ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

স্থানীয় সরকারের সবচেয়ে কার্যকর প্রতিষ্ঠান হতে যাচ্ছে ইউপি

প্রকাশিত: ১১:০০, ২ জানুয়ারি ২০২০

স্থানীয় সরকারের সবচেয়ে কার্যকর প্রতিষ্ঠান হতে যাচ্ছে ইউপি

মশিউর রহমান খান ॥ ইউনিয়ন পরিষদকে স্থানীয় সরকারের সবচেয়ে কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে চায় সরকার। সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অন্যতম স্থান হিসেবে গ্রাম আদালতকে প্রতিষ্ঠা করা ও পরিষদের প্রশাসনিক ইউনিটের কার্যক্রম পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের মাধ্যমেই এ সংস্থাটিকে নাগরিকবান্ধব করে গড়ে তুলতে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। সক্ষমতা বাড়াতে দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদকে তাদের আয় বৃদ্ধি করা ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে জনগণকে আরও বেশি করে কিভাবে সম্পৃক্ত করা যায় তার লক্ষ্য নিয়েই সরকার এগুচ্ছে। সরকারের নেয়া আমার গ্রাম আমার শহর উদ্যোগ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে স্থানীয় সরকারের তৃণমূল পর্যায়ের এ প্রতিষ্ঠানটিকে শক্তিশালী করা অতি জরুরী। তাই এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে সরকারের পাশপাশি আগ্রহী পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বারগণও। সরকারের ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ বাস্তবায়ন করার অংশ হিসেবে এখন থেকে যত্রতত্র স্থাপনা নির্মাণ করতে দেবে না। স্থানীয় জনগণকে সকল কাজে সম্পৃক্ত করতে চেয়ারম্যান-মেম্বারদের সোশ্যাল কন্টাক্ট বাড়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণ আরও বাড়াতে চায় সরকার। মন্ত্রণালয় কর্তৃক এ সংক্রান্ত এক জরিপে দেখা গেছে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিশেষ করে চেয়ারম্যান-মেম্বারসহ সংরক্ষিত আসনেও শিক্ষিত নারীরা নির্বাচন করতে তেমন কোন আগ্রহ প্রদর্শন করছে না। এ থেকে বেরিয়ে আসতে শিক্ষিত নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে জোর দিচ্ছে সরকার। এছাড়া ইউপি সীমানায় অনুষ্ঠিত সকল সমাজকল্যাণ ও রাষ্ট্রেীয় কাজে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে নারীদের উৎসাহ প্রদান করতে চেয়ারম্যানদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এখন থেকে ইউনিয়ন পরিষদ সীমানায় যে কোন স্থাপনা বা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করলে তার নজরদারি করার মাধ্যমে সেসব স্থাপনায় বা প্রতিষ্ঠানে কি কাজ হচ্ছে তা চেয়ারম্যানদের পরিদর্শন করতে বলা হয়েছে। এমনকি যে কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করতে চাইলে ইউপি চেয়ারম্যানের অনুমতি বাধ্যতামূলক করার পরিকল্পনাও নেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। এছাড়া যে কোন প্রতিষ্ঠান তৈরিতে নাগরিক স্বার্থের কথা বিবেচনায় রাখা, এলাকাকে নিরাপদ ও বাসযোগ্য পরিবেশ তৈরি এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোন প্রকার কর্মকা-ে যাতে কোন অসাধু চক্র জড়িত হতে না পারে তার প্রতি বিশেষ নজরদারির অংশ হিসেবেই সকল প্রতিষ্ঠানে চেয়ারম্যান-মেম্বারদের নজরদারির আওতায় আনার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। সরকার প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদকে নিজস্ব সীমানায় মানব কল্যাণমূলক সৃষ্টিশীল ও দীর্ঘমেয়াদী আয় বৃদ্ধিতে নতুন নতুন আয়বর্ধক ধারণা সরকারের কাছে জমা দিতে বলেছে। জমা হওয়া এসব ধারণা যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে তা কোন পদ্ধতিতে বাস্তবায়ন করা যায় তা বিবেচনা করবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে ধারণার সঠিক বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ স্থানীয় কোন্ খাত থেকে করা হবে তা নিয়েও কাজ করবে। জানা গেছে, ইউনিয়ন পরিষদের উন্নয়নে যে সব ধারণা বাস্তবায়নে বিশাল অর্থের প্রয়োজন হবে সেক্ষেত্রে সরকার প্রয়োজনে বৈদেশিক অর্থও যোগান দেবে । এর বাইরে কিছু ক্ষেত্রে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে এসব ধারণা বাস্তবায়ন করবে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সরকার জনসম্পৃক্ততা বাড়িয়ে ইউনিয়ন পরিষদের নিজস্ব অর্থায়নেই এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায় । মূলত সরকারের গ্রাম উন্নয়নে পর্যাপ্ত বরাদ্দ না থাকায় একই সঙ্গে ইউনিয়ন পরিষদকেও অর্থবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে শতভাগ সরকারের ওপর ভরসা কমাতে সরকার চায় প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদ স্থায়ীভাবে তার নিজস্ব আয় বৃদ্ধি করুক। তবে যুগের পর যুগ ধরে চলে আসা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে