ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মাত্র দুই পরিবার বাঁচিয়ে রেখেছে সোনারগাঁর ঐতিহ্য

কাঠের চাকাওয়ালা হাতি ঘোড়া আজও থামেনি, মমিপুতুলে অদ্ভুত মায়া

প্রকাশিত: ১০:৫৯, ২ জানুয়ারি ২০২০

কাঠের চাকাওয়ালা হাতি ঘোড়া আজও থামেনি, মমিপুতুলে অদ্ভুত মায়া

মোরসালিন মিজান ॥ এখন শহুরে জীবনের প্রতি ঝোঁক। বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকা। অন্যের সংস্কৃতি ক্রমেই গ্রাস করছে আমাদের। মার খাচ্ছে লোক চেতনা। শেকড়ের সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখা কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। এ অবস্থায় ভাবতে সত্যি ভাললাগে যে, ইতিহাস সমৃদ্ধ নগরী সোনারগাঁ তার বহুকালের পুরনো ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। কাঠের পুতুল ও চাকাওয়ালা হাতি ঘোড়া তৈরি করা হতো সেখানে। আজও তা বন্ধ হয়ে যায়নি। চিত্রিত মমিপুতুলের মুখের হাসিটা এখনও অমলিন। এত পথ হেঁটেও হাঁটা থামায়নি কাঠের চাকাওয়ালা হাতি ঘোড়া কিংবা বাঘ। বরং বিস্মৃতপ্রায় লোকজ উপাদান তৃণমূলের শিল্পীদের সরল ভাবনা ও কারুকীর্তি গর্বের সঙ্গে তুলে ধরছে। আর তা সম্ভব হচ্ছে স্রেফ দুটি পরিবারের আন্তরিক চেষ্টায়। আশুতোষ সূত্রধর ও বীরেন্দ্র সূত্রধর নামের দুই শিল্পী এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা বাঁচিয়ে রেখেছেন ঐতিহ্য। হ্যাঁ, বাংলাদেশের টেপা পুতুল বা মাটির খেলনার সঙ্গে সবাই খুব পরিচিত। একসময় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মাটির পুতুল হাতি ঘোড়া বাঘ ইত্যাদি তৈরি হতো। এখনও কম বেশি তৈরি হচ্ছে। তবে কাঠের তৈরি বিশেষ খেলনার জন্য আলাদা খ্যাতি অর্জন করেছিল সোনারগাঁ। সেখানে ঠিক কবে থেকে কাঠের খেলনা তৈরি শুরু হয়েছিল তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। লোকগবেষকরা এটুকু নিশ্চিত করেছেন যে, চর্চাটি অনেক পুরনো। পুতুলের কথা আগে বলতে হয়। রাজা, রানী, সৈন্য, গ্রাম্য বধূসহ আরও কিছু ফিগারেটিভ কাজ হতো তখন সোনারগাঁয়। শিল্পসমালোচকরা তাদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে বলেছেন, কাঠের পুতুলগুলোকে প্রাচীন মিসরীয় মমির আদলে অলঙ্কৃত করা হতো। এটিই সোনারগাঁয়ের কাঠের পুতুলের মূল বৈশিষ্ট্য। আর হাতি ঘোড়া বাঘ ইত্যাদি প্রাণীর পায়ে চাকা জুড়ে দেয়ার কারণে খেলনাগুলো স্বতন্ত্র আবেদন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। প্রাণহীন হাতি ঘোড়া বাঘকে ছোটদের চোখে আকর্ষণীয় করে তুলতেই চাকা জুড়ে দেয়া। এর ফলে প্রাণহীন প্রাণীগুলো গতি পেত। বাচ্চারা সুতো দিয়ে বেঁধে অনায়াসে