ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

টিভি সিরিয়াল;###;মত দিয়েছেন গৃহিণী রেবেকা আক্তার

দেশী টিভি চ্যানেলে বিদেশী সিরিয়াল কেন জনপ্রিয়

প্রকাশিত: ১১:১৩, ৪ জানুয়ারি ২০২০

দেশী টিভি চ্যানেলে বিদেশী সিরিয়াল কেন জনপ্রিয়

গৌতম পাণ্ডে ॥ রহস্যেঘেরা কাহিনী আমার পছন্দ। কিন্তু দেশের কোন টিভি ধারাবাহিক নাটকে এটা তেমন পাই না। এ কারণেই দীপ্ত টিভির তুর্কী ধারাবাহিক ‘সুলতান সুলেমান’ দেখতে ভুলি না। ঘরের সব কাজ সামলে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় যথারীতি টিভির সামনে বসি। এ সিরিয়ালের প্রতিটি পর্ব আমাকে এমনভাবে টানে যে পরের পর্ব দেখার আগ্রহ নিয়ে বসে থাকি। এমন এ মন্তব্য গৃহিণী রেবেকা আক্তারের। এক সময় বিটিভিতে বেশ কিছু দর্শকপ্রিয় বিদেশী সিরিয়াল দেখানো হতো। ডালাস, ম্যাকগাইভার, ডাইন্যাস্টি, এক্স ফাইল, চার্লিস এঞ্জেলস, আলিফ লায়লা, ফলগাই, রুটস নামে একাধিক বিদেশী টিভি সিরিয়াল সে সময় দর্শকপ্রিয়তাও পায়। ইংরেজী ভাষায় হলেও এর দর্শক ছিল প্রচুর। টিভি সিরিয়ালের নির্মাণশৈলী বিশেষ করে পারিবারিক কাহিনীই দর্শক প্রিয়তার মূল কারণ। এমনও দেখা গেছে রাতে বিটিভিতে যখন সিরিয়াল চলত তখন শহরের রাস্তাঘাট অনেকটাই ফাঁকা হয়ে যেত। বিদেশী টিভি সিরিয়ালের প্রতি দর্শকের এই আগ্রহের প্রেক্ষিতেই মূলত বিটিভিতে তখনকার দিনে বাংলা ধারাবাহিক নাটক নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই তালিকায় আরও রয়েছেন বেগম মমতাজ হোসেন, মামুনুর রশীদ, ইমদাদুল হক মিলন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, মুস্তাফিজুর রহমানসহ অনেকে। বেগম মমতাজ হোসেনের ধারাবাহিক নাটক ‘সকাল সন্ধ্যা’ দর্শকদের মাঝে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। তবে বিটিভি যুগে ধারাবাহিকে গুরুত্ব বাড়িয়ে দেন হুমায়ূন আহমেদ। ‘এসব দিনরাত্রি’সহ তাঁর একাধিক টিভি সিরিয়াল আমাদের টিভি দর্শকের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলে। সময়ের সঙ্গে পাল্টেছে পরিবেশ পরিস্থিতি। স্যাটেলাইট টিভি আধুনিক যুগে পা ফেলেছে দেশ। দেখতে দেখতে বেসরকারী পর্যায়ে একাধিক টিভি চ্যানেলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। শুরুর দিকে এসব চ্যানেলের সিরিয়াল বেশ জনপ্রিয় ছিল। আব্দুল্লাহ আল মামুন, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, মাসুম রেজা, সালাহউদ্দিন লাভলুসহ অনেক নাট্যকার নির্মাতা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তবে ততদিনে এক জায়গায় আমাদের টিভি মাধ্যম পিছিয়ে পড়ে। একসময় বিটিভি একা যা করতে পেরেছিল বর্তমানে আমাদের ২৫/২৬ টিভি চ্যানেলও বোধ করি তা করতে পারছে না। আমাদের এত টিভি চ্যানেল থাকার পরও দেশের একশ্রেণির টিভি দর্শককে দেশমুখী করা যাচ্ছে না। তারা অধিক মাত্রায় বিদেশী সিরিয়ালের প্রতি ঝুঁকছে। বাংলায় ডাবিং ‘সুলতান সুলেমান’ বিদেশী টিভি সিরিয়াল চালুর পর মূলত সবার মাঝে এক ধরনের নড়েচড়ে বসার মতো ভাব লক্ষ্য করা যায়। সিরিয়ালটি অটোম্যান সাম্রাজ্যের ঐতিহাসিক কাহিনীর ওপর ভিত্তি করে নির্মিত একটি পারিবারিক টিভি সিরিয়াল। এর প্রতি দর্শকের বেশ আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। এর