ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বুড়ো মা’র খেয়াঘাট

প্রকাশিত: ০৯:৩২, ৪ জানুয়ারি ২০২০

বুড়ো মা’র খেয়াঘাট

গোপালগঞ্জসহ আশপাশ এলাকার ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে অতি পরিচিত নাম বুড়ো মা’র খেয়াঘাট। এটি গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার রঘুনাথপুর গ্রামের শতাধিক বছরের পুরনো একটি ধর্ম খেয়াঘাট। এখানে রয়েছে বিনা পয়সায় পারাপারের সেই খেয়া নৌকা, যেটি ধর্ম খেয়া নামেই সবার কাছে পরিচিত। এই ধর্ম খেয়াঘাট-সংলগ্ন বিশাল বটবৃক্ষের তলায় রয়েছে বুড়ো মায়ের মন্দির, যেখানে প্রতিনিয়ত ভিড় করেন সব ধর্মের বিভিন্ন বয়সের মানুষ। কোন কঠিন সমস্যা বা কোন মনষ্কামনা নিয়ে সেখানে গিয়ে বুড়ো মায়ের কাছে প্রার্থনা রাখলে সে সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় বা মনষ্কামনা পূর্ণ হয়- এমন বিশ্বাস নিয়েই মানুষ সেখানে যান। মন্দিরের চারপাশে প্রদক্ষিণ করে প্রণাম জানান মায়ের পায়ে। আর মোমবাতি ধূপকাঠি জ্বালিয়ে প্রার্থনা জানান তার কাছে। প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় পূজা-অর্চণাসহ যাবতীয় দেখভাল করেন মন্দিরের পুরোহিত স্বপন ম-ল। আশপাশের বহু ভক্ত রয়েছেন, যারা সুযোগ পেলেই বাদ্য-বাজনা নিয়ে হাজির হন সেখানে। মন্দির সম্মুখে বসে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক গান-বাজনা করে আবার নিজেদের মতোই ফিরে আসেন। গোপালগঞ্জ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ভক্তবৃন্দসহ সাধারণ মানুষ সেখানে যাচ্ছেন পুণ্য লাভের আশায়। শনিবার ও মঙ্গলবার ভক্ত-সমাগম ঘটে সবচেয়ে বেশি। একসময় সেখানে ছিল বহু বছরের পুরনো জঙ্গল-বেষ্টিত একটি শ্মশান ঘাট। শতাধিক বছর আগে এলাকার কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত মৃতপ্রায় মথুরানাথ ঠাকুর পরিবারের কাউকে কিছু না জানিয়ে কোনরকমে গিয়ে অবস্থান নেন ওই শ্মশানে। পরিবারের লোকজন তাকে ফিরিয়ে আনতে গেলেও তিনি সেখান থেকে ফেরেননি এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সেখানেই থাকবেন বলে সবাইকে ফিরিয়ে দেন। কিন্তু প্রায় এক মাস পর অলৌকিকভাবে তিনি সেখান থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন। বাড়ির হতবাক লোকজনদের তিনি তখন জানান বুড়ো মায়ের অস্তিত্ব ও আশীর্বাদের কথা এবং নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসার বর্ণনা। এরপর তিনি বুড়ো মায়ের কথা অনুযায়ী ওই ঘাটে প্রতিষ্ঠা করেন ধর্ম খেয়া; শুরু হয় বিনা পয়সায় পারাপার। সেইসঙ্গে তিনি ওই বটতলায় প্রতিষ্ঠা করেন বুড়ো মায়ের মন্দির। শুরু হয় মায়ের পূজা। ধীরে ধীরে চারদিকে এ খবর ছড়িয়ে পড়ে এবং দূর-দূরান্ত থেকেও দুরারোগ্য ব্যাধি নিয়ে মানুষ সেখানে আসতে শুরু করেন। সেই থেকে অদ্যাবধি মানুষ সেখানে যাওয়া-আসা করেন এবং মায়ের কাছে প্রার্থনা জানিয়ে ধর্ম খেয়া নৌকা থেকে জল নিয়ে তা খেয়ে দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তি লাভ করেছেন অনেকেই। আর এভাবেই বুড়ো মায়ের খেয়া ঘাটের নাম ছড়িয়ে পড়ে চরিদিকে। মথুরানাথ ঠাকুরের জীবনাবসানের পর তার রেখে যাওয়া নির্দেশানুযায়ী তার বংশীয় কাউকে না কাউকেই এ মন্দিরের পূজা-অর্চণাসহ যাবতীয় সব দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। তার জীবনাবসানের পর তার ছেলে চুনি লাল ঠাকুর এবং এরপর তার ছেলে রূপ সনাতন ঠাকুর সেখানে পৌরহিত্য করে গেছেন। বর্তমানে আছেন তার ছেলে স্বপন কুমার ঠাকুর। তিনি সেখানে পৌরহিত্য করছেন বিগত ৩৫ বছর ধরে। আর ভক্তবৃন্দসহ সাধারণ মানুষও সেখানে যাওয়া-আসা করেন সেই বিশ্বাসটুকু নিয়ে। প্রতিবছর বাংলা সনের ৪ পৌষ সেখানে বিশাল আকারে উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয় বার্ষিক পূজা। উৎসবে যোগ দিতে ভোর থেকেই সেখানে ঢল নামে ভক্তবৃন্দসহ দূর-দূরান্ত থেকে আগত হাজারো মানুষের। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ জড়ো হন বুড়ো মা’র মন্দিরে প্রণাম জানাতে। ঢাক, ঢোল, খোল, করতাল ও কাশ বাজিয়ে আলতি করে সবাই পূজার্চনা করেন। সুস্থতা লাভের আশায়, পূণ্য ফলের আশায় সকলে ধর্ম-খেয়া নৌকার জল মুখে নেন, মাথায় নেন। বোতলে ভরেও নিয়ে যান পরিবারের সবার জন্য; আর প্রার্থনাভরে প্রণাম জানান বুড়ো মা’কে। এ উৎসবের দিনে মন্দির প্রাঙ্গণে লালনগীতি পরিবেশন করে থাকেন লালন শিল্পীরা। মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, নড়াইল, খুলনা, বরিশাল, পিরোজপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ এসে যোগ দেন বুড়ো মা’র এ উৎসবে। পূজা শেষে ভক্তদের মধ্যে প্রসাদ বিতরণ করা হয়। পূজা উপলক্ষে সেখানে বসে গ্রামীণ মেলা। উৎসবমুখর পরিবেশ বজায় রাখতে পুলিশী নজরদারিও থাকে সেখানে। মন্দিরের পুরোহিত স্বপন কুমার ঠাকুর জানান, অন্যবারের তুলনায় এবারে ভক্তবৃন্দের সমাগম আরও বেশি হবে। -নীতিশ চন্দ্র বিশ্বাস, গোপালগঞ্জ থেকে
×