স সিস্টেমের আওতায় কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কাঠামো দ্বারা পরিচালিত। আবার বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের একডেমিক কর্মসূচীর আওতায় গবেষণা পরিচালনা করে থাকে যার ব্যাপকতা তত বেশি গভীর না থাকায় জাতীয় চাহিদা পূরণ একেবারেই অপ্রতুল। প্রায়শই একটি অভিযোগ আসে, এ বিষয়ে যে একদিকে গবেষকের অপ্রতুলতা অপরদিকে গবেষণা খাতে অবকাঠামোগত স্বল্পতা যেমন আধুনিক গবেষণাগার, পর্যাপ্ত গবেষণা বাজেট না থাকা, সৃষ্টির স্বীকৃতি না থাকা কিংবা গবেষকদের চাকরি সময়সীমা বাড়ানো সংক্রান্ত জাটিলতা ইত্যাদি। তারপরও যারা গবেষণা করছেন তারা নিজের ইচ্ছাতেই করছে তা দিয়ে জাতীয় চাহিদা কতটুকু পূরণ হবে। আবার কৃষি বিজ্ঞানীদের অনেকেই ক্রমাগত ভাবে দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে শুধু একটি সমৃদ্ধ জীবনের আশায়। এখন এ ঘাটতি পূরণে গবেষক তৈরির প্রক্রিয়া শুরু“করতে হবে আকর্ষণীয় সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির মাধ্যমে এবং দেশের বিজ্ঞানীরা এর মধ্যেই তাদের মেধার স্বীকৃতিস্বরূপ আধুনিক জৈব প্রযুক্তির ফলপ্রসূ প্রয়োগ, জলবায়ু পরিবর্তন ও অজৈবনিক অভিঘাত সহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবনের কাজ শুরু করেছে যা খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যআয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার প্রক্রিয়ায় কৃষি খাতের গুরুত্ব অপরিসীম এবং বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য জোগান দিতে হলে কমপক্ষে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ হারে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধির প্রয়োজন। প্রখ্যাত জার্মান অর্থনীতিবিদ জোসেফ সুমপিটার আজ থেকে বহু বছর আগে বলেছিলেন, শিল্পায়ন হলো একটি ভাঙা-গড়ার খেলা। যে প্রক্রিয়ায় কম সম্ভাবনাময় খাত থেকে বেশি সম্ভাবনাময় খাতে সম্পদের পুনর্বণ্টন হয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের কৃষির ক্ষেত্রে তা হয়ে উঠেছে বিপরীতধর্মী যা সরকারকে অনুধাবন করতে হবে। কারণ প্রাধিকারের ভিত্তিতে সম্পদের বণ্টনে কৃষি অনেক পেছনে রয়েছে যাকে উন্নত করতে হবে জনগণের ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্য দূরীকরণ ও খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে। তা হলেই প্রধানমন্ত্রীর লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে।
×