ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুহাম্মদ জভেদ হাকিম

বিস্ময়ের নাম এগারোসিন্ধু

প্রকাশিত: ০৬:৪৮, ৩ জানুয়ারি ২০২০

 বিস্ময়ের নাম এগারোসিন্ধু

ভোরের আলো তখনও ঠিকমতো ফোটেনি। যাকে বলে পাখি ডাকা ভোর। প্রেয়সীকে সঙ্গে করে ছুটলাম ভাটির দেশ কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার এগারোসিন্ধু। আজকের দিনটি শুধুই দুজনের। গাজীপুর মহাসড়ক পেরিয়ে কাপাসিয়ার টোক গিয়ে সকালের নাশতা সারলাম। এরপর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাই এগারোসিন্ধু উপজেলায় অবস্থিত ঈশা খাঁ’র দুর্গে। দুর্গ বলতে যা বুঝেছিলাম তা এখন আর নেই। যা রয়েছে তা শুধু উঁচু মাটির ডিবি। বাংলার স্বাধীন শাসক ঈশা খাঁ’র নাম বিজড়িত মধ্যযুগীয় এই দুর্গ। লোকমুখে প্রচলিত রয়েছে একজন কোচ উপজাতি প্রধান দুর্গটি নির্মাণ করে, এটিকে তার প্রাসাদে পরিণত করেছিলেন। এখনও একটি পুরনো দীঘি রয়েছে। যেটাকে বেধুর রাজার দীঘি বলে। ধারণা করা হয় এই দীঘির পাশেই দুর্গটির অবস্থান ছিল। পরবর্তী সময়ে ঈশা খাঁ দখল করে একটি শক্তিশালী সামরিক ঘাঁটিতে উন্নতি করেন। সতেরো শতকের শুরুর দিকে আহম’রা দুর্গটি দখল করে নেয়। পরবর্তীতে ইসলাম খান তাদের পরাজিত করে, দুর্গটি ধ্বংস করে দেন। ১৮৯৭ সালের বিধ্বংসী ভূমিকম্পে, দুর্গটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। যার কোন অবকাঠামোই এখন আর নেই। নেইত কি হয়েছে! এই গ্রামেই রয়েছে সতেরো শতকে নির্মিত দুটো ঐতিহাসিক মসজিদ। শেখ সাদী ও শাহ্ মাহমুদ মসজিদ। সাগরের ঢেউ পছন্দ করা গিন্নিকে, আজ দেখাব প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহাসিক মসজিদ। গ্রামের মেঠো পথে, অল্প কিছুক্ষণ হেঁটেই শেখ সাদী মসজিদে পৌঁছে যাই। প্রথম দর্শনেই বেশ ভাললাগে। সাদী মসজিদটি বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংরক্ষিত স্থাপনার মধ্যে একটি। এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটি ১৬৫২ খ্রিস্টাব্দে বাদশাহ শাহজাহান গাজীর রাজত্বের সময় নির্মাণ করা হয়। নির্মাণশৈলিতে মুঘল ও সুলতানি আমলের চমৎকার মিশ্রণের কারুকার্য রয়েছে। যা দেখে খুব সহজেই অন্যান্য স্থাপত্য হতে সাদী মসজিদটিকে আলাদাভাবে চেনা যায়। সাদী মসজিদটির বয়স প্রায় ৪০০ বছরের কাছাকাছি। এর ভেতরে-বাহিরে টেরাকোটার কারুকার্য রয়েছে। বর্তমানে এর আশপাশ বেশ প্রাকৃতিক শোভামন্ডিত। বউকে বলি, সাগরের বিশালতা দেখে যেমন মুগ্ধ হও। ঠিক তেমনি প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন দেখেও মানুষ, তার নিজের আমিত্বকে নির্মূল করতে পারে। আমি, আমার বলতে জগতে কিছুই নেই। কালের পরিক্রমায় সব আমিত্বই অতলে চলে যায়। রয়ে যায় শুধু কীর্তি। সাদী মসজিদ প্রাঙ্গণে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে, ছুটে যাই শাহ্ মাহমুদ মসজিদে। সাদী মসজিদ হতে এর দূরত্ব খুব বেশি নয়। বউ আর আমি কচি ঘাসের ঘ্রাণ, সোঁদামাটির গন্ধ, বাতাসে দোল খাওয়া সবুজ ধান গাছের সুভাস নিতে নিতে এগিয়ে যাই। প্রথমেই চোখে পড়ে ছনঘর আকৃতির আকর্ষণীয় পাকা দো-চালা ঘর। মূল ফটক দিয়ে মসজিদের উঠানে ঢুকি। বাহ্! অন্যরকম এক নান্দনিক দৃষ্টিনন্দন কারুকার্যময় মসজিদ। সুবেদার শায়েস্তা’খার আমলে ১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে, এগারোসিন্ধুর তৎকালীন ধনাট্য ব্যবসায়ী শাহ মাহমুদ কর্তৃক এক গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদটি নির্মিত হয়। মসজিদটির ভেতরে-বাহিরে সুলতানি আমলের নক্সা দ্বারা অলঙ্কৃৃত। সম্মুখে রয়েছে ঘাটলাবাঁধা পুকুর। সে সময় হতে এটা পুকুর কিনা তা জানতে পারিনি। দো-চালা ঘরটি ছিল বালাখানা। পোড়ামাটির চিত্রফলকের নক্সায় নির্মিত মেহরাবগুলো, মসজিদের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। মসজিদ দুটো পরিদর্শনের সঙ্গে সঙ্গে, অসাধারণ রূপের রানী খাটি বাংলার প্রতিচ্ছবি এগারোসিন্ধু গ্রামটাও ঘুরতে ভাললাগবে। ঘুরতে ঘুরতে দেখা হয় শাহ্ গরীবুল্লাহ মাজার। এরপর চলে যাই বিন্নাটির মোড় হয়ে, কিশোরগঞ্জ শহরে শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান। উপমহাদেশের মধ্যে তথা বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ দুটো ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত হতে শোলাকিয়া ময়দানে, বর্তমানে প্রায় তিন লাখ মুসল্লির অংশগ্রহণে এখানে ঈদ-উল ফিতর ও ঈদ-উল আজহার জামাত অনুষ্ঠিত হয়। শোলাকিয়া মাঠে প্রথম ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয় ১৮২৮ সালে। ধারণা করা হয়, তখন সোয়া লাখ মুসল্লি অংশগ্রহণ করায়, সেই থেকে ভাষাগত বিবর্তনে আজকের শোলাকিয়া নামটি হয়েছে। ঘুরতে ঘুরতে বেলা গড়িয়ে দুপুর। দুপুরের খানাপিনা শেষে যাব মরিচখালী। সেই গল্প আজ থাক। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মরিচখালীর গল্প হবে আরেকদিন। যাবেন কিভাবে : নিজস্ব বা ভাড়া করা গাড়িতে সুবিধা হবে বেশি। তবে যারা গণপরিবহনে যেতে চান তারা ঢাকার মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে কিশোরগঞ্জগামী বাসে করে পাকুন্দিয়া উপজেলার, এগারোসিন্ধুর গোয়ালঘাট নেমে যাবেন। এরপর রিক্সা বা অটোতে করেই চলে যেতে পারবেন সাদী ও শাহ মাহমুদ মসজিদ। আর শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে যেতে হলে কিশোরগঞ্জ শহরে যেতে হবে।
×