ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রফতানি বৃদ্ধির জন্য হাল্কা প্রকৌশল খাতে আরও বিনিয়োগ চাই

প্রকাশিত: ১০:৪৯, ২ জানুয়ারি ২০২০

রফতানি বৃদ্ধির জন্য হাল্কা প্রকৌশল খাতে আরও বিনিয়োগ চাই

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রফতানি সম্প্রসারণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করার জন্য লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং (হাল্কা প্রকৌশল) পণ্যকে ২০২০ সালের ‘বর্ষপণ্য’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের রফতানি নীতি অনুযায়ী পণ্যভিত্তিক রফতানি বৃদ্ধি করতে আমরা ২০২০ সালের জন্য ‘লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্যকে জাতীয়ভাবে বর্ষপণ্য ঘোষণা করছি। এ খাতে আমরা আরও বিনিয়োগের আহ্বান জানাচ্ছি।’ বুধবার সকালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে মাসব্যাপী ২৫তম ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা-২০২০’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী রফতানি আয় বাড়াতে পণ্য বৈচিত্র্যে জোর দেয়ার পাশাপাশি নতুন বাজারের সন্ধানে বিশেষ দৃষ্টি দেয়ার নির্দেশনা দিয়ে বলেন, ‘রফতানি ক্ষেত্রে আমি বলব, একটা-দুইটা পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা না। আরও অধিক পরিমাণে পণ্য যেন আমরা উৎপাদন করতে পারি, রফতানি করতে পারি। আবার দেশের বাজারেও বা প্রতিবেশী দেশগুলোতে যাতে সেই পণ্যটা প্রয়োজন হয়, সেদিকে আমরা বিশেষভাবে দৃষ্টি দিচ্ছি। বরাবরের মতো এবারও সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইবিপি) যৌথভাবে মেলার আয়োজন করেছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনকে সামনে রেখে দেশের পণ্য প্রদর্শনী এবং পারিবারিক বিনোদনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দৃষ্টিনন্দন করে এবারের মেলা সাজানো হয়েছে। মেলায় বাংলাদেশসহ ২১ দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৪৮৩টি স্টল থাকছে। বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে বঙ্গবন্ধু প্যাভেলিয়নকে ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা নগরের মেলা প্রাঙ্গণের গেটের ফিতা কেটে মেলা উদ্বোধনের পর এর বিভিন্ন স্টল ও প্যাভেলিয়ন ঘুরে দেখেন। প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধনী বক্তৃতায় লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প খাতের বিকাশে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এর রফতানি সম্ভাবনা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট মহলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে এ খাতের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় কর্ম-পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি। এ খাতের পণ্যসমূহের মধ্যে বাইসাইকেল, মোটরসাইকেল, অটোমোবাইল, অটোপার্টস, ইলেকট্রিক ও ইলেক্ট্রনিক্স, এ্যাকুমুলেটর ব্যাটারি, সোলার ফটোভলটিক মডিউল এবং খেলনা প্রভৃতি রয়েছে বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন। পণ্যভিত্তিক রফতানিকে উৎসাহিত করার জন্য প্রতিবছর একটি পণ্যকে ‘বর্ষপণ্য’ ঘোষণার রীতি অনুযায়ী অতীতে চামড়া এবং পাটকে বর্ষপণ্য ঘোষণা করায় এগুলোর বিকাশ ঘটে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কাজেই এ বছর আমরা লাইট ইঞ্জিনিয়ারিংকে গুরুত্ব দিচ্ছি যেহেতু এই শিল্পটির বিনিয়োগ আকর্ষণের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বে এখন বিনিয়োগ এবং সোর্সিংয়ের জন্য সর্বাধিক অনুকূল গন্তব্য হয়ে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রায় ১৭ কোটি ভোক্তার বাজার নিয়ে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার গেটওয়ে হওয়ায় প্রায় ৪ বিলিয়ন ভোক্তার সঙ্গে সংযুক্ত। বাংলাদেশের বিনিয়োগবান্ধব নীতি একই সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশী পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত ও কোটা মুক্ত সুবিধা বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করছে। তিনি বলেন, ‘আমি কূটনীতিক এবং বিদেশী ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানাব যে, উইন-উইন পরিস্থিতির জন্য ব্যবসার সুবিধার্থে বিনিয়োগ এবং সোর্সিংয়ের জন্য বাংলাদেশকে বেছে নিন।’ বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) কর্তৃক সম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক মানের অনলাইনভিত্তিক ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালু, অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ের উদ্যোগ গ্রহণ, অবকাঠামো উন্নয়ন, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহ এবং ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে তার সরকারের নানাবিধ উদ্যোগও তুলে ধরেন তিনি। রফতানি আয় বাড়াতে পণ্য বৈচিত্র্যে জোর দেয়ার পাশাপাশি নতুন বাজারের সন্ধানে বিশেষ দৃষ্টি দেয়ার নির্দেশনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, রফতানির ক্ষেত্রে আমি বলব, একটা-দুইটা পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা না। অধিক পরিমাণে পণ্য যেন আমরা উৎপাদন করতে পারি, রফতানি করতে পারি। আবার দেশের বাজারেও বা প্রতিবেশী দেশগুলোতে যাতে সেই পণ্যটা প্রয়োজন হয়, সেদিকে আমরা বিশেষভাবে দৃষ্টি দিচ্ছি। এখন ডিপ্লোমেসিটা হয়ে গিয়েছে ইকোনমিক ডিপ্লোমেসি। এখন আর শুধু পলিটিক্যাল দিক দেখলে হবে না। কাজেই ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ করা যায় কীভাবে, নতুন নতুন বাজার খুঁজে পাওয়া যায় এবং নতুন নতুন পণ্য আমরা যাতে রফতানি করতে পারি সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দেয়ার নির্দেশনা দিয়েছি। