ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

জঙ্গীদের, খুনী-সন্ত্রাসীদের যথাযথ বিচার চাই

প্রকাশিত: ০৮:৫১, ২ জানুয়ারি ২০২০

জঙ্গীদের, খুনী-সন্ত্রাসীদের যথাযথ বিচার চাই

একদিকে জঙ্গী মৌলবাদীরা দেশের শান্তি ও উন্নয়নে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে, অপরদিকে দেশের শান্তিপূর্ণ গ্রাম-মফস্বলের এলাকায়, পাড়ায় এক একটি সন্ত্রাসী দল গড়ে উঠেছে-যারা খুন, ডাকাতি, শিশু-কিশোরী ধর্ষণ, তরুণ খুন, ভূমি দখল, বসতবাড়ি দখল, ভাংচুর চালিয়ে নিরীহ মানুষ-নারী, শিশু-পুরুষদের শান্তি ও রাতের ঘুম হারাম করছে। বাস্তবিক, মুক্তিযুদ্ধপন্থী সরকারের উন্নয়নের সুফলকে বাধাগ্রস্ত করা যে জঙ্গী এবং তাদের নেপথ্যের পরিচালক জামায়াত, শিবির, তারেকপন্থী বিএনপির লক্ষ্য, সে বিষয়ে জাতি অবহিত আছে। জঙ্গীদের ধর্ম নিয়ে সন্ত্রাসের খেলাটি যেহেতু ’৭১-এর জামায়াত-শিবির-আলবদরদের অনুসরণে বাস্তবায়িত হচ্ছে, সেহেতু এদের গডফাদারদের চিহ্নিত করা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। দেশের গোয়েন্দা, পুলিশ, র‌্যাব এ কাজটি দক্ষতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে করে চলেছে। অবশ্য এক শীর্ষ সন্ত্রাসীর কলকাতায় গ্রেফতার হওয়ার পর বিচার চলাকালে জামিন পেয়ে কানাডায় ভিন্ন নামে নানা সংস্থাকে চাঁদা দেয়া, নাগরিক হওয়ার তথ্যাদি জানা গেছে। কলকাতায় খুনী শীর্ষ সন্ত্রাসীর জামিন লাভ, ভিন্ন নামে পাসপোর্ট লাভ এবং কলকাতা পুলিশের ওই সন্ত্রাসীকে বাংলাদেশের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করার কথা থাকলেও তা না করা, আবার তার জামিন, ভিন্ন পরিচয়ে পাসপোর্ট করা, কানাডায় প্রবেশ, দীর্ঘদিন থাকার অনুমোদন পাওয়ার পর বাংলাদেশ পুলিশ কানাডা পুলিশের কাছে সব তথ্য পাঠাতে আবেদন করলেও কানাডা পুলিশের এ প্রশ্নে নীরবতা, সবাইকে বিস্মিত করেছে! কলকাতার পুলিশ ও আইনজীবী, যারা ওই সন্ত্রাসীর জামিন, জাল পাসপোর্ট করিয়েছে, তাদের সঙ্গে কানাডার পুলিশের আচরণ শান্তিকামী নাগরিকদের মনে পুলিশ ও আইনজীবীদের প্রতি এক আস্থাহীনতার জন্ম দিয়েছেÑএ কথা বললে ভুল হবে না। জঙ্গীদের বিষয়ে একশ্রেণীর আইনজীবীর আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়ার অপকর্ম দেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতার ধ্বংসে অন্যতম ভূমিকা রাখছে দেখে জাতি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। শান্তিপ্রিয় জনগণ আর এ অপকর্ম দেখতে চায় না যে, পুলিশ-র‌্যাব আহার নিদ্রা ত্যাগ করে, প্রাণ বাজি রেখে জঙ্গীদের গ্রেফতার করবে আর এক-দু’মাসের মধ্যে সম্ভবত বিপুল অর্থের বিনিময়ে অথবা একই দেশবিরোধী আইনজীবীদের দ্বারা জামিনে মুক্তি লাভ করবে! এদের জামিন তাদের হামলার লক্ষ্য- পরিবার ও ব্যক্তির প্রাণশঙ্কার সুযোগ বৃদ্ধি করেÑ এ সত্য অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। আমাদের কথা একটাইÑ এই জঙ্গী মৌলবাদী এবং গ্রামের মফস্বলের পাড়া-মহল্লার, তরুণ ছাত্র, মেধাবী শ্রমজীবীর সন্তান, যারা দারিদ্র্য থেকে মুক্ত হতে হয়ত ভ্যান, রিক্সা চালায়, শিশু-কিশোরী-তরুণীদের নির্যাতন, ধর্ষক, প্রতিবেশীদের জমি, ফসল দখলকারী, ভাড়াটে খুনী, স্ত্রী হত্যাকারী, মাদকসেবী এদের দ্রুত গ্রেফতারের পর যেসব পুলিশ এফআইআর লেখে এবং যেসব আইনজীবী ওই খুনী-ধর্ষক-জঙ্গী-বধূহত্যাকারী, সংখ্যালঘু নির্যাতনকারীদের জামিন দিয়ে জামিনে মুক্তি দেয়ার ব্যবস্থা করে, তাদের তালিকা প্রণয়ন করে তাদের জঙ্গী-সন্ত্রাসী-খুনী-ধর্ষক-স্ত্রী হত্যাকারীর প্রশ্রয়দাতা হিসেবে গণ্য করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। এই এফআইআর লেখক পুলিশ যেমন মামলাকে দুর্বল করে দেয়, তেমনি ওইসব জঙ্গী সন্ত্রাসীর পক্ষে যেসব আইনজীবী জামিনের ব্যবস্থা করে এবং আদালতে যুক্তি, পাল্টা যুক্তি দেয়ার সময় মামলায় যাতে জঙ্গী-সন্ত্রাসীর হামলার শিকার জয়ী না হয়, বরং জঙ্গী-সন্ত্রাসীই যাতে জয়ী হয়, সে কাজটি করে প্রায় নির্বিঘেœ। সরকার এবং আদালতের প্রথম দায়িত্ব ক্ষতিগ্রস্ত, আঘাতপ্রাপ্ত, নিহত, আহতের পূর্ণ মানবাধিকার রক্ষা করা। অর্থাৎ ক্ষতিগ্রস্ত সান্ত¡না পাবে যে, সুবিচার হচ্ছে, হামলাকারী, খুনী-সন্ত্রাসীর গ্রেফতার, জামিন না পাওয়া এবং বিচারে অপরাধ অনুযায়ী অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি পাওয়া তার কাম্য। যতক্ষণ সরকার ও আদালত ক্ষতিগ্রস্তকে ক্ষতিসাধনকারীর বিচার না করছে, ততক্ষণ সুশাসন প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে না- যে সুশাসন সরকারকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে গণ্য করবে। সরকারকে মনে রাখতে হবে, পরিবেশ দূষিত হওয়া, সব বাড়ি, কারখানায় বিদ্যুত থাকার অনেক ওপরে থাকে সমাজকে দূষিতকারী জঙ্গী-সন্ত্রাসীর অপকর্ম রোধ করা। যেগুলো জনগণের শান্তিপূর্ণ জীবন-জীবিকা প্রতিষ্ঠার প্রধান অন্তরায় হিসেবে গণ্য করতে হবে। জনগণের জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠাই দেশ ও সমাজকে স্থিতিশীল করে। আমরা অবশ্যই একটি উন্নত ও শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল সমাজ চাই, যে সমাজে শিশু-কিশোরী-তরুণী ধর্ষিত হবে না, তরুণ, কিশোর, প্রৌঢ় হত্যার, নির্যাতনের শিকার হবে না, সংখ্যালঘুসহ শিশু ও নারী কোন নির্যাতন সহ্য করবে না। সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, যেখানে জেলখানায় বন্দী জঙ্গী, সন্ত্রাসীদের পরিকল্পিত প্রশিক্ষণ, বিনোদনের ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের অনুসৃত ধর্মের ভুল ব্যাখ্যাকে খ-ন করে তাদের মনে শুভবোধ, সমাজের সব ধর্ম ও শ্রেণী-পেশার মানুষের প্রতি তাদের লালিত হিংসার বিপরীতে কল্যাণবোধ, প্রীতিময় একটি মানসিকতা তৈরির লক্ষ্যে পুলিশ এবং বিভিন্ন সংস্থার ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার কথা; সেখানে দুঃখজনকভাবে দেখা যাচ্ছে, জঙ্গীরাই জেলখানায় অজঙ্গী, দুর্বৃত্ত, ডাকাতদের মগজ ধোলাই করে তাদের ভুল, নেতিবাচক আদর্শে বিশ্বাসী করে জঙ্গীবাদে দীক্ষা দিচ্ছে! প্রশ্ন হচ্ছে, খুনী-সন্ত্রাসীরা প্রায় সবাই জেলখানা থেকে বাইরে তাদের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কিভাবে যোগাযোগ রাখছে? কারারক্ষী বা অন্য কর্মীরা টাকার বিনিময়ে ওদের মোবাইলও ব্যবহার করতে দিচ্ছে, তাই নয় কি? গুলশান ক্যাফে হামলার জঙ্গীদের দু’জন আদালতে কিভাবে ‘আইএস’ লেখা টুপি মাথায় দিতে পারল? এমন কি, যদি মাথায় টুপি পরেও সঙ্গে সঙ্গে তাদের সঙ্গে থাকা পুলিশের দায়িত্ব ছিল না কি যে, তৎক্ষণাৎ একটানে টুপিটা সাংবাদিক বা জনতা দেখার আগেই খুলে ফেলে দেয়া? দেখা গেল, ওরা, পুলিশেরা টুপিটা পরা অবস্থায়ই তাদের হাঁটিয়ে নিয়ে জেলবাসে তুলেছে! অর্থাৎ জনগণ যেন এ টুপি দেখতে পায়, পুলিশ সে সময়টি ওদের দিয়েছে। এটা আমরা জানি ও মানি, এত জনসংখ্যার দেশে জঙ্গীদের টাকার প্রতি লোভ থাকা একশ্রেণীর পুলিশ ও আইনজীবীর থাকাই স্বাভাবিক। সরকার এই ক্ষেত্রে কাজ করতে হবে। এই কাজ করার সময় উপস্থিত হয়েছে। বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগে আমাদের কয়েকটি কাজ দ্রুত শুরু করতে হবে। যেমন- ১) জেলখানায় জঙ্গী ও খুনী, সন্ত্রাসী, ধর্ষকদের ‘ব্রেনওয়াশ’ বা ইতিবাচক মন বদলের শুভ ও কল্যাণ বোধে অনুপ্রাণিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ২) দুর্বল এফআইআর লেখা পুলিশ ও জঙ্গী-সন্ত্রাসীদের জামিনদাতা আইনজীবীদের তালিকা করে তাদের চাকরিবিধির গাফিলতির জন্য বিচার করার একটা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এদের জামিন দেয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করলে তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। তা হতে পারে লাইসেন্স বাতিল, অর্থদ- অথবা জেল। ৩) জঙ্গী-খুনী-সন্ত্রাসীদের জন্য একটি বিশেষ আইন করতে হবে, যাতে এরা অজামিনযোগ্য অপরাধের আওতায় তালিকাভুক্ত হয়। ৪) পাড়া ও মহল্লায় সন্ত্রাসী বাহিনীগুলোর তালিকা প্রস্তুত করে গডফাদারদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। সাঙ্গোপাঙ্গদের জেল-জরিমানা দিতে হবে। পাড়াগুলো সন্ত্রাসীমুক্ত করতে হবে। নতুবা নারীর ক্ষমতায়ন, শিশু-নারীর শান্তি দূর অস্ত থাকবে। ৫) দ্বিতীয়বার জামিন লাভ করে মুক্ত হওয়ার পর যে সব জঙ্গী-সন্ত্রাসী আবারও জঙ্গী-সন্ত্রাসী কাজে নিযুক্ত হবে, তাদের জন্য, যাবজ্জীবন জেলের ব্যবস্থা গ্রহণের উপযুক্ত আইন প্রয়োজনে নতুন করে প্রণয়ন করতে হবে। উন্নয়নের অর্থ শুধু অবকাঠামো, কৃষি বা বিদ্যুত নয়। সামাজিক উন্নয়নের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করে এসব সমাজ ধ্বংসকারীকে সমূলে উৎখাত করতে হবে। লেখক : শিক্ষাবিদ
×