টেনে নিয়ে যেতে পারত। জানা যায়, কারুশিল্পীরা এক টুকরো শিমুল কাঠ বেছে নিয়ে সেটিতে হাতুড়ি বাটাল চালাতেন। কোন পেরেক ঠোকা বা কাঠ জোড়া দেয়ার ব্যাপার ছিল না। দক্ষ হাতে খোদাই করা কাঠ ঘষে মেজে খেলনা তৈরি করা হতো। গড়নের ওপর দেয়া হতো প্রাকৃতিক রং। হলুদ সাদা লাল এবং কালো রংই প্রধান ছিল। তুলি দিয়ে চিত্রিত করা হতো পুতুল ও অন্যান্য খেলনার শরীর। তাই দেখে ছুটে যেত গ্রামীণ শিশু কিশোররা। না কিনে মেলা থেকে বাড়ি ফিরতে চাইত না। সোনারগাঁয়ের কাঠের পুতুলের সেই সুদিন এবং বর্তমান চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে জানতে সম্প্রতি কথা হয় আশুতোষ সূত্রধর ও বীরেন্দ্র সূত্রধরের সঙ্গে। সম্প্রতি রাজধানী শহরে অনুষ্ঠিত এক মেলায় যোগ দিতে এসেছিলেন তারা। সম্পর্কে দুজন মামাত ফুফাতো ভাই। একই স্টলে পসরা সাজিয়েছিলেন তারা। লক্ষ্য করে দেখা যায়, আদি ফর্মগুলো প্রায় হুবহু রেখে দিয়েছেন তারা। দুজনই নিজ হাতে কাজ করেন। মেলাতেও কাজ করে দেখিয়েছেন। এনালগ সিস্টেম। তাতেও বাপ দাদার তৈরি করে দিয়ে যাওয়া ফর্মটা স্পষ্ট। দেখে মনে হয়, কার্বন কপি! কী করে সম্ভব? উত্তরে বীরেন্দ্র সূত্রধর বলেন, এ চর্চা তাদের রক্তের সঙ্গে মিশে আছে। আমার পিতা মনিন্দ্র সূত্রধরকে এ কাজ করতে দেখেছি। তার কাছেই হাতেখড়ি আমার। ১৯৮৬ সালের দিকে নিজে পুরোদমে কাজ শুরু করি। এখন পাকা হাত। কোন ছাঁচ ব্যবহার করি না। কথার এ পর্যায়ে হাতুড়ি বাটাল বের করে দেখান তিনি। সাকুল্যে চারটা যন্ত্র। বলেন, এই যে দেখছেন, এগুলো দিয়েই সব কাজ করি। আর কোন রহস্য নেই। স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন, একসময় সোনারগাঁয়ের বহু ঘরে কাঠের পুতুলের কাজ হতো। এটাই ছিল তাদের মূল পেশা। আমার বাবা সারা বছর নিজ বাড়িতে কাঠের খেলনা তৈরি করতেন। সেগুলো নিয়ে মেলায় যেতেন। আমিও বাবার সঙ্গে গ্রামের বিভিন্ন মেলায় গিয়েছি। তখন তো সারা দেশে মেলা হতো। লাঙ্গলবন্দে কী বিশাল মেলা দেখেছি! ঢাকার ধোলাইখালেও মেলা হতো। বাবা সেখানে দোকান দিতেন। আমিও তার সঙ্গে থাকতাম। বড় ভাই আশুতোষ সূত্রধর আরেকটু পেছনের গল্প শোনান। বলেন, কলকাতায় গঙ্গাসাগরে পৌষ সংক্রান্তির মেলা হতো। সবচেয়ে বড় মেলা। পার্টিশনের আগে সোনারগাঁ থেকে মালভর্তি ১০/১৫ টি নৌকা গঙ্গাসাগরের উদ্দেশে রওনা হতো। অর্থাৎ ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের আগের সময়টাতেও ব্যবসা ছিল রমরমা। সময়ের ব্যবধানে বদলে গেছে সে ছবি। বর্তমান চিত্রটা জানতে চাইলে বীরেন্দ্র বলেন, এখন কত্ত রকমের খেলনা! চায়নিজ খেলনায় বাজার দখল হয়ে গেছে। শিশুরা হাতি ঘোড়ায় আকৃষ্ট হয় না। তাহলে কী করে টিকিয়ে রেখেছেন ঐতিহ্য? