ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নেতারা বিতর্কিত কথা বলছেন

ঢাকার সিটি নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায় বিএনপি

প্রকাশিত: ১১:১৪, ৪ জানুয়ারি ২০২০

ঢাকার সিটি নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায় বিএনপি

শরীফুল ইসলাম ॥ ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলেও এ নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন রকম বিতর্কিত কথা বলছেন দলটির সিনিয়র নেতারা। এর মাধ্যমে তারা যে এ নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাচ্ছেন তা তাদের বক্তব্য থেকেই বোঝা যাচ্ছে। তাই সিটি নির্বাচন নিয়ে বিএনপির প্রকৃত অবস্থান কি এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা চলছে। উল্লেখ্য, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবির পর সে নির্বাচনের ফলাফল বর্জন করে বর্তমান সরকারের অধীনে আর নির্বাচনে না যাওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছিল বিএনপি। কিন্তু উপজেলা পরিষদ নির্বাচনসহ বিভিন্ন নির্বাচন বর্জন করতে গিয়ে দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে দলটি। এরপর আবার ইউটার্ন নিয়ে সকল নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। সম্প্রতি ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপি এ নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দেয়। এরপর দল থেকে নির্বাচন করতে আগ্রহী প্রার্থীদের মধ্যে মনোনয়ন ফরম বিতরণ করে বিএনপি। দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করে দুই সিটিতে মেয়র পদে ৩ জন এবং কাউন্সিলর পদে ৪৭৬ জন নির্বাচন করার আগ্রহ প্রকাশ করে। পরে তাদের সাক্ষাতকার নিয়ে বিএনপি হাইকমান্ড ঢাকা উত্তরে তাবিথ আউয়াল ও ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনকে মেয়র পদে মনোনয়ন দেয়। এ ছাড়া দুই সিটি কর্পোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডে ১ জন করে প্রার্থী চূড়ান্ত করে। দলীয় মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীরা ৩১ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশনের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করে জমা দিয়েছেন। এখন সব প্রার্থী নিজ নিজ কৌশলে গোপনে নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছেন। জানা যায়, প্রতীক বরাদ্দ পাওয়ার পর দুই সিটিতে বিএনপির মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী মাঠে সরব হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে দলের সিনিয়র নেতাদের বক্তব্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা চলছে। এমনকি খোদ বিএনপির সাধারণ নেতাকর্মীরাও এ নিয়ে বিব্রতবোধ করছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অতি সম্প্রতি দলীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছেন, বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে আগেও কোন নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনও সুষ্ঠু হবে না, তবুও গণতন্ত্রের স্বার্থে এবং নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জনগণের কাছে পৌঁছানোর জন্য আমরা এ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না তা প্রমাণ করতেই আমরা এ নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। তিনি বলেন, অনেকেই জানতে চায়, আমরা কেন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি। ২০১৪ সালে যখন নির্বাচনে যাইনি তখন বলা হয়েছে আমরা ভুল করেছি। ২০১৮ সালে নির্বাচনে গিয়েছিলাম এটা প্রমাণ করতে যে, আওয়ামী লীগের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। যারা কেন নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি জানতে চায় আমি তাদের বলি আসলে বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন কিছুতেই সম্ভব নয়, আবারও সেটা প্রমাণের জন্যই আমরা নির্বাচনে যাচ্ছি। বৃহস্পতিবার দলীয় এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, কারচুপির জন্য ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ইভিএমে ভোট নেয়া হচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করি না ঢাকা সিটিতে কোন সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। আমরা অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে। কিন্তু আমরা আশা করি না বর্তমান নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে। তবুও আমরা নির্বাচনে যাচ্ছি জনগণের কাছে থাকার জন্য, জনগণের কাছে আমাদের বক্তব্য পৌঁছানোর জন্য এবং জনগণের কাছে প্রমাণ করার জন্য যে, এই আওয়ামী লীগ ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনদিন নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে না। সম্প্রতি দলীয় এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, বর্তমান সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনাস্থা সত্ত্বেও ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে গিয়ে আমরা জেনেশুনে বিষপান করছি। কারণ আসন্ন ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারবে না। আর বর্তমান নির্বাচন কমিশনের প্রতি শুধু আমাদের নয়, সারাদেশের মানুষেরই আস্থা নেই। তারপরও আমরা জেনেশুনে বিষপান করছি, সবার মুখ রক্ষা করার জন্য। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে গেলে বোধহয় এবার একটু অন্যরকম হতো, জাতীয় নির্বাচনে যা হয়েছে এ নির্বাচনে হয়তো ওটা হতো না’- যতক্ষণ পর্যন্ত এমন ক্ষীণ সন্দেহ থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের নির্বাচনে থাকতে হবে। সম্প্রতি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে মেয়র পদে নির্বাচন করতে দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে দলের বিশেষ সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না সেটা আমরা জানি। তারপরও নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি। তবে আমাদের মূল লক্ষ্য হলো ভোটে নামলে ধানের শীষের পক্ষে স্লোগান উচ্চারিত হবে, একইসঙ্গে আমাদের নেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টিও উচ্চারিত হবে। এ কারণেই আমরা নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অবশ্য দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ার পর তিনি বলেন, বিএনপির উচিত ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন বর্জন করা। এদিকে আগেরবার ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে অংশ নিয়ে পরে বর্জন করলেও এবার নির্বাচনের শেষ পর্যন্ত দেখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন বিএনপি নেতা তাবিথ আউয়াল। মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, গত নির্বাচনে আমরা চেষ্টা করেছিলাম শেষপর্যন্ত থাকার জন্য। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। তবে আমরা এবার শেষপর্যন্ত নির্বাচনে থাকব এবং নির্বাচনের শেষটা দেখে নিতে চাই। তিনি বলেন, শুধু আমাদের নয়, জনগণেরও নির্বাচন কমিশন, সরকার ও প্রশাসনের প্রতি কোন আস্থা নেই। এদিকে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নিয়েও বিএনপি মহাসচিবসহ দলের নেতারা বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে এ নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায় বলে অভিযোগ করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। বৃহস্পতিবার দলীয় এক অনুষ্ঠানে এ বিষয়ে তিনি বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না সেটা প্রমাণের জন্যই বিএনপি সিটি কর্পোরেশন ভোটে যাচ্ছে বলে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যে বক্তব্য দিয়েছেন তা হাস্যকর। নির্বাচন নিয়ে নেতিবাচক বক্তব্য দেয়ার আগে নির্বাচনটা কেমন হয় তা দেখার অপেক্ষায় থাকার জন্য বিএনপি নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে জেতার জন্য, তা না করে তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে নির্বাচনটা খারাপ এটা প্রমাণ করার জন্য। নির্বাচন হওয়ার আগে তারা কি করে বুঝল নির্বাচনটা খারাপ হবে? তারা নির্বাচন হওয়ার আগে মন্তব্য সিলেটেও করেছে, অথচ সেখানে তারা জিতেছে। কুমিল্লায়ও নির্বাচনের আগে তারা অভিযোগ করেছিল, সেখানেও তারাই জিতেছে। আসলে গণতন্ত্রের প্রতি কোন শ্রদ্ধা নেই বলেই বিএনপি নেতারা নির্বাচনের আগেই ভোট কারচুপির অভিযোগ তোলে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি নির্বাচন কমিশনে গিয়ে ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলে নিরপেক্ষ প্রশাসনের অধীনে ফের নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়ে স্মারকলিপি প্রদান করে। স্মারকলিপি দেয়ার পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে বলেন, নির্বাচন কমিশন পক্ষপাতিত্ব করেছে। সে সময় নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যানের পাশাপাশি দল থেকে নির্বাচিতরা সংসদে যাবে না বলে ঘোষণা দিলেও তারেক রহমানের নির্দেশে সংসদে যোগ দিয়ে খোদ বিএনপি নেতাকর্মীদেরই তোপের মুখে পড়ে দলীয় এমপিরা। তাদের জাতীয় বেইমান হিসেবেও আখ্যায়িত করেন দলের কোন কোন নেতা। নির্ধারিত সময় শেষে সংসদে যোগ না দিলে সংসদীয় আসন শূন্য হয়ে যাওয়ার উপক্রম হওয়ায় বিএনপি থেকে নির্বাচিত ৬ জনের মধ্য থেকে ঠাকুরগাঁও-৩ আসনের জাহিদুর রহমান ২৫ এপ্রিল স্পীকারের কাছে শপথ নেন। পরে ২৯ এপ্রিল শপথ নেন আরও ৪ জন। ২৯ এপ্রিলই শপথ নেয়া বিএনপি দলীয় ৫ জন সংসদ অধিবেশনে যোগ দেন। আর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নির্ধারিত সময়ে শপথ না নেয়ায় তাঁর সদস্য পদ শূন্য ঘোষণা করা হয়। পরে তারেক রহমানের নির্দেশে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ৫ মে দলীয় এক অনুষ্ঠানে বলেন, আমরা সংসদে যাব না বলে অতীতে যা বলেছিলাম সেই সিদ্ধান্ত ভুল ছিল, এটা বলতে আমার কোন দ্বিধা নেই। তখন এভাবে বক্তব্য রেখে বিএনপি যেভাবে সমালোচনার মুখে পড়ে এবারও সিটি নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপি নেতাদের নেতিবাচক বক্তব্য নিয়ে নানামুখী সমালোচনা চলছে।
×