একটাই কারণ আমাদের টিভি দর্শক একটি পারিবারিক কাহিনী পেয়েছে। এই বিদেশী সিরিয়ালে অনেক চরিত্র, ঘটনার অনেক বাঁক। মূলত ‘সুলতান সুলেমানের সাফল্যই দেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলকে আবার বিদেশী টিভি সিরিয়ালের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছে। দেশে কয়েকটি টিভি চ্যানেলে প্রচার হয় বিদেশী সিরিয়াল। যেগুলো বাংলায় ডাবিং করে সম্প্রচার হয়। এসব বিদেশী সিরিয়াল বন্ধের দাবি জানিয়েছে শিল্পী-কলা কুশলীরা। একই সঙ্গে বাংলাদেশী বিজ্ঞাপন বিদেশী চ্যানেলে প্রচার না করার প্রতি জোর দিয়েছেন তারা। কেন এই সিরিয়াল বন্ধের দাবি এ সম্পর্কে তাদের বিভিন্ন কারণও দেখিয়েছে তারা। তারা বলছেন, টিভিতে বিদেশী যেসব নাটক দেখানো হচ্ছে তার মধ্যে আমাদের সংস্কৃতির কোন যোগসূত্র নেই। সম্প্রতি টিভিতে বিদেশী চ্যানেলের অনুষ্ঠান, ডাবিংকৃত সিরিয়াল ও সেন্সরবিহীন চলচ্চিত্র অনুমতি ছাড়া প্রদর্শনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সরকার। এসব নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে বেশ কিছু চ্যানেল বিদেশী সিরিয়াল প্রচার করে যাচ্ছে। দেশী চ্যানেলে বিদেশী সিরিয়াল প্রচার সম্পর্কে টেলিভিশন শিল্পী ও কলাকুশলী সংগঠনের আহ্বায়ক নাট্যকার অভিনেতা মামুনুর রশীদ বলেন, এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আমাদের কথা হচ্ছে। সরকার বিদেশী সিরিয়ালের সেন্সরের জন্য একটা কমিটি করেছে, আমরা সে কমিটিতে আছি। কিন্তু আমরা এখন যেটা চাইছি সেটা হলো টাইম শিফট করতে হবে। যে সময়ে এসব সিরিয়াল হয় সেটা চেঞ্জ করতে হবে। পিক আওয়ারে এসব সিরিয়াল দেখানো চলেবে না। যদিও বিশ্বায়নের যুগে দর্শক-শ্রোতা কী দেখবেন, শুনবেন তা নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব। তবুও টিভি চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠান নির্বাচনের ক্ষেত্রে কিছু দায়িত্ব কর্তব্য রয়েছে। প্রথমত, সাংস্কৃতিক অর্থনীতি সমৃদ্ধ করতে হলে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির যথাযথ বিকাশ করতে হবে। আর তাই আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বিকাশের জন্য অন্যতম প্রতিবন্ধক। তবু কেন আমরা এগুলো প্রচার এমনকি প্রসারে ভূমিকা রাখছি? দর্শকের কাছে জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য? এটি ভুল ব্যাখ্যা। বাকের ভাই, রূপনগর আর পুরনো দিনের বিভিন্ন বাংলা চলচ্চিত্রের কথা ভুলে যাননি কেউ। কেবল টিভি ক্রম ঠিক করে দেবে সরকার। এ প্রসঙ্গে নাগরিক টিভির অনুষ্ঠান প্রধান কামরুজ্জামান বাবু বলেন, আমরা বিদেশী সিরিয়াল চালাই না। টিভিতে বিদেশী সিরিয়াল কন্টিনিউ করা উচিত না। মিনিমাম দেশী কন্টেন্ট বেশি থাকা উচিত। সময়ের চাহিদায় টেলিভিশন তো আর আটকিয়ে রাখা যাবে না। হয়তো কোন কোন সময় আমরা আটকিয়ে রাখছি, যেটা আমরা ইউটিউবে আটকাতে পারছি না। সেটারও একটা যুক্তি আছে। আসলে দর্শকই হচ্ছে বড় বিচারক। তাদের ভ্যারাইটিজ কন্টেন্ট দিতে হবে। দর্শক যদি মনে করে যে সে গ্রহণ করছে, তাহলে দেখালে কি সমস্যা? আর যদি দর্শক মনে করে যে এটা আমি দেখব না, তাহলে এমনি টিভিগুলো দেখাবে না। ডিপেন্ড অন অর্ডিন্যান্স। আমরা তো আসলে যদি ডেমোক্রেসির কথা বলি তাহলে সাধারণ মানুষই তার সিদ্ধান্ত নিবে। কাউকে জোর করে কিছু দেখানোর বিষয়কে আটকানো উচিত না, আবার আটকানোটাও একটা সমাধান না। আমি ঢালাওভাবে দিলাম কিন্তু অর্ডিন্যান্স নিল না, তাহলে এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে। অর্ডিন্যান্স ডিমান্ড থাকলে আমাদের কিছু করার নেই। