ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শাহমুব জুয়েল

অন্তরলোকের স্বর

প্রকাশিত: ০৭:৫১, ৩ জানুয়ারি ২০২০

অন্তরলোকের স্বর

স্বতন্ত্র কাব্যভাষার কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। জন্ম : ১৯৪৮ সালে, ৩১ ডিসেম্বর ফরিদপুর। ষাটের দশকের কবি তিনি প্রকৌশলী হয়েও বাংলা সাহিত্যে কবিতার মতো শাখায় বীরদর্পে বিচরণ করছেন। তাঁর কবিতার ঢঙে স্বতন্ত্রভাব অতুলনীয়। কবি সমাজ রাষ্ট্র প্রকৃতি প্রেম চেতনা আদর্শ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে কবিতাকে মাধ্যম করে গল্পের মতো উপস্থাপন করেন। পাঠক কবিতা পঠনের সময় একটি গল্পের ভেতরে ঢুকে কবির আত্মচরিতের পাশাপাশি নিজেকে এবং চলমান সমাজের মানবশ্রেণীর খুঁজে পায়। এমনই একটি কবিতার বই ‘আমার একজনই বন্ধু’ (১৯৮৭)। এ গ্রন্থে কবিতার সংখ্যা আটাশটি। কবিতাগুলো হলো আমার একজনই বন্ধু, পবনজয় দাসের শীতল পাটি, কুকুর-বিড়ালের রচনা, ক্রোধ এক প্রকার অর্জুনের ডাল, চার ভালুকের দুটি পা, সংসারে অনন্ত ভ্রমণ, মদ বিক্রেতা ও টিয়াপাখি, অসহায় মধ্যদিন, চুইংগাম, আমার সম্পর্কে, প্রণালী, ভালই ছিল ভাল, মন্ত্র, তোমার কীর্তি কাটা তোমার, খোঁজাখুঁজি, এ্যালবাম, হরণ, শীতলতা কিংবা শৈত্য, দে খুলে দুয়ার, এক জীবনের মহাজীবন, নারী, নীল ময়ূরী, জয়, ফিরে যাবে তা কেন হবে, বাইরে বৃষ্টি, শ্রাবণের পূরবীয়, প্রিয় বর্ণমালা প্রভৃতি। আত্মচরিত সাঁকো নির্মাতার কবি। কবিতায় দুই পাড়ের সংযোগ করে স্কেচ তৈরি করে বিভিন্ন উপকরণের সমাবেশে নিজেকে পেশ করেছেন। অতীত বর্তমান এবং মৃত্যুর পরও তাঁর দৃষ্টি প্রসারিত হবে। জীবনের ছায়াসঙ্গী বিশ্বাস অবিশ্বাসের রেখাচিত্রে ধাবিত। জীবনের বাঁকবদল সংসারযাত্রা এবং স্বপ্ন ফেরিওয়ালার মতো শুধু দেখেননি বিপরীতকালকে ধরে সরলবর্গীয় চিন্তনে মেলবন্ধন করেছেন। সুনিপুণ কাব্যশিল্পীর মতো সময়কে ধরে আবেগীয় শব্দমালায় ঢেউ সৃষ্টি করে বাস্তব স্কেচ এঁকেছেন। তিনি কেবলই শিল্পী নন শিল্পীসত্তাও। মানুষের জন্ম ও জীবনযাত্রা উৎসবসদৃশ। পৃথিবীর কোলে মুখ এলেই হাসি আনন্দের হিড়িক পড়ে। পড়শীদের মুখে আলোর বিকিরণ ঘটে। আনন্দের ছায়ায় অনুষ্ঠানের চিন্তনে মানুষ প্রীত হলে আনন্দে ভাসতে থাকে। যাত্রার বছরধ্বনিতে মুখরিত হয়ে জন্মানুষ্ঠানে ভিড়ে। করতালির মাধ্যমে বরণের গ্রহণের আশায় সোনালি