ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অর্থনীতিতে প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

প্রকাশিত: ১২:২৮, ৫ জানুয়ারি ২০২০

অর্থনীতিতে প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন বছর। কিছু খাতে চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও মোট দেশজ উৎপাদন, বিনিয়োগ, রেমিটেন্স, রিজার্ভ সব ক্ষেত্রেই সফলতা অর্জন করে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। দেশের অর্থনীতির নানা বিষয় নিয়ে লিখেছেন- জলি রহমান অর্থনীতির বড় স্বস্তির জায়গা হচ্ছে প্রবাসী আয়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানোর বড় কৃতিত্ব এই প্রবাসী আয়ের। রেমিটেন্স অর্জনে বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান বহু বছর ধরে যথেষ্ট শক্তিশালী। ২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী বেশি রেমিটেন্স আসা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান নবম। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে বিশ্বব্যাপী প্রবাসী আয় প্রবাহের মোট পরিমাণ ছিল ৬৮৯ বিলিয়ন ডলার, আগের বছরে ছিল ৬৩৩ বিলিয়ন ডলার। মোট রেমিটেন্স প্রবাহের ৫২৯ বিলিয়ন ডলারই গেছে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। আর এসব দেশে বিদেশি মুদ্রায় বিপুল পরিমাণ প্রবাসী আয় আসায় তাদের জন্য বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য টেকসই অবস্থায় রাখতে সহায়ক হয়েছে বলেও মনে করে বিশ্বব্যাংক। সদ্য বিদায়ী বছরে রেমিটেন্স এসেছে ১ হাজার ৮৩৩ কোটি মার্কিন ডলার। বাংলাদেশী টাকায় যার পরিমাণ ১ লাখ ৫৫ হাজার ৮০৫ কোটি টাকা। সরকার নগদ ২ শতাংশ প্রণোদনা দেয়ায় প্রবাসী আয়ে ঘটেছে উল্লম্ফন। এ হিসাবে প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২০ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে এক হাজার ৩৫৩ কোটি ডলারের সমপরিমাণ রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। এর আগের বছর ২০১৬ সালে ছিল এক হাজার ৩৬১ কোটি ডলার। ২০১৫ সালে আসে এক হাজার ৫৩১ কোটি ডলার। আর ২০১৪ সালে রেমিটেন্সের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৪৯২ কোটি ডলার। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে রেমিটেন্স আহরণে রেকর্ড হয়। ওই সময়ে প্রবাসীরা ১ হাজার ৬৪২ কোটি ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছে। যা অর্থবছর হিসাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেমিটেন্স আহরণ। এছারাও ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯০৯ ডলারে। গত কয়েক বছরে ১০০ থেকে ১৫০ ডলার করে মাথাপিছু আয় বেড়েছে। ২০২০ সালে দেশের মাথাপিছু গড় আয় ২ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা যায়। গত দশকে মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) তিনগুণ হয়েছে, ২০১৮ সালে যা ১ হাজার ৭০০ মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি গড়ে ৬ দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ২০১৯ সালে ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। অর্থনৈতিক গতিশীলতার কারণে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের মাপকাঠি অর্জনে সক্ষম হয়েছে। প্রত্যাশা অনুযায়ী ২০২১ সালে প্রয়োজনীয় শর্তগুলো পূরণ করতে পারলে ২০২৪ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকাভুক্ত করতে সুপারিশ করবে। গত অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি বেড়েছে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে ৮ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রত্যাশা করা হচ্ছে। ২০২৪ সাল নাগাদ এটি ১০ শতাংশে দাঁড়াবে। এই বিশাল অর্জন নতুন চ্যালেঞ্জও নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের অর্থ হলো বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বিশেষ সুবিধা হারানো। অনেক উন্নত দেশেই এদেশের পণ্য যে অগ্রাধিকার পায়, তা হারাবে। এলডিসি টেকনোলজি ব্যাংক, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় অর্থায়নে এলডিসি তহবিল অথবা এইড-ফর-ট্রেডের মতো উন্নয়ন সহযোগিতা ব্যবস্থায় বাংলাদেশ আর অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারবে না। