ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জঙ্গী গ্রুপগুলোর মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিয়েছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী

প্রকাশিত: ১১:১১, ৪ জানুয়ারি ২০২০

জঙ্গী গ্রুপগুলোর মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিয়েছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী

শংকর কুমার দে ॥ সদ্য সমাপ্ত ২০১৯ সালে সারাদেশে জঙ্গী দমনে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তিনটি ইউনিট। এই তিনটি ইউনিট মিলে গ্রেফতার করেছে ৭ জঙ্গী সংগঠনের ৩২৫ জঙ্গীকে। গ্রেফতার হওয়া সদস্যদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে জঙ্গী তৎপরতায় ব্যবহৃত বিস্ফোরক, ককটেল, হাতবোমা, আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ, পুস্তিকা, খেলনা পিস্তল, দেশী-বিদেশী ছুরি, মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, বিভিন্ন লিফলেট এবং নগদ টাকা। জঙ্গী বিরোধী অভিযান পরিচালনাকারী তিন ইউনিট হচ্ছে ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি), র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) ও পুলিশের এ্যান্টি টেররিজম ইউনিট। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জঙ্গী বিরোধী অভিযানের মুখে জঙ্গী সংগঠনগুলোর মেরুদ- ভেঙ্গে গেছে, মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারেনি। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে এ খবর জানা গেছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে যে ৭ জঙ্গী সংগঠনের জঙ্গীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়েছে তার মধ্যে আছে আল্লাহর দল, হরকত-উল-জিহাদ বাংলাদেশ (হুজিবি), নব্য জেএমবি, পুরনো জেএমবি, আনসার আল ইসলাম, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, হিজবুত তাহরীর। এই জঙ্গী সংগঠনগুলোর মেরুদ- এমনভাবে ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে যে তাদের নাশকতা চালানোর মতো জনবল, রসদ, নেতৃত্ব প্রায় শূন্যের কোটায়। জঙ্গী সংগঠনগুলো খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছে। তবে সংগঠন দুর্বল হলেও অসংখ্য মানুষ বিশেষ করে তরুণ ও যুবক শ্রেণীকে র‌্যাডিক্যালাইজড করতে সক্ষম হচ্ছে জঙ্গী সংগঠনগুলো। জঙ্গী সদস্যরা যখনই নাশকতার পরিকল্পনা নিয়ে উদ্যোগী হচ্ছে তখনই গ্রেফতার হচ্ছে। জঙ্গী সংগঠনগুলোর ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি উগ্রতার দিকে ধাবিত হওয়া অব্যাহত আছে। এই ধরনের পরিস্থিতির মধ্যেই জঙ্গী বিরোধী অভিযানে গ্রেফতার হতে বাধ্য হচ্ছে জঙ্গী সদস্যরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তিন ইউনিটের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, ২০১৯ সালে ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি), র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) ও পুলিশের এ্যান্টি টেররিজম ইউনিট সাতটি জঙ্গী সংগঠনের ৩২৫ জঙ্গী সদস্যকে গ্রেফতার করেছে। এ সময় জঙ্গী তৎপরতায় ব্যবহৃত বিস্ফোরক, ককটেল, হাতবোমা আগ্নেয়াস্ত্র, পুস্তিকা, খেলনা পিস্তল, দেশী-বিদেশী ছুরি, মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, বিভিন্ন লিফলেট এবং নগদ টাকা জব্দ করা হয়। গ্রেফতার হওয়া জঙ্গী সদস্যরা বলেছে তারা হচ্ছে আল্লাহর দল, হরকত-উল-জিহাদ বাংলাদেশ (হুজিবি), নব্য জেএমবি, পুরনো জেএমবি, আনসার আল ইসলাম, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, হিজবুত তাহরীর সদস্য। র‌্যাবের এক কর্মকর্তা বলেন, বছরজুড়ে দেশব্যাপী জঙ্গী বিরোধী অভিযান অব্যাহত রাখার ফলে সাংগঠনিকভাবে জঙ্গীরা দুর্বল হয়ে যায়। মনোবল ভেঙ্গে গিয়ে তাদের শক্তি কমে যায়। তাদের নাশকতা চালানোর শক্তিও