জীবনের বাঁকে পথ চলে। আগতজন ধীরে ধীরে নিজেকে পরিচর্যা করে। পরিচর্যাকারী হিসেবে নিজেকে সাজায় না অন্যের সাজসজ্জাকরণেও বদ্ধপরিকর। অন্যের পরিচর্যা করতে করতে নিজেকে নোংরা করে তবু অন্যকে সাজানোয় তাঁর সুখ। প্রকৃতি ও মানুষের মাঝে মিল চিরকালীন। প্রকৃতি কাউকে সাজায় আবার কেউ মেলবন্ধন রেখে সাজ তৈরিতে মনোযোগীও। এভাবে মানুষ এবং প্রকৃতির যোগধর্মিতা রয়েছে। তার হরণ ও অন্যান্য কবিতায় এমন চিন্তনদক্ষতা দেখা যায়। তাঁর কবিতা প্রতিচিত্র, কাব্যপ্রীতি সমকালীন, জীবনপ্রবাহ গতিশীল, সম্প্রীতি মায়াবন, জাগ্রত স্বভাব, আনন্দ অবধারিত, জন্ম ও জীবন আনন্দ উৎসব এসবের মধ্য দিয়ে শাসিত ও শোষিতের রেখাচিত্র পাঠকের সামনে প্রোজ্জ্বল। কাব্যকৌশলী হিসেবে শাব্দিকভাঁজ অতুলনীয়। সময়ের বিবরণে তিনি হলেন সমকালীন চিত্রশিল্পী। তাই কবিতার প্রেক্ষাগৃহে তিনি তাঁর মতো ছায়া রেখে চলছেন। আমার একজনই বন্ধু কবিতায় কবি নিজের সঙ্গে নিজের পরিচয়কে উপস্থাপন করেছেন। গ্রাম ছেড়ে যান্ত্রিক শহরের পথে এখানে স্বার্থপরের ভিড়ে সে বাস করছে। গ্রামে গোলাঘর কবিরাজের মহাঘৃত খড়কুটো হিজলমালা ইত্যাদির সঙ্গে চিরকালীন সখ্যতা থাকলেও শহরে আসার পর তার কাছে সঙ্গ হচ্ছে অস্ত্র, বাদুরের বিষ্টা, চাকু ও চাবুকের ঝনঝনানি। গ্রাম এবং শহরের তারতম্য এবং মানুষের বেড়ে ওঠার চমৎকার পার্থক্য উপস্থাপিত হয়েছে। ‘পবনজন দাসের শীতলপাটি’ কবিতাটি কাহিনীর অবয়বে নির্মীত কবিতা। পবনজয় দাসে সংসারের চিত্র এখানে আসলেও তার চোখে স্বপ্ন সাজাবার অতৃপ্ত আসা বিদ্যমান। একটি সংসার জীবনে পারিবারিক সূত্রতায় পিতা প্রপিতা ছেলে সন্তান স্ত্রীর সমাবেশ থাকে তাদের দায়িত্বভার নিয়ে সুন্দর পরিবার চালাতে হয়। মৃত্যুঞ্জয় দাসের মতো প্রতিটি মানুষ দুই হাতে পরিশ্রম করে হাসি কান্না আলো ছায়া চাঁদ মেঘ বিদ্যুৎসম পূর্ব পুরুষের মতো কুমারের প্রতিরূপ। বাঙালী মধ্যবিত্ত পরিবারকে এভাবেই সংসারের ঘানি টানতে হয়। এখানে পবনজয় দাসের মধ্য দিয়ে গ্রাম বাংলার সকল পরিবারের সংসার ও পরিবারকেন্দ্রিক ঝড়ঝাপ্টার মধ্যে বেড়ে ওঠার চিত্ররূপ দেখিয়েছেন কবিতায়Ñ ‘পবনজয় দাস মানে একটি শীতলপাটি/রৌদ্র-দুগ্ধ মধ্যবিত্ত বাঙালীর সুখ/পবনজয় দাস মানে একটি শীতলপাটি/মানুষের পোড়াচর্মে বিনাশী অসুখ।’ ‘কুকুর-বিড়ালের রচনা’ কবিতায় দুটো প্রাণীর চারিত্রিক পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। গৃহস্থ পরিবারেই বসত করে আকৃতিগত বিষয় পা লেজ বাদ দিলে আকৃতিগত বৈষম্য নেই। দুটোকে আলাদা করে দেখার জো নেই। খাবার দাবারেও মিল লক্ষণীয়। দুধ-মাংস বসবাসের জায়গা শোয়ার ও বসার ঘরে পার্থক্য থাকে। দুটো প্রাণীরই বিপরীতমুখী ভাবনা বিদ্যমান। সমাজে দুটো শ্রেণীর মানুষ বসবাস করে তাদের চিন্তনে ভাল-মন্দের রেশ দেখতে পাওয়া যায়। পক্ষ প্রতিপক্ষীয় টানাপোড়েনও কম নয়। সাংসারিক জীবনে স্বামী-স্ত্রীর মেলবন্ধন ও টানাটানিও কম নয়। সুন্দর-অসুন্দরের মাঝেই একীভূত হয়ে বসবাস করে। ভালবাসার বন্ধনে তাদের সন্তান জন্মলাভ করে। পৃথিবীতে প্রাণীদের বংশ বিস্তারে পার্থক্য কম। জৈবিক চাহিদা ও সন্তান সম্ভবার চিত্র একই ধরনের হলেও বিবেক বুদ্ধির তারতম্য বিদ্যমান। কুকুর-বিড়াল গৃহজনের বিশ্বস্ততা দিয়ে বসবাসরের ক্ষেত্র তৈরি করে। এক সময় একা হয়। সংসার জীবনে মানুষও পারিবারিক দায় এবং জীবনযাপনের দীর্ঘপরিক্রমায় ক্লান্ত বা নতজানু হয়। কবি দুটো প্রাণীর বর্ণনা দিতে গিয়ে শব্দ ও ভাবকৌশলে পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। প্রাণীর প্রতীকে মানবজীবনের নানা বিষয়কে অনুষঙ্গ করেছেন। তিনি প্রতীকায়নে যে সমাজ বাস্তবতাকে দেখালেন তাতে সমাজেই মানবজীবনের নানা ঘটনা ও বর্ণনার সুনিপুণতা দেখা যায়। সমঝোতাই জীবন, কুকুর-বিড়ালের সমঝোতা হয় কিন্তু মানুষের হয় না। প্রাণী থেকে মানুষের নৈতিক শিক্ষা লাভের ইঙ্গিত রয়েছে কবিতায়- ‘কেউ দুধ পছন্দ করে/কেউ মাংস/কারো শোয়ার ঘর পছন্দ/কারো বা বসার/এ মানুষের পায়ে তো ও মানুষের কোলে/আবার কুকুরের সঙ্গে শিয়ালের/এবং বিড়ালের সঙ্গে ইঁদুরের/অদৃশ্য এক টানাপোড়েন থেকেই যায়/এভাবেই পারস্পরিক কোনো সমঝোতায়/গৃহস্থের সঙ্গে কুকুর বিড়ালের ওঠাবসা।’ ‘ক্রোধ একপ্রকার অর্জুনের ডাল’ কবিতায় প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের তুলনা করতে গিয়ে কবি ক্রোধকে অনুষঙ্গ করেছেন। অর্জুন ঔষধি গাছ। মানুষের নানা রোগের মহৌষধ। সকল গাছের ফাঁকে স্বপ্নহীন সম্ভাবনা নিয়ে অরণ্যে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রয়োজনীয় গাছ বিধায় ধরে রাখে। মানবকল্যাণের জন্য সে আনত। মানুষ মানুষের স্বার্থমোহে বিরুদ্ধাচরণে দ্বিধা করেনা। প্রকৃতির পালাবদল ঘটে সে সময় শক্তি ও সাহসের