ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বগুড়ার ঔষধি গ্রাম

প্রকাশিত: ০৯:৩১, ৪ জানুয়ারি ২০২০

বগুড়ার ঔষধি গ্রাম

ফেলে দেয়া পাতা, পতিত ভূমি ও আইল গ্রামের গরিব মানুষকে আয়ের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কমছে দারিদ্র্য। দেশ অতি দ্রুত জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জনে পৌঁছাচ্ছে। নারীর ক্ষমতায়নের শাখা-প্রশাখার বিস্তার ঘটছে। নারী বুঝতে পেরেছে কিভাবে সমৃদ্ধ হওয়া যায়। এরা আর ঋণ নিয়ে বোঝা বাড়াতে চায় না। পথের ধারে, নদী তীরে, ঝাউবনে, আঙিনার কোনায় অযতনে বেড়ে ওঠা চেনা ও অচেনা কিছু গাছ লতাপাতা দারিদ্র্য বিমোচনের সঙ্গে মানব কল্যাণের পথ চিনিয়েছে। গ্রামের পথেঘাটে অতীতে ঔষধি গাছ এমনিতেই জন্মাতো। এসব গাছগাছালির ঔষধি গুণাগুণ ও বাণিজ্যিক মান জেনে গ্রামের লোক এখন অবাক। পাতা শুকিয়ে ও শিকড় বেঁচে অনেক পরিবারের আয় বেড়েছে। সড়কের দুই ধারে প্রয়োজনীয় অনুমতি ও নাম মাত্র মূল্যে ইজারা নিয়ে যত কিলোমিটার সম্ভব এবং জমির আইলে, পতিত কোন ভূমিতে, গৃহস্থ ও কিষান বাড়ির উঠানের ধারে চারা রোপণ করা যায। উত্তরাঞ্চলের গ্রামে রাস্তার দুই ধারে চোখে পড়ে বাসক তুলসী কালোমেঘ অশ্বগন্ধা ও শতমূলীসহ অন্যান্য গাছ। ঔষধি এসব গাছ গ্রামের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়নে এবং নেতৃত্বে বড় ভূমিকা রেখেছে। বছর দশেক আগে যে বাসক পাতা বিক্রি হতো ৭/৮ টাকা কেজি দরে তা এখন বিক্রি হয় ৪০ থেকে ৫০ টাকা দরে। ওষুধ কোম্পানিগুলো গ্রামে গিয়ে ঔষধি গাছের পাতা সংগ্রহ করছে। বিপণনের নিশ্চয়তা পেয়ে অনেক কৃষক এখন নিজে ধান পাট আখ ভুট্টা শাকসবজি আবাদের পর রাস্তার দুই ধারে জমি ও আইলের ওপর ঔষধি গাছ লাগিয়েছে। মাঠপর্যায়ে প্রশিক্ষণ পরামর্শ সহযোগিতা দিয়ে উদ্বুদ্ধকরণের কাজ করছে সরকারী সংস্থাসহ কয়েকটি বেসরকারী সংস্থা। সূত্র জানায়, উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের জেলাগুলোর পাশপাশি পূর্বাঞ্চলের সুনামগঞ্জসহ কয়েকটি জেলার মানুষ এখন অনেক ঔষধি গাছ চিনে আবাদ করছে। যাদের ৮০ শতাংশই নারী। গ্রামের গৃহস্থ ও কৃষক আবাদি ভূমির বাইরে ফেলে রাখা জায়গায় ঔষধি গাছ লাগিয়ে গাছের পাতা বেচে আয়ের অঙ্ক বাড়িয়ে নিয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি,) পৌর সভা, জেলা পরিষদ, সড়ক ও জনপথ বিভাগের কাছ থেকে রাস্তার ধারের পতিত জায়গা নিয়ম অনুযায়ী লিজ নিয়ে ঔষধি গাছ লাগাচ্ছে। আগে বিচ্ছিন্ন ভাবে কোন বৃক্ষপ্রেমী ঔষধি গাছের বাগান করত। এখন বৃক্ষ পরিচর্যা থেকে উৎপাদন এবং পাতা শুকিয়ে বিপণন পর্যন্ত প্রতিটি পয়েন্টে কাজ করে নারী ও পুরুষ কৃষক। পাতার মান নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি তাদের শেখানো হয়েছে। কখনও সমবায়ের ভিত্তিতে গাছ রোপণ হয়। এরা বীজ চারা সংগ্রহ করে রোপণের পর উৎপাদন ও বিপণন প্রক্রিয়ায় সরাসরি অংশ নেয়। ঔষুধি উদ্ভিদ চাষাবাদ করে আয়ের পথ খুঁজে পেয়েছে বগুড়া সদরের লাহিড়িপাড়া নামুজা ও নুনগোলা ইউনিয়নের কৃষক। অন্তত ১০ হাজার নারী-পুরুষ এ ঔষুধি উদ্ভিদ চাষাবাদ করে নিজেদের সংসারের বাড়তি আয় করছেন। লাহিড়ীপাড়ার পরিচিতি এখন ঔষুধি