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা তো বেশ বিপদেই পড়ে গিয়েছিলাম। কত সমস্যা সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে গিয়েছি। এর পরও নিজেরটা এক মুহূর্তের জন্য ছাড়িনি। আগে শিমুল কাঠ দিয়ে কাজ করা হতো। এখন শিমুল কাঠ পাওয়া যায় না। আমরা কদম কাঠ দিয়ে করি। আগে পুতুল বা প্রাণীর মডেলগুলো আকারে অনেক বড় হতো। ঘোড়া লম্বায় ২৪ ইঞ্চি পর্যন্ত হতো। ৮ ইঞ্চি ঘোড়া ছিল সর্বনি¤œ। এখন আমরা সাধারণত ৬ ইঞ্চির করি। কেউ অর্ডার দিলে ৯ বা ১২ ইঞ্চি পর্যন্ত করা হয়। কিন্তু কাজের মৌলিকত্ব একদমই নষ্ট হতে দেন না বলে জানান তিনি। চারপাশের অনেক কিছু বদলে গেলেও, বাপ দাদাদের ডিজাইন তারা অবিকৃত রেখেছেন। আশুতোষ বলেন, অনেক লড়াইয়ের পর বর্তমানে একটা পর্যায়ে আসতে পেরেছি। এখন আমাদের কাজগুলোকে শোপিস হিসেবেই বেশি দেখা হয়। আমরাও সেটি মাথায় খেলনা বানাই। এক ধরনের শৌখিন ক্রেতা আছেন, তারা একইসঙ্গে শিক্ষিত ও ঐতিহ্যপ্রেমী। আমাদের কাজের ব্যাপারে খুব আগ্রহী তারা। সংগ্রহে রাখতে ভালবাসেন। বিদেশী ক্রেতাও পাওয়া যায়। এর বাইরে আছে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতাও। শিল্পীরা জানান, সোনারগাঁয়ের লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর প্রাঙ্গণে তাদের সারা বছর কাজ করার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে। এখানে আসা শিল্পপ্রেমীরা তাদের কাছ থেকে পুতুল সংগ্রহ করেন। পাশাপাশি বিভিন্ন মেলায় অংশ নেন তারা। এখানেই শেষ নয়, আশুতোষ নিজের তৈরি পুতুল ও হাতি ঘোড়া নিয়ে জাপান ঘুরে এসেছেন। সরকারী উদ্যোগে ছিল এ সফর। বিদেশের মাটিতে তার ভীষণ কদর করা হয়েছে বলে জানান তিনি। বীরেন্দ্র সরকারী উদ্যোগে ঘুরে এসেছেন ভারত ও নেপাল। এভাবে দেশে বিদেশে তারা বাংলাদেশের লোক ঐতিহ্যকে তুলে ধরার কাজ করছেন। কিন্তু এ দুজনের পর কে ধরবে হাল? জানতে চাইলে আশ্বস্ত করে আশুতোষ বলেন, কেউ না কেউ ধরবে। ধরবেই। আমাদের ছেলে মেয়েরাও শিখছে। ওরা করবে। একই প্রসঙ্গে কথা হয় লোক সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ও চারুকলা অনুষদের ডিন নিসার হোসেনের সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, ১৯৭৪ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন নরেন্দ্র সূত্রধরের কাছ থেকে আড়াই ফুট লম্বা ও এক ফুট উঁচু একটি বাঘ কিনেছিলেন। কাঠের তৈরি বাঘটি এখনও জাদুঘরে সংরক্ষিত হচ্ছে। এখন প্রয়াত শিল্পীর ছেলেরা কাজ করছেন। লোক ঐতিহ্য এভাবেই বেঁচে থাকে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
×