মাঝে অর্জুন দাঁড়ায়। মানুষের এক প্রকার রোগ বিদ্যমান ক্রোধ। ক্রোধ ভালবাসাকে খেয়ে পেলে অর্থাৎ মানুষের মনুষত্ব বিকিয়ে দেয়। ক্ষতিসাধনে অপেক্ষা করে না। মানুষের মাঝে প্রকৃতির দ্বৈতভূমিকা কবি সুন্দরভাবে ব্যক্ত করেন। “মানুষের একমাত্র রোগ ক্রোধ/সে রোগের কাছে নত হয়ে আছে অর্জুনের কান্ড-মূল/এক সময় প্রকৃতিও প্রকৃতির বিরুদ্ধে যায়/অর্জুন দাঁড়িয়ে থাকে একা/শক্তি ও সাহসের কাছে/ক্রোধ খেয়ে ফেলে শান্ত ভালোবাসা।” ‘সংসারের অনন্ত ভ্রমণ’ কবিতায় সংসারকে ভ্রমণের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। সংসার যাত্রায় গৃহস্থ যার সংসার বউ বাচ্চা, হাঁড়ি পাতিল, গহনা, টিপ লিপস্টিকের সঙ্গে বসবাস। যুবকের সংসার, বেণী মেয়ে, পার্কের শূন্যতা, চাকরি, তরুণের সংসার, মিছিল, আড্ডা, স্টেডিয়াম, এলোমেলো জীবন, বণিকের নাট, নুন, এসিড মেশানো যুবতীর স্বপ্ন, বুকের বালিশ, জন্ম মৃত্যুর গলিপথ। সংসার জীবনের সঙ্গে নানা বয়সীদের জীবন নির্বাহের মৌলিক চিন্তন কলা-কৌশলতার স্পর্শে কবি কাব্যিক সূক্ষ্মদর্শী হয়ে উপস্থাপন করেছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জীবনের বাঁক বদল দেখিয়েছন সময়কে ধারণ করে এঁকেছেন। সাংসারিক জীবনযাত্রা বর্ণনায় কবির দরদ ছিল তাই সরাসরি বিষয়কে অনুষঙ্গ করে কাব্যিক চেতনায় পাঠকের মনের খোরাক যুগিয়েছেন। প্রত্যেকে পাঠকই তার ধারাবাহিক জীবনযাপনের চিত্র খুঁজে পাবে। ‘আমার সম্পর্কে’ কবিতায়Ñনিজের সম্পর্কে জানার মধ্য দিয়ে সাময়িক বদলের চিত্র উপস্থাপন করেছেন। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে জানা এবং বোঝাপড়ার চিত্র উপস্থাপনও রয়েছে। তোলা জল বাসি ফুল, কাজল রঙে চোখের বদল, পালিশে আঙ্গুলের শ্রী, শয়নে নারীর ভঙ্গি সবই রূপবদলের দৃষ্টান্ত। পথ থেকে বেরিয়ে গেলে তাকে আর পথ আলিঙ্গন করে না। সে পথেই তার গন্তব্যস্থান। অতীতের স্মৃতিবহন করে সামনের দিনগুলো নিয়ে ভাবছে। উদাসী জীবন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিয়মানুযায়ী বদলে যাচ্ছে। কবিতায় বদলের প্রেক্ষাপট অন্তর্নীহিত মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। চলমান সময়ে মানবজীবনও এমনভাবে নিয়ত পরিবর্তনের হাওয়ায় দোদুল্যমান। ‘তোমার কীর্তি কাঁটা তোমার’ কবিতায়-স্বদেশপ্রেমের চিত্র ফুটে ওঠে। পূর্ব বাংলার মানুষ কদমে কদমে সমস্যার বেড়াজ্বালে আবদ্ধ হয়েছে। হায়েনারা সুনসান মাটির বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে বধ্যভূমিই তার প্রমাণ। কবি এখনও বধ্যভূমিতে পাখির ডাক শুনতে পান তাদের সঙ্গে ভালুকেরা ঢোল বাজায় অর্থাৎ তাদের অনুসারীরা মানচিত্রকে এখনও ক্ষতবিক্ষত করে। মাতৃভূমির প্রেমিকরা তাদের শব্দ বধ করে আকাশের বুকে পতাকা উড়িয়েছিল দহন ও দ্রোহের ভাষা ছিল মুক্তির। কবির জন্মভূমি মন পীড়া, শব্দবধ অশ্বরথ অহঙ্কার ও জন্মঋণের কারণ। এখানে পিতার চোখে অশ্রু দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে ভাই-বোন এই বনস্পতির বুকে অলঙ্কার জয়ের তিলক আঁকার স্বপ্নে তিনি বিভোর। কাব্যিক ভাষায়- জন্মঋণের কারণ তুমি হলেই যদি/পিতার চোখে অশ্রু তোমার দীর্ঘস্থায়ী/ভগ্নি-মাতা, আয়ুবান এই বনস্পতি/তোমায় দেবে অলঙ্কার ও জয়ের তিলক। ‘এক জীবনের মহাজীবন’ কবিতায় বেড়ে ওঠার গল্প বর্ণনা করেছেন। জীবন একটি ভাসমান নৌকার মতো সামনের দিকে ধেয়ে চলে। ঢাকা থেকে কনিষ্ঠ ভগ্নি ও জ্যেষ্ঠ কন্যার আগমনে পরিবারে আনন্দধ্বনির মধ্য দিয়ে পারিবারিক বন্ধনকে দেখিয়েছেন। আশোভন আচরণের মাধ্যমে বন্ধন ছিন্নের ইঙ্গিত দিয়েছেন। তার জীবন বেড়ে উঠছে মার্বেল মসৃণ মাটি, আকাশে ঢাউস ঘুড়ি, হিজল ডাল শোলের সোনালি পোনা, নাপিতের ক্ষুর, পাঠ বেচে ইলিশ খাওয়া কৃষক এসবের মধ্য দিয়ে পুবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে চিন্তন প্রবণতা। পূর্বপুরুষের মধ্যে গাছি জেলে পঞ্চায়েত ইমাম মোড়ল মুক্তিযোদ্ধা এবং সম্পূর্ণ পুরুষ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কেউ নেই। বাঙালী জীবন পাওয়া না পাওয়া আশা-নিরাশার দ্বান্দিকতা এবং থাকা না থাকার চলমান জীবনপ্রবাহ নানা অনুষঙ্গের আদলে পেশ করেছেন। ঋতুর পালাবদল গ্রীষ্ম বর্ষা শীত বসন্ত ও ভাদ্র আশ্বিন দিনের বর্ণনার পাশাপাশি প্রকৃতি ও শীল পাল কাজীদের পরিচয়কেও টেনে এনেছেন। প্রিয় বর্ণমালা কবিতায় বাংলাদেশের রূপবৈচিত্র্য বর্ণনার পারঙ্গমতা অতুলনীয়। ঋতু নদী সবুজ মাঠ ভাতৃত্ব ভাষা মাটি গোলা জেলে কৃষক সমুদ্রের ফেনা সবই চিত্রকল্প। হাজার বছর ধরে এরা খাক হয়ে বুকে বুক কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একতাবদ্ধ। এখানে অখ- মানুষ সম্প্রীতির বন্ধনে বসবাস করে। রক্ত আঘাত বুলেট আগুনে পুড়ে