কার্যকরী ব্যবস্থার জন্য সরকারের কাছে বেশ কিছু শর্তাবলী দিয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানগণ। চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের সম্মানী বৃদ্ধি করা, বিচারিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করা ও ইউনিয়ন পরিষদ এলাকায় সংঘটিত অপরাধের শাস্তির আওতা বাড়ানো, ইউনিয়ন পরিষদের আইনশৃঙ্খলা কমিটিতে থানার একজন পুলিশ কর্তকর্তাকে সদস্য সচিব নিয়োগ করা, পরিষদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সরকারের বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা,ইউনিয়ন পরিষদের সীমানায় থাকা ভূমি উন্নয়ন কর বৃদ্ধি করা ও পরিষদের তহবিলে জমা প্রদান, গ্রাম পুলিশকে নিয়ন্ত্রণে তাদের নিয়োগ ও অপসারনের জন্য পূর্ণ ক্ষমতা প্রদান করা,গ্রাম আদালতকে শক্তিশালী করা সহ সকল কাজে সকারের সহায়তা চায় তারা। এদিকে দেশের প্রতিটি গ্রামকে শহরে রূপান্তর করতে ও নাগরিকদের শহরের সুবিধা প্রদান করতে সরকারও চেয়ারম্যানদেরকে পরিষদের আয় বৃদ্ধিতে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানিয়েছে। জানা গেছে, সম্প্রতি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কেন্দ্রীয় সমিতি কর্তৃক দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদকে কার্যকরী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়তে ও নাগরিক সেবা প্রতিটি গ্রামে, ওয়ার্ডে, ঘরে ঘরেসহ প্রতিটি স্তরে পৌঁছে দিতে ১২ দফা দাবি পূরণের জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। এসব দাবি মানার জন্য কি কি করণীয় তা ভেবে দেখা হবে বলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় আশ্বাস দিয়েছে বলে জানা গেছে। এদিকে ইউপি চেয়ারম্যান সমিতির দেয়া ১২ দফায় বলা হয়েছে, প্রশাসনিক ইউনিট আইনের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করা। চেয়ারম্যানদের সম্মানী ভাতা ৩৫ হাজার ও মেম্বারদের বিশ হাজার টাকা নির্ধারণ করা, চেয়ারম্যানদের বিরুদ্ধে মামলা হলে আদালত কর্তৃক দোষী স্বাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত তাদের গ্রেফতার না করা ও সঙ্গে সঙ্গে সাময়িক বরখাস্ত না করা। ইউনিয়ন পরিষদের আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইউনিয়ন সীমানায় অবস্থিত সকল হাট-বাজার, জলাশয়, বালুমহাল, পাথরমহাল, সায়রাতমহাল ও ফেরিঘাটসমূহ ইজারা প্রদানে ক্ষমতা প্রদান ও ইজারালব্ধ আয়সমূহ ইউনিয়ন পরিষদের আয় হিসেবে সরকার কর্তৃক ঘোষণা করা। একই সঙ্গে ভূমি উন্নয়ন কর শতকরা ১ ভাগ থেকে ২ ভাগে উন্নীত করে সরাসরি ইউনিয়ন পরিষদের তহবিলে জমা করা। জন্ম নিবন্ধন আয় ও বিবাহ নিবন্ধন ফি ইউনিয়ন পরিষদে জমা করার দাবি জানিয়েছেন চেয়ারম্যানগণ। এছাড়া ইউনিয়ন পরিষদের অভ্যন্তরীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের সকল বরাদ্দ মন্ত্রনালয় থেকে সরাসরি ইউনিয়ন পরিষদে বরাদ্দ প্রদান করা। এছাড়াও গ্রাম আদালতের বিচারিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করে দেওয়ানি ও ফৌজদারি উভয় মোকাদ্দমায় টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা ক্ষতিপূরণ আদায়ের ক্ষমতা প্রদান করা। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সমিতির কল্যাণ ট্রাস্টের ঢাকায় স্থায়ী কার্যালয় নির্মাণের জন্য জমি বরাদ্দ প্রদানের দাবি জানিয়েছে চেয়ারম্যানগণ। একই সঙ্গে প্রতিটি গ্রাম আদালতে একজন ব্যাঞ্চ সহকারী ও একজন পিয়ন নিয়োগ করা। একই সঙ্গে ইউনিয়ন পরিষদের আইনশৃঙ্খলা কমিটিতে একজন সহকারী পরিদর্শক পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে সদস্য সচিব হিসেবে নিয়োগ দান করা। বর্তমানের ইউনিয়ন পরিষদের ওপর সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধি ও সরকারের উর্ধতন কর্মকর্তাগণ কর্তৃক বা উর্ধতন মহলের সকল প্রকার অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধ করার দাবি জানান তারা। অপরদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে গ্রাম পুলিশ নিয়োগ ও অপসারণের পূর্ণ ক্ষমতা প্রদান করা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইউনিয়ন পরিষদের সংগঠনের সভাপতি মোঃ বেলায়েত হোসেন গাজী বিল্লাল চেয়ারম্যান জনকণ্ঠকে বলেন,আমরা সরকারের নেয়া ইউনিয়ন পরিষদকে কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। তবে সত্যিকারার্থে এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে হলে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। যা দূর করতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সমিতির কেন্দ্রীয় সম্মেলনে সরকারের কাছে আমরা ১২ দফা দাবি তুলে ধরেছি। স্থানীয় সরকারমন্ত্রী এসব দাবি যাচাই-বাছাই করে দেখা হবে বলে আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন।
×