ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সাংস্কৃতিক উৎসব

প্রকাশিত: ০৮:৫৭, ৫ জানুয়ারি ২০২০

সাংস্কৃতিক উৎসব

বঙ্গভাণ্ডারের বিবিধ রতনের সন্ধান ও চর্চা-পরিচর্যার অবকাশ যেন কমে আসছে মানুষের জাগতিক ও বৈষয়িক নানা অর্জনের প্রতিযোগিতায়। হৃদয়-মননের তৃষ্ণা মেটানোর জায়গাটি যেন সংকুচিত হয়ে আসছে। এমন একটি বাস্তবতায় জনসংস্কৃতি বিষয়ে জনগণের সরকার সচেতনতার পরিচয় দিলে জনমনে সাড়া জাগা সম্ভব। শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে তিন সপ্তাহব্যাপী যে বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক উৎসবের সূচনা হয়েছে ঢাকায়, সাধুবাদযোগ্য। সাংস্কৃতিক উৎসব বলতেই এক শ্রেণীর মানুষ বোঝেন গানবাজনা, কিংবা বড়জোর কবিতা আবৃত্তি। সমগ্র সংস্কৃতির ধারণাটি যে আরও বড় পরিসরের, তার পরিধি যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি অনেকেই বুঝতে চান না। দেশের সংস্কৃতির শিকড় ছুঁতে হলে লোকসংস্কৃতির আবাহন চাই। চাই লোকজ মেলার আয়োজন। যাত্রাপালা, পুঁথিপাঠ, কবিগান, পুতুল নাচ, সংযাত্রা, কিচ্ছাপাঠ, গম্ভীরা এসবই গ্রামবাংলার হাজার বছরের সংস্কৃতি। আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসন ও তথাকথিত আধুনিকতার যাঁতাকলে বাংলার প্রাণভোমরাটি যেন হাঁসফাঁস করছে। রাজধানীতে এসবেরই মঞ্চায়ন নিঃসন্দেহে তাৎপর্যময় ঘটনা। দেশের পুব থেকে পশ্চিম, সর্ব উত্তর থেকে সর্ব দক্ষিণাঞ্চলের সাংস্কৃতিক সংগঠনের সৌজন্যে সমগ্র বাংলার আদি সংস্কৃতি উঠে আসার সুবর্ণ সুযোগ তৈরি হয়েছে এই উৎসবের মধ্য দিয়ে। এ ঐতিহ্যবাহী লোকনাট্যের আয়োজন দেশের সাংস্কৃতিক শিকড়ে ঢালবে প্রাণরস ও সংহত শক্তিÑ এটিই প্রত্যাশা। বিশিষ্ট সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব ড. সন্জীদা খাতুন সংস্কৃতির শক্তি ও চারিত্র্য বিষয়ে কিছু তাৎপর্যপূর্ণ উচ্চারণ করেছিলেন বিদায়ী বছরে, যা মানুষের অন্তর ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। এতে শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ শুধু আলোড়িতই নয়, সমাজের ইতিবাচক মানুষ হিসেবে নিজের অবস্থানও শনাক্ত করতে সমর্থ হয়েছেন। এক ধরনের প্রেরণা লাভ করেছেন। ড. সন্জীদা খাতুন বলেছেন, ‘সংস্কৃতির চর্চা মানুষকে ভালবাসতে শেখায়। সমাজের অনাচার দূর করতে সংস্কৃতি একটা আশ্রয়। সেই সংস্কৃতির আশ্রয়ে আমরা সারাদেশের মানুষকে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ করতে চাই।’ তার বক্তব্য থেকে দেশের সংস্কৃতিকর্মীরা অন্তর্গত শক্তি অর্জন করবেন এবং একইসঙ্গে এক ধরনের স্বীকৃতি লাভের আনন্দও বোধ করবেনÑ এমনটাই প্রত্যাশিত। বলা নিষ্প্রয়োজন, সংস্কৃতির সুধা ও আলো ছড়িয়ে দেয়ার ব্রতে যারা নিবেদিতপ্রাণ, তাদের সমর্থন যোগানোও সমাজের কর্তব্য। সঙ্গীত, কবিতা, ছবি অঙ্কন, ভাস্কর্য, সাহিত্য, দার্শনিক চিন্তা প্রভৃতি এক একটা জাতির সংস্কৃতির প্রকাশ মাধ্যম এবং দর্পণ। এসব সৃজনধর্মী কাজেই অর্জিত হয় মন ও হৃদয়ের সুখানুভূতি, আনন্দ ও উৎফুল্লতা। মানুষ উৎসবে তখনই যুক্ত হয় যখন তার কাছে জীবন স্বস্তিকর এবং উপভোগের হয়। উৎসবের সময় ও পরিবেশ সৃষ্টিও তাই অনেক গুরুত্বপূর্ণ। জীবনকে বর্ণিল করার জন্য যেমন রচিত হয়েছে নানাবিধ উৎসব, তেমনি জীবনের বাঁকে বাঁকে সঙ্কট উজিয়ে সংগ্রাম করেই অর্জন করে নিতে হয়েছে বিবিধ উৎসব। উৎসবের উপলক্ষ সৃজন করতে পারাটাও তাই এক অর্থে অগ্রসরতা, জীবনমুখিতা এবং উজ্জ্বল আনন্দের প্রসারিত উদ্ভাবন। সাহিত্য-সংস্কৃতি সমাজবদ্ধ মানুষের সৃষ্টিশীল নান্দনিক চেতনার আরেক নাম। মানুষ যেমন সাহিত্য-সংস্কৃতির উপাদান সৃজন করে, তেমনি সেটি তার জীবনযাপনের অংশ। সাহিত্য রচিত হয় ব্যক্তির হাতে কিন্তু সেটি হয়ে ওঠে সমষ্টির সম্পদ। সেই সম্পদ সমষ্টিকে আপ্লুত করে, তাকে শক্তি যোগায়, অনির্বচনীয় আনন্দ প্রদান করে। সাহিত্যের আলোয় যে আলোকিত হয় তার পক্ষে অন্ধকার রচনা করা, কিংবা অন্ধকারের যাত্রী হওয়া অসম্ভব। সঙ্গীত কিংবা নাটক, চিত্রকলা কিংবা চলচ্চিত্রÑ শিল্পের প্রতিটি শাখা সম্পর্কে আমরা একই কথা উচ্চারণ করতে পারি। একটি সমাজের এসব সাংস্কৃতিক শক্তি সমাজকে সুশীল ও সৌরভ দান করে। অসুস্থ মনের পরম শুশ্রুষা হতে পারে সংস্কৃতির সৌন্দর্য ও সুঘ্রাণ। বিচ্ছিন্ন, বিহ্বল, বিপথগামী তারুণ্যকে জীবনের ইতিবাচক দিকটির প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট করার জন্য শিল্প-সংস্কৃতির অন্তর্নিহিত শক্তিকে কাজে লাগানোর বিকল্প নেই।
×