তারুণ্যের অহঙ্কারে উড্ডীয়মান দেশ। সাহসী ও উদ্যমী শত আঘাতেও এরা সঙ্গবদ্ধ। সমস্যা উত্তরণে বিশ্বাসী বাঙালী ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলব্যাপী উত্তর-দক্ষিণে ব্যাপ্ত হয়ে গড়ে উঠছে। যাদের শ্রমে গামে অর্জিত সোনার দেশ তাদের মূল্যায়ন নেই। নর্দমার কীট শ্রমের ফসল ভোগে মত্ত। আজ যে দেশের সূচনা উন্নয়নমুখী ভাবাদর্শ স্বাধীনতাপ্রাপ্তির কারণেই সম্ভব হয়েছে। পরিবার পরিবার পাড়া পড়শী আচার অনুষ্ঠান উৎসব তাদের রক্তদানের পূর্ণতায় লাভ হয়েছে। পশ্চিমের মেঘমালায় জেগে ওঠা পূর্ব সীমান্ত অর্থাৎ পূর্ব বাংলার মানুষের জাগ্রত স্বভাবের কারণে মানচিত্র তৈরি হয়ে লেখা হয় বর্ণমালায় খচিত বাংলাদেশ। কবিতায় এরকমÑ“পুবের সীমান্ত থেকে পশ্চিমের মেঘমালা ব্যাপী/জেগে ওঠে দখলের ভূমি, জাগে তার আপন স্বভাব/মানচিত্র তৈরি হয়, লেখা হয় বর্ণমালা/বাংলাদেশ।” আত্মকথনের মাধ্যমে মানুষের কথা বলেন তিনি। কবিতায় আমি ও আমার শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে বিষয়টি স্পষ্টভাষ্যে ধরা দেয়। ‘আমার একজন বন্ধু’ কবিতায় তো বলেই দেনÑ আমার একজনই বন্ধু, তার নাম হাবীবুল্লাহ সিরাজী। কবি মহাকবি বা সাহিত্যিকের ভেতরে দৈত্বসত্তা বসবাস করে। একটি নিজে অপরটি পরিচালক। যা তাকে পথের দিশা ও বাঁক বদলের শক্তি জোগায়। কবির মধ্যেও সে সত্তার বসবাস। সে তার বন্ধু নাম তার হাবীবুল্লাহ সিরাজী। এখানে শৈশব থেকে বেড়ে ওঠার গল্প শোনা যায়। কবির ছোটাছুটি খুঁজে বেড়ানো, পরিচয় এবং সত্যপাঠ দৃঢ়ভাবে প্রকাশ পেয়েছে। গোলাঘর কুমার নদের পাতলা ঝিনুক কবিরাজের মহাঘৃত মধ্যরাতে মেথরপাড়ায় ঘোরাঘুরি মিরপুর পনেরো বছর আগে উঠে চব্বিশে মৃত্যু সাহারা মরুভূমি নানা আত্মকথনে দুয়ের কথন ভাবায় ঠেলে দেয়, আবার কাছে টানে। এভাবে চিরায়ত সাহিত্যেশিল্পীর মতো কবির আত্মপরিচয় পাওয়া যায়। বাস্তববাদী ও সমাজসচেতন সাহিত্যেশিল্পী তিনি। মদ বিক্রেতা ও টিয়াপাখি কবিতাই তার জ্বলন্ত উদাহরণ। সাহিত্যে মদ্যপায়ীদের সভ্যতা সম্পর্কে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ‘একেই কী বলে সভ্যতা’ প্রহসনে সভ্যতা সম্পর্কে স্পষ্ট বর্ণনা দিয়েছেন। সাহিত্য মদ্যপায়ীর মাতলামো সমাজে বিশৃঙ্খলার চিত্র বিশ্বসাহিত্য ও জাতীয় সাহিত্যে নানাভাবে অনুষঙ্গজাত হয়েছে। চলমান সমাজ প্রেক্ষাপটে