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যুগে আমরা সব কিছুই ওপেন করে দিয়েছি, এর মধ্যে টেলিভিশনকে কতক্ষণ আটকিয়ে রাখব? আমরা চালাচ্ছি না, আমরা মনে করছি না যে আমরা বিদেশী কন্টেন্টে আছি। যদি কখনও মনেকরি বিদেশী কন্টেন্ট আমাদের দরকার দিতে হচ্ছে, তখনই চালাবো। মাঝখানে আমরা চালিয়েছিলাম, বন্ধও করেছি। আবার চালাবো যদি কখনও প্রয়োজন মনেকরি। তবে অবশ্যই সরকারের নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে চালাবো না। কারণ রাষ্ট্রের আইনের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। টেলিভিশন নাটক প্রযোজকদের সংগঠন টেলিভিশন এ্যান্ড ডিজিটাল প্রোগ্রাম প্রডিউসারস এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি ইরেশ যাকের বলেন, আমরা সরকারের সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি এবং একটা কমিটিও তৈরি হয়েছে। সেখানে আমরা দাবি রেখেছি যে বিদেশী ডাবিংকৃত সিরিয়াল যেন পিক আওয়ারে টিভিতে চালানো না হয়। ইতোমধ্যে আমরা একটা সুপারিশ করেছি সরকারের কাছে। এখনও কোন সাড়া মেলেনি তবে আশ্বাস দেয়া হয়েছে এ ব্যাপারে। এখন এটা বাস্তবায়নের পালা রয়েছে। সরকার যে এ ব্যাপারে যে নীতিমালা তৈরি করেছে এটারও বাস্তবায়ন হবে আশা করছি, সঙ্গে সঙ্গে পিক আওয়ারে যাতে এসব সিরিয়াল না দেখানো হয় এ ব্যাপারেও আমরা সরকারের কাছ থেকে আশাব্যঞ্জক সাড়া পেয়েছি। আমরা আমাদের মতো করে সরকারকে এ ব্যাপারে বলতে থাকব। বিদেশী সিরিয়াল বন্ধের দাবিতে টেলিভিশন শিল্পী ও কলাকুশলীরা বিভিন্ন সময়ে নানা বক্তব্য দেন। নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা গাজী রাকায়েত বলেন, প্রত্যেকটা চ্যানেলে যদি সপ্তাহে চার-পাঁচদিন করে ডাবিং করা বিদেশী সিরিয়াল চলে এতে ছয়-সাত কোটি টাকার শিল্পী সম্মানী নষ্ট হচ্ছে। প্রায় ৫০ পার্সেন্ট শূটিং হাউসে কাজ নাই। অভিনেতা মোশাররফ করিম বলেন, বিদেশী টিভি সিরিয়ালগুলোর সাথে বাংলাদেশী নাটকের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা বেশ মুশকিল। কারণ সেসব সিরিয়াল নির্মাণের জন্য যে অর্থ খরচ করা হয়, বাংলাদেশের নাটকের বাজেট তার তুলনায় নগণ্য। তিনি মনে করেন বাংলাদেশের নাটকের মান বাড়লে দর্শক বাড়বে। আর নাটকের মান বাড়াতে হলে পর্যাপ্ত টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। নির্মাতা বৃন্দাবন দাস বলেন, আজকের এই সঙ্কট আমাদের পেশার, সংস্কৃতিরও। আমাদের পরিচয়হীন করে দেয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। মানসম্পন্ন সব অনুষ্ঠানই দর্শকপ্রিয়তা পায় এবং সঙ্গত কারণে সেই চ্যানেলের জনপ্রিয়তাও বেড়ে যায়। মানসম্পন্ন অনুষ্ঠান নির্মাণ হচ্ছে না বলেই এসব চ্যানেলে ভিনদেশী অনুষ্ঠান প্রিয় হয়ে যাচ্ছে এটা আংশিক মেনে নেয়া যায়। কিন্তু এভাবেই যদি চলতে থাকে তাহলে কিছুদিন পর আর কোন দেশী অনুষ্ঠানই খুঁজে পাওয়া যাবে না।
×