ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাগদাদে মার্কিন হামলায় ইরানী জেনারেল নিহত

প্রকাশিত: ১১:০৭, ৪ জানুয়ারি ২০২০

বাগদাদে মার্কিন হামলায় ইরানী জেনারেল নিহত

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ ইরাকের বাগদাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মার্কিন হামলায় ইরানের দ্বিতীয় জনপ্রিয় ব্যক্তি ও দেশটির বিপ্লবী গার্ডস বাহিনীর অভিজাত কুদস ফোর্সের কমান্ডার লে. জেনারেল কাশেম সোলাইমানিসহ সাতজন নিহত হয়েছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে ওই হামলা চালানো হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে পেন্টাগন। বিপ্লবী গার্ডস জেনারেল কাশেমের মৃত্যুর খবর স্বীকার করে ইরান বলেছে মার্কিন হেলিকপ্টার থেকে হামলা চালিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। এই হত্যার পর ভয়ঙ্কর প্রতিশোধের হুমকি দিয়েছেন দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। খবর বিবিসি, সিএনএন, আলজাজিরা ও পার্সটুডে। শুক্রবার ভোরে ওই হামলায় নিহতদের মধ্যে ইরাকী মিলিশিয়া গ্রুপ পপুলার মোবিলাইজেশন ইউনিটের কমান্ডার আবু মাহদি আল-মুহান্দিসও রয়েছেন। বাগদাদে বিমানবন্দরের কার্গো টার্মিনালের কাছে দুটো গাড়িতে মার্কিন হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া তিনটি রকেট আঘাত হানে। এর মধ্যে একটি গাড়িতে ছিলেন জেনারেল সোলাইমানি ও মিলিশিয়া নেতা আল-মুহান্দিস। আর তাদের নিরাপত্তার জন্য ইরাকের প্যারা মিলিটারি ফোর্সের সদস্যরা ছিলেন দ্বিতীয় গাড়িতে। ইরান সমর্থিত মিলিশিয়া বাহিনীর ঘাঁটিতে মার্কিন হামলায় ২৫ জন নিহত হওয়ার পর বাগদাদে মার্কিন দূতাবাসে হামলা-ভাংচুরের দুই দিনের মাথায় এ ঘটনা মধ্যপ্রাচ্য ঘিরে উত্তেজনাকে নতুন মাত্রা দেবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। ইরানের সশস্ত্রবাহিনীতে জেনারেল কাশেম সোলাইমানি ছিলেন একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, রাষ্ট্রীয়ভাবে তাকে দেয়া হতো জাতীয় বীরের সম্মান। তার কুদস ফোর্স কাজ করে মূলত বিপ্লবী রক্ষী বাহিনীর ‘ফরেইন উইং’ হিসেবে। এই বাহিনী জবাবদিহি করে সরাসরি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির কাছে। পেন্টাগনের বিবৃতিতে বলা হয়, ট্রাম্পের নির্দেশে মার্কিন বাহিনী বিদেশে তাদের সদস্যদের সুরক্ষার স্বার্থে ‘প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসেবে’ কাশেম সোলাইমানিকে হত্যা করেছে। ইরানের ভবিষ্যত হামলা পরিকল্পনা নস্যাত করে দেয়াই ছিল এই আক্রমণের উদ্দেশ্য। বিশ্বের যেখানেই আমাদের নাগরিক ও সম্পদ রয়েছে, তা রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সব রকম ব্যবস্থাই যুক্তরাষ্ট্র নেবে। জেনারেল কাশেম সোলাইমানির মৃত্যুর ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বাড়বে বলে এক প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছে রাশিয়া। বৃহস্পতিবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে হত্যা করা হয় ইরানের প্রভাবশালী সামরিক কমান্ডার সোলাইমানিকে। এরপরই শুক্রবার রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা বাড়ার ওই সতর্কবার্তা দিয়েছে। সোলাইমানির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে বড় ধরনের সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ মার্কিন হামলার ঘটনাকে ‘আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ’ আখ্যা দিয়েছেন। এ ঘটনার ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ নেয়ারও হুমকি এরই মধ্যে দিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। ফলে সোলাইমানি নিহতের ঘটনাটি কেবল ইরাকের জন্যই নয়, সামগ্রিক মধ্যপ্রাচ্যের জন্যই বড় টার্নিং পয়েন্ট হতে চলেছে। পুরো অঞ্চলে ঘনিয়ে আসতে চলেছে ছায়াযুদ্ধের এক নতুন অধ্যায়। এদিকে কুদস ফোর্সের প্রধান কাশেম সোলাইমানিকে যারা হত্যা করেছে সেই ‘অপরাধীদের’ জন্য ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ অপেক্ষা করছে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। শুক্রবার ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন সোলাইমানির মৃত্যুতে তিনদিনের ‘রাষ্ট্রীয় শোকের’ ঘোষণাও দিয়েছে। খামেনি বলেন, সব শত্রুদেরই জেনে রাখা উচিত, প্রতিরোধ বাহিনীর জিহাদ দ্বিগুণ উদ্যোমে অগ্রসর হবে। অবশ্যই পবিত্র এ যুদ্ধে যোদ্ধাদের জন্য নিশ্চিত বিজয় অপেক্ষা করছে। ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াইরত মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সশস্ত্র শক্তিকে ইরান প্রায়ই ‘প্রতিরোধ বাহিনী’ হিসেবে অ্যাখ্যা দিয়ে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে এ প্রতিরোধ বাহিনীর বিকাশ এবং ইরানের প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে মেজর জেনারেল সোলাইমানিকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবেই বিবেচনা করা হতো। ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর ‘বিদেশী শাখা’ হিসেবে কাজ করা কুদস ফোর্স সরাসরি সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার কাছে জবাবদিহি করত। এছাড়া ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি বাগদাদের বিমানবন্দরে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলাকে জঘন্য অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করে প্রতিশোধ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেন, সোলাইমানি ছিলেন ইরানে জনপ্রিয় একজন সামরিক ব্যক্তিত্ব। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের কাছে তিনি ছিলেন বিপজ্জনক শত্রু। সোলাইমানির পদে নিয়োগ পেলেন ডেপুটি ইসমাইল গনি ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলায় ইরানের ইসলামী বিপ্লবী রক্ষী বাহিনীর (আইআরজিসি) কুদস ফোর্স কমান্ডার লে. জেনারেল কাশেম সোলাইমানি নিহত হওয়ার পর ওই পদে স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন তারই এক সময়ের সহকারী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইসমাইল গনি। শুক্রবার গনিকে এ পদে নিয়োগ দেন দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি। মার্কিন নাগরিকদের ইরাক ছাড়ার নির্দেশ ওয়াশিংটনের ইরানের শীর্ষ জেনারেল কাশেম সোলাইমানিকে হত্যার পর শুক্রবার বাগদাদ দূতাবাস ইরাকে অবস্থানরত মার্কিন নাগরিকদের অবিলম্বে দেশটি ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছে। ইরানের কুদস ফোর্সের নেতাকে হত্যার পর পাল্টা আঘাতের আশঙ্কায় এই নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইরাক ও অঞ্চলটিতে উত্তেজনা বৃদ্ধির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস আমেরিকার নাগরিকদের ২০২০ সালের ভ্রমণ নির্দেশিকা মেনে চলা এবং অবিলম্বে ইরাক ত্যাগের আহ্বান জানাচ্ছে। মার্কিন নাগরিকদের সম্ভব হলে বিমানে ভ্রমণ করা উচিত। এটি সম্ভব না হলে সড়ক পথে অন্য দেশে চলে যান। কুদস ফোর্সের প্রধান ও ইরাকের মিলিশিয়া কমান্ডার আবু মাহদি আল-মুহান্দিসকে বিমান হামলায় হত্যার কয়েক ঘণ্টা পর এই নির্দেশনা জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। জো বাইডেনের প্রতিক্রিয়া এদিকে এই হত্যাকা-কে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘খড়ের গাদায় আগুন দিয়েছেন’ বলে মন্তব্য করেছেন দেশটির আসছে নির্বাচনের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী প্রবীণ রাজনীতিবিদ জো বাইডেন। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে বাগদাদ বিমানবন্দরে মার্কিন হামলায় ইরানী জেনারেল কাশেম সোলাইমানি নিহত হওয়ার পর এ কথা বললেন বাইডেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক দুই বারের ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বিবৃতিতে বলেন, মার্কিন প্রশাসন বিবৃতিতে বলেছে, এই হামলার লক্ষ্য ইরানের ভবিষ্যতের আক্রমণ প্রতিরোধ করা। কিন্তু আমি বলব, এই পদক্ষেপটি অবশ্যই প্রায় বিপরীত প্রভাব ফেলবে। মধ্যপ্রাচ্যকে যুদ্ধে ঠেলে দেবে- ডেমোক্র্যাট ইরানী জেনারেল কাশেম সোলাইমানিকে হত্যা নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছে মার্কিন কংগ্রেস। ট্রাম্পের এমন নির্দেশনাকে কেউ স্বাগত জানিয়েছে, কেউ করছেন সমলোচনা। ট্রাম্পের মিত্র রিপাবলিকানরা এই পদক্ষেপের প্রশংসা করে বলেছে, এতে ইরানকে কঠিন বার্তা দেয়া হয়েছে। তবে ডেমোক্র্যাটরা সমালোচনা করে বলেছেন, ট্রাম্পের ঔদ্ধত্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত আরেকটি মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে। বৃহস্পতিবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে হত্যা করা হয় ইরানের প্রভাবশালী সামরিক কমান্ডার কাশেম সোলাইমানিকে। সাউথ ক্যারোলিনার সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম একাধিক টুইট করে জানান, ‘মার্কিন রক্তে রঞ্জিত ইরান বড় এক ধাক্কা খেয়েছ। আয়াতুল্লাহর প্রশাসনে অন্যতম হিংস্র সদস্য ছিলেন সোলাইমানি।’ তবে ডেমোক্র্যাটরা এই পদক্ষেপকে সহজভাবে নেয়নি। তারা মনে করছে এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। বেড়ে যাবে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সৈন্য ও তাদের পেছনে ব্যয়। সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স বলেন, ট্রাম্পের এমন বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত আমাদের আরেকটি মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এতে অনেক প্রাণ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। খরচ হবে কোটি কোটি ডলার। ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এই অসীম যুদ্ধ শেষ করবেন। কিন্তু তার এই পদক্ষেপ তার পরিপন্থী। ১৯৯৮ সাল থেকে মেজর জেনারেল কাশেম সোলাইমানি ইরানের কুদস ফোর্সের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ইরান বিপ্লবী গার্ডসের এই অভিজাত বাহিনীটি দেশের বাইরে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে থাকে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বাশার আল-আসাদের ইরান সমর্থিত সরকারকে মদদ দেয়া এবং ইরাকে ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন জেনারেল সোলাইমানি। ১৯৮০-এর দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় দায়িত্ব পালন করার সময় তিনি প্রথম পরিচিতি লাভ করেন। তেলের দাম বাড়ল ৪ শতাংশ সোলাইমানি নিহতের পর বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বেড়েছে ৪ শতাংশের বেশি। মার্কিন হামলার পর মধ্যপ্রাচ্যের তেল সরবরাহে বিঘœ ঘটার আশঙ্কায় কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তেলের বাজারে মূল্যসূচক উর্ধমুখী হয়েছে।
×