নেশার উপটোকন চেঞ্জ হয়ে ইয়াবা গাঁজা পেন্সিডিল নানা নামকরণ হলেও মাদকতায় সমাজে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ছে। প্রতিনিয়তই নারী নির্যাতন ধর্ষণ শিশুহত্যা মারামারি দাপট পরকীয়া কারণে হত্যার মতো ঘটনা ঘটছে। মাদকের টাকা যোগাতে না পেরে দৈনন্দিনতার হিসেব নিকেষ সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি। কবিতাটি বলা চলে বাস্তবতার নিরিখে বিম্বিত। মদ্যপায়ীর মাতাল প্রবণতায় ভেদ বিচার শূন্য। নেশায় আসক্ত হয়ে বিবেক বোধের অভাবে যা তা করে। মদ বিক্রেতা তাকে ইবলিশ জানোয়ার হারামজাদা লুচ্চা সম্বোধন করে তাকে বার বার তার ঘরে ফিরার কথা বলেছেন। ঘরে তার স্ত্রী পুত্র রয়েছে কিন্তু মাতাল কারও কথাই শুনে না। মাতাল সমাজ ও বাস্তবতার ছায়াসঙ্গী হয়ে কবি সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে আগ্রহ পোষণ করেছেন। প্রেমের সৃজিয়ান কবিতা। প্রেমবোধের ইঙ্গিত মেলে ‘ফিরে যাবে তা কেন হবে’ কবিতায়। তিনি ঘরে আছেন শব্দ হলে দরজা খুলে দেবেন শব্দের জন্য প্রহর গুনছেন। দরজা খুলবেন সিঁড়ি পেলে দেবেন বার বার ছুটাছুটি করেন বারান্দায়, দেখেন টিকটিকি, হর্ন দমকা বাতাস আওয়াজও শব্দ মনে হয় কিন্তু সে আসেনি। তার ভাবনায় সে এসে ফিরে যেতে পারে না কারণ তিনি অপেক্ষা করছেন। কবিতার বয়ানে প্রেমিকার জন্য প্রেমবোধ এবং কাছে পাওয়ার আশা ব্যক্ত হয়েছে। তাই অস্থির সময় পার করছেন। কাব্যিক রূপসৌন্দর্যে গল্পের ধারাভাষ্যকার এবং সৌন্দর্যশিল্পী তিনি। কবিতার মধ্য দিয়ে গল্পের ভেতরে প্রবেশ করেন। ভেতরে থাকে সমাজ প্রকৃতি রূপবৈচিত্র্য চেতনা এবং বাস্তবতার ইতিবৃত্ত। রূপক উপমা ও আলঙ্কারিক প্রয়োগে অসাধারণ কৃতিত্ব তাঁর। চিত্রের মাঝে নদী নারী আসমান সবুজ মাঠ নীল আকাশ, পাখি কুকুর বিড়াল বৃক্ষ ছায়া তৃণলতা, জাহাজ নাবিক জমির ফসল, ইঁদুর শকুন রঙিন পেন্সিল, সৌধ উকুন চুইংগাম, বাসিফুল পিঁপড়ে শিকড় বালিয়াড়ি ঋতু তোশক ভালুক চেতনা ও বাস্তবতার আদলে ধারাবাহিক বিবরণ দিয়েছেন। চিন্তার জগৎকে মেলে ধরলেই সেখানে কখনো কখনো আলো অন্ধকার খুঁজে পাওয়া যায়। প্রকৃতি সম্পর্ক ও চেতনার ত্রিবেণী বন্ধনে কবির নির্যাস প্রখর। তিনি প্রকৃতির মধ্য দিয়ে সম্পর্ক খোঁজেন সে সম্পর্ক পরিবার সংসার এবং দেশপ্রীতির। তাই তাঁর কবিতায় স্বতন্ত্র মনোভাবের আঁচ লক্ষণীয়।
×