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে বিশেষ জোর দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা যত বেশি ডিজিটাল ডিভাইস উৎপাদন, ব্যবহার এবং রফতানি করতে পারব, আমাদের অর্থনীতিতে তা তত বেশি অবদান রাখবে। আমি মনে করি আইসিটি সেক্টরটাই আমাদের সব থেকে বড় একটা সেক্টর হবে ভবিষ্যতে। এই পণ্য রফতানি করে আমরা বিশাল অংকের অর্থ উপার্জন করতে সক্ষম হব। অনুষ্ঠানে উপস্থিত কূটনৈতিক ও বিদেশী ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘উইন-উইন’ পরিস্থিতির জন্য ব্যবসার সুবিধার্থে বিনিয়োগ ও সোর্সিংয়ের জন্য বাংলাদেশকে যেন সকলে বেছে নেন- সেটাই আমার আহ্বান থাকবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, রফতানি বৃদ্ধি এবং ‘ডুয়িং বিজনেসে ব্যয় হ্রাসে’র জন্য বিভিন্ন সংস্কারমূলক কর্মসূচী এবং উন্নয়নের জন্য ওয়ানস্টপ সার্ভিসসহ সামগ্রিকভাবে ইকোনমিক জোন এবং সারাদেশে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হয়েছে। অতীতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ভূমির যে সমস্যা ছিল তা দূরীকরণ এবং যত্র-তত্র শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে আবাদী জমি যেন নষ্ট না হয়। আবার ব্যবসায়ীদের সব রকমের সুযোগ-সুবিধা যেন একটি জায়গায় পাওয়া যায় সে জন্যই সরকারের এ উদ্যোগ। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক আপডেট-২০১৯’ এর রিপোর্ট অনুসারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশ প্রধান শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পণ্য ও সেবা খাতে আমাদের রফতানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৬ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তার সরকার মাত্র ১০ বছরের মধ্যে আমরা এই অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে এবং বিশ্ব ব্যাংকের ২০২০ প্রতিবেদন অনুযায়ী ইজ অব ডুয়িং বিজনেস গ্লোবাল র‌্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১৯০ দেশের মধ্যে গত বছর থেকে ৮ ধাপ উপরে ১৬৮তম অবস্থানে এসেছে। কাজেই ২০২০ বছরটি তার সরকারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকার প্রধান বলেন, যারা ব্যবসায়ী এবং দেশে ব্যবসা করতে চান তাদের জন্য ইজ অব ডুয়িং বিজনেস আরও সহজ করা হয়েছে। আমরা নিজেরা ব্যবসা করি না। কিন্তু সরকার ব্যবসাবান্ধব। আমরা ব্যবসার জন্য অন্যদের সুযোগ করে দেই। আর বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান গত বছরের ৮৯তম থেকে বর্তমানে ৭২তম অবস্থানে আমরা চলে এসেছি। ইনশাল্লাহ ভবিষ্যতে আরও উন্নতি করতে পারব। ‘বাংলাদেশ এখন ২০২ দেশে ৬ শতাধিক পণ্য রফতানি করছে’ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পণ্য ও সেবা খাতে রফতানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৬ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। দেশের রিজার্ভ এখন অতীতের যে কোন সময়ের থেকে বেশি সমৃদ্ধ আখ্যায়িত করে তিনি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে থাকা বাংলাদেশী দূতাবাসগুলোর রাষ্ট্রদূত এবং হাইকমিশনারদের নিয়ে লন্ডনে ‘দূত সম্মেলনে’র আয়োজন করে বাংলাদেশের পণ্য রফতানি বৃদ্ধিতে তার সরকারের পদক্ষেপও তুলে ধরেন। একটি দেশের উন্নয়নের জন্য ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়ন এবং সম্প্রসারণ এবং উৎপাদন বৃদ্ধি জরুরী উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাশাপাশি মানুষকে কর্মক্ষম করা, তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া, তাদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার থেকে শুরু করে বিদ্যুত উৎপাদন এবং অন্যান্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন করাটাও একান্তভাবে গুরুত্বপূর্ণ করেই তার সরকারের নানা উদ্যোগ। তিনি বলেন, কথাই আছে বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী-তাই আমরা বাণিজ্যের দিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছি। প্রতিবেশী দেশে রফতানি বৃদ্ধির উদ্যোগ তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর দিকেই আমাদের দৃষ্টি। যে কারণে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর এবং ব্যবসা-বাণিজ্যটাকে সহজ করে দেয়ার উদ্যোগ আমরা নিয়েছি। একইসঙ্গে দেশে যাতে বিনিয়োগ আসে সেদিকেও দৃষ্টি দিয়েছি। তিনি বলেন, বর্তমান বিশ্ব বাণিজ্য প্রেক্ষাপটে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে এ মেলার আয়োজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ মেলায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশী ও বিদেশী উদ্যোক্তারা যেমন তাদের নতুন পণ্যসম্ভার প্রদর্শনীর সুযোগ পাবেন, তেমনি দেশী-বিদেশী ক্রেতার পছন্দ, রুচি ও চাহিদা আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ বিস্তৃত করতে সহায়ক হবে বলে আমি মনে করি।
×