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সরকারকে ব্যবসায়িক পরিবেশের উন্নয়নে সংস্কার অথবা তালিকাভুক্তির পর অর্থনৈতিক উন্নয়ননে আর্থিক ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেছেন, বর্তমান সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছে। ২০২১ সালের মধ্যে এদেশ হবে মধ্যম আয়ের দেশ। ২০৪১ সালের মধ্যে হবে উন্নত দেশ। আর ২০২২ সালের মধ্যে সব মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে তার সূচনা হবে। আর সেই লক্ষ্যে মুজিববর্ষ উদযাপনের আয়োজন। যাতে নতুন প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ছড়িয়ে দেয়া যায়। বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেছেন, বাংলাদেশের সফলতার মূলে রয়েছে মৌলিক কিছু ক্ষেত্রে উন্নতি। এর মধ্যে রয়েছে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, জীবনমানে উন্নতি, শিশুমৃত্যু ও দারিদ্র্য হ্রাস। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য অর্জনে টেকসই অর্থনীতি ও সামাজিক অগ্রগতি সমান্তরালভাবে হতে হবে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার তুলনায় জমির পরিমাণ কম। শিল্পায়নের জন্য কৃষিজমি ব্যবহারের সুযোগও সীমিত। এ কারণে পরিকল্পিত শিল্পায়নের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে। অন্যদিকে ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জনের জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ। তবে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস রফতানি খাতে এখন ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে রফতানি আয় হয়েছে ১ হাজার ৫৭৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় সাড়ে ১২ শতাংশ কম আর আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে ৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ। বর্তমানে পোশাক খাতেও এসেছে বড় চ্যালেঞ্জ কেননা বাংলাদেশকে পেছনে ফেলে প্রতিবেশী দেশ ভিয়েতনাম পোশাক রফতানিতে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের ১০ শীর্ষ রফতানিকারকের মধ্যে বর্তমানে বাংলাদেশের অংশ ৬ দশমিক ৪ শতাংশ এবং ভিয়েতনামের ৬ দশমিক ২ শতাংশ। ২০১৯ সালের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, পোশাক রফতানিতে দেশটি বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের অনেক ক্রয়াদেশ ভিয়েতনামে চলে গেছে। চীনা বিনিয়োগকারীরাও ভিয়েতনামে ভিড় করছে। এবারের বাণিজ্যযুদ্ধের সুফল বাংলাদেশ নিতে পারছে না। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির দৌরাত্ম্যে সাধারণ মানুষের জীবন যাপন কঠিন হয়ে পড়ছে। নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে বিশেষ করে পেঁয়াজের মূল্য। এর পেছনে যেসব সিন্ডিকেট সক্রিয়। এ ব্যাপারে সরকার আরও সচেতন হলে নতুন বছর সবার মনে স্বস্তি আনবে বলে আশা করা যায়।অর্থনীতির আর একটি সফল খাত এমএসএমই (ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি আকারের প্রতিষ্ঠানে) । প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে কর্মমুখী করতে এ খাতের ভূমিকা ব্যাপক। এসব ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানই বিশালসংখ্যক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করে, কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করে বেশি এবং জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। পরিবার, সমাজ ও অর্থনীতিতে ইতিবাচকভাবে কড়া নেড়ে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের সুযোগ করে দেয়ার ক্ষেত্রে পরিচিত এমএসএমই। সরকারী নানা সুযোগ-সুবিধার কারণে চলতি বছরে এ খাত হবে আরও সমৃদ্ধ। নতুন বছরে অর্থনীতিতে রয়েছে বেশ কিছু চমক তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আগামী এপ্রিল থেকে ব্যাংকঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল। যা অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) যে ওয়ান স্টপ সার্ভিস (ওসএস) চালু করেছে, তাতে আরও নতুন নতুন সেবা যুক্ত হবে। এছাড়াও ২০২০ সালে বিশ্বব্যাংকের সহজে ব্যবসা সূচক বা ইজ অব ডুয়িং বিজনেসে আরও উন্নতির আশা আছে সরকারের। ২০১৯ সালে এ ক্ষেত্রে আট ধাপ উন্নতি করে ১৬৮তম অবস্থান পেয়েছে বাংলাদেশ। ২০০৩ সালে চামড়াশিল্প নগর প্রতিষ্ঠা শুরু করেছে সরকার, ২০২০ সালে তার একটি পরিণতি আশা করা যায়। সর্বোপরি ২০১৮ সালের মার্চে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। সবকিছু ঠিকঠাক চললে ২০২১ সালের মার্চে স্বীকৃতি পাওয়ার পর্যালোচনা হবে। তাই ২০২০ সাল হবে এগিয়ে যাওয়ার বছর।
×