হ্রাস পায়। তবে সংগঠনের বাইরেও উগ্র তৎপরতা বিদ্যমান থাকে। তারা গোপনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নাম-পরিচয়বিহীন ঠিকানা বা এ্যাপস ব্যবহার করে এই ধরনের জঙ্গী তৎপরতা চালায়। তবে এই ধরনের অপতৎপরতাও বেশিদিন থাকে না। তাদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে হবে, যেটা খুবই কঠিন কাজ। গত বছরে যত গ্রেফতার হয়েছে তাদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যানুযায়ী আরও অনেক জঙ্গী তৎপর আছে গোপনে। জঙ্গী গ্রেফতারে র‌্যাবের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, র‌্যাবের ব্যাটালিয়নগুলো ২০১৯ সালে সারাদেশে ১১৫টি জঙ্গীবিরোধী অভিযান পরিচালনা করেছে। অভিযানে গ্রেফতার ২৩৮ জনের মধ্যে জামাত-উল-মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সদস্য রয়েছে ৮৭ জন। বাকিরা বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের। ১১৫টি অভিযানে এসব জঙ্গীর কাছ থেকে এ সময় উদ্ধার করা হয়েছে পাঁচটি আগ্নেয়াস্ত্র, ছয়টি ম্যাগাজিন, ১৩ রাউন্ড গোলাবারুদ বা গুলি এবং ২৪টি ককটেল ও গ্রেনেড। ২০১৯ সালের ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশ থেকে বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের ২৩৮ জঙ্গীকে গ্রেফতার করেছে এই এলিট ফোর্স। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ইউনিটগুলোর মধ্যে ২০১৯ সালে তারাই সবচেয়ে বেশি জঙ্গী গ্রেফতার করেছে। জঙ্গী দমনে পুলিশের বিশেষ ইউনিট এ্যান্টি টেররিজম ইউনিট ২০১৯ সালে সারাদেশ থেকে ৩৪ জঙ্গী গ্রেফতার করেছে। এর মধ্যে নব্য জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, আনসার আল ইসলাম, হুজি-বি, আল্লাহর দল ও হিজবুত তাহরীর সদস্য রয়েছে। এ্যান্টি টেররিজমের তথ্য অনুয়ায়ী, ২০১৯ সালে ১৪টি মামলা করেছে এ্যান্টি টেররিজম ইউনিট। এতে আসামির সংখ্যা ১শ’র বেশি। এদের মধ্যে ৩৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে অস্ত্র, বিস্ফোরক ও জঙ্গীদের বিভিন্ন পুস্তিকা। জঙ্গী দমনে গঠিত ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট ২০১৯ সালজুড়ে বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের ৫৩ জঙ্গী সদস্যকে গ্রেফতার করে। এরমধ্যে নব্য জেএমবির ২১ জন, আনসার আল ইসলামের ১৬ জন, হিজবুত তাহরীরের ৭ জন এবং হরকত-উল-জিহাদের ৯ সদস্য রয়েছে। পুলিশের এ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেন, গত বছরে জঙ্গী সংগঠন দুর্বল হওয়ার পরও গ্রেফতার অভিযান থেমে নেই। তবে জঙ্গী সংগঠনগুলোর অসংখ্য সদস্য র‌্যাডিক্যালাইজড হয়ে আছে। তারা যখন নাশকতা ও উগ্র কার্যক্রমের পরিকল্পনা করে তখনই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে ধরা পড়ছে। অনেকে সেলফ র‌্যাডিক্যালাইজড হয়ে নাশকতার পরিকল্পনা করে। তারা সাংগঠনিকভাবে জঙ্গী সংগঠনে না থাকলেও তারা উগ্র। তাদেরও গ্রেফতার করা হচ্ছে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেন, ২০১৯ সালে রাজধানী ঢাকায় পুলিশের ওপর পাঁচটি ধারাবাহিক বোমা হামলা করেছে জঙ্গীরা। শ্রীলঙ্কা ও নিউজিল্যান্ডে হামলার পর জঙ্গীরা অনুপ্রাণিত হয়ে নাশকতা চালাতে চেয়েছিল। পুলিশের ওপর পাঁচটি হামলার ঘটনা চিহ্নিত করে জড়িত জঙ্গীদের গ্রেফতার করেছি। ২০১৬ সালে দেশ-বিদেশে বহুল আলোচিত গুলশান হলি আর্টিজানে যে হামলা চালানো হয়েছিল, সেরকম সক্ষমতা জঙ্গী সংগঠনের নেই এবং বিগত ৩ বছরে তারা সেই ধরনের কোন জঙ্গী হামলাও করতে পারেনি। জঙ্গী সংগঠনগুলোর বড় ধরনের নাশকতা চালানোর মতো সামর্থ্য বা শক্তি তাদের নেই। জঙ্গী সংগঠনগুলোকে মদদদান, ইন্ধন, আর্থিক সহায়তাসহ জঙ্গী তৎপরতার উৎসস্থলের চিহ্নিতকরাসহ তৎপর জঙ্গীদের গ্রেফতারের বিষয়ে অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট কর্মকর্তার দাবি।
×