গ্রাম। প্রতিমাসে এই তিন ইউনিয়ন থেকে প্রায় ৫ হাজার কেজি ঔষুধি লতাপাতা সংগ্রহ করে ভেষজ ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। বাসক পাতা ৫/৬ ইঞ্চি। পাতা ও কা- দেখতে সবুজ। রোপণের ৪ মাসের মধ্যে পাতা সংগ্রহ করা যায়। তুলসী, কালোমেঘ, অশ্বগন্ধা ও শতমুল উঁচু বা নিচু জমিতেও চাষ হয়। লাহিড়ীপাড়ার ইউনুস আলী জানান, গোবর সারের ওপর নির্ভর করে বাসক পাতার আবাদ হয়। তিনি প্রায় দুই কিলোমিটার পথের ধারে বাসক চারা লাগিয়েছেন। মাঝারি গাছ থেকে বেশি পাতা পাওয়া যায়। প্রতি কেজি পাতা এখন ৩৫ থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। অশ্বগন্ধা পাতা ও ফল মান ভেদে ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা কেজি। কালোমেঘ ৫০, তুলসী ৫০, শতমূল ২০ থেকে ২৫ টাকা কেজি বিক্রি হয়। নামুজা ইউনিয়নের হুকুমাপুর গ্রামের আব্দুল গফুর জানান, এক গাছ থেকে দীর্ঘদিন পাতা সংগ্রহ করা যায়। ২/৩ বছর পর গাছগুলো ছেঁটে দিলে আবারও নতুন পাতা গজায়। প্রতিমাসে প্রায় ২ মণ বাসক পাতা বিক্রি করেন। একই সময়ে অশ্বগন্ধার শিকড় বিক্রি করেন অন্তত ৫০ কেজি। কালোমেঘের গোটা গাছই বিক্রি করা হয়। গাইবান্ধা ও নাটোর থেকে ঔষুধি চারা সংগ্রহ করা হয়। এখন বগুড়ায় চারা তৈরি হচ্ছে। লাহিড়ীপাড়া গ্রামের আকলিমা জানালেন পাতা বেচে তিনি ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ যোগাচ্ছেন। দীঘলকান্দি গ্রামের ইউনুস আলী বললেন এক কিলোমিটার রাস্তায় বাসক তুলসী পাতা বেচে টিনশেডে ইটের ঘর দিয়েছেন। গাইবান্ধার পলাশবাড়ি উপজেলার মোহদীপুর গ্রামের প্রায় প্রত্যেক পরিবার ধান পাট গম আলু সবজি আবাদের পাশাপাশি রাস্তার ধারে ঔষধি গাছের চাষ করছে। ববিতা রানী সরকার বললেন, পুরুষ এখন নারীর ওপর চোখ রাঙায় না। নারী কৃষি কাজে পরামর্শ দিচ্ছে। রফিকুল ইসলাম বললেন, এক কিলোমিটার রাস্তার দুই ধারে ২ হাজার ৩শ’ ৪৬টি চারা রোপণ করেন। চারা কম্পোস্ট সার মজুরি ও অন্যান্য খরচ মিলে মোট ২৩ হাজার ২শ’ টাকা। এরপর এক কেজি করে শুকনো পাতা ৪০ টাকা দরে বেচে ৯৩ হাজার ৯শ’ ৪০ টাকা পেয়েছেন। উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে টেকে ৭০ হাজার ৬শ’ ৪০ টাকা। তুলসী কালোমেঘ গাছের পাতা একই প্রক্রিয়ার উৎপাদন ও বিপণন হয়। গ্রামে ঔষধি গাছগুলোর স্থানীয় নামও আছে। যেমন বাসক পাতার নাম ‘হাড় বাকস’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসিউটিক্যাল ও টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক বললেন ফামের্সি বিভাগের অনেক শিক্ষার্থী এখন এলাকায় গিয়ে ঔষধি গাছের চারা রোপণ করে বাড়তি আয় করছে। দীর্ঘদিনের ঠাণ্ডা, কাশি বা শ্বাসকষ্টের জন্য ব্যবহার করা হয় বাসক পাতা। আর এসিডিটি, পেটের বিভিন্ন পীড়া, আমাশয় রোধে কালোমেঘ ব্যবহার করা হয়। তুলসী সব ওষুধ তৈরিতে কমবেশি লাগে। শক্তি বর্ধকের জন্য অর্শ্বগন্ধা বেশি কাজে লাগে। এ ছাড়াও প্রতিটি ঔষুধি উদ্ভিদের বহুমুখী গুনাগুন আছে। বিশ্বের দেশে দেশে ভেষজ ওষুধের চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতিটি সরকারী হাসপাতালে ভেষজ চিকিৎসার আলাদা ইউনিট আছে। -সমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×