ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাবান্ধা সীমান্ত ঘিরে নতুন বছর চার দেশকে বাঁধছে এক সুতোয়

প্রকাশিত: ১১:১২, ১ জানুয়ারি ২০২০

বাংলাবান্ধা সীমান্ত ঘিরে নতুন বছর চার দেশকে বাঁধছে এক সুতোয়

সমুদ্র হক/এ রহমান মুকুল ॥ দেশের সর্বউত্তরের বাংলাবান্ধা ট্রানজিট পয়েন্ট ও সীমান্ত বন্দর দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার চার দেশের অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। তবে সব পদক্ষেপের ধীর গতি সম্ভাবনার বাড়াতে পারছে না গতি। আশা করা হয়েছে নতুন বছর ’২০ বাংলাবান্ধা পয়েন্টকে বাংলাদেশ ভারত নেপাল ও ভুটানকে বন্ধুত্বের সূতায় বেঁধে দেবে। চতুর্দেশীয় বাণিজ্যেরও একটি বড় পথ খুলে যাবে। আওয়ামী লীগ প্রথম দফায় ক্ষমতার আসার এক বছর পর ৯৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাবান্ধাকে বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যে ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে উদ্বোধন করা হয়। একই সময়ে বাংলাবান্ধার অপর প্রান্তে ভারতের ফুলবাড়ী স্থলবন্দরের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের উদ্বোধন করা হয়। পরে নেপালের সঙ্গে বাণিজ্য পরিবহন পারাপারে ভারতের অংশ ফুলবাড়ী থেকে নেপালের কাঁকরভিটা পর্যন্ত ৩২ কিমি পথ পণ্য পরিবহনে ভারতের সঙ্গে দুই দেশের (বাংলাদেশ ও নেপাল) চুক্তি হয়। আরও পরে চারদেশের যোগাযোগে সরাসরি সড়ক পথ ব্যবহারে পারস্পরিক ভেহিক্যাল এগ্রিমেন্টের (যানবাহন চলাচল চুক্তি) উদ্যোগ নেয়া হয়। এই উদ্যোগে বাংলাদেশ ভারত নেপাল সাড়া দিলেও তবে ভুটান চুক্তি না করায় থমকে আছে। এরই মধ্যে বাংলাবান্ধা বন্দর হয়ে ভারতের শিলিগুড়ি, দার্জিলিং ও সিকিমের রাজধানী গ্যাংটক পর্যন্ত সরাসরি বাস সার্ভিসের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ’১৮ সালে প্রাইভেট একটি পরিবহন সংস্থার কোচ পরীক্ষামূলক একদিন সীমান্ত অতিক্রম করে সরাসরি ভারতীয় শিলিগুড়ি চলাচল করে। ’১৯ সালের শেষদিকে বিআরটিসি ঢাকা থেকে বাংলাবান্ধা সীমান্ত হয়ে ভারতের শিলিগুড়ি দার্জিলিং ও সিকিমের রাজধানী গ্যাংটক চলাচলের সব ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে। ইতোমধ্যে বিআরটিসির একটি কোচ পরীক্ষামূলক চলাচলে পথঘাট দেখে এসেছে। একাধিক সূত্র জানায় বাংলাবান্ধার অপরপ্রান্ত ভারতীয় ফুলবাড়ী অংশ থেকে ভারতের পানিরট্যাঙ্ক (ওপারে নেপালের কাঁকরভিটা) পর্যন্ত দুই লেনের রাস্তা চার লেন করা হয়েছে। বাংলাবান্ধার অপর প্রান্তে থেকে ভারতীয় অংশে গজলডোবা বাঁধের ওপর দিয়ে ভুটান সীমান্তের জয়গা পর্যন্ত রাস্তা চার লেন করা হয়েছে। এদিকে ঢাকা থেকে বাংলাবান্ধা পর্যন্ত তিনটি পর্বে রাস্তা প্রশস্ত করে চার লেন ও ছয় লেনের কাজ চলছে। সাউথ এশিয়া সাব রিজিওনাল ইকোনমিক কোঅপারেশন (সাসেক) চার লেন সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু করেছে ’১৭ সালে। বিদায়ী ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সাসেক-১ চারলেন সড়ক প্রকল্পের ঢাকার জয়দেবপুর থেকে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব প্রান্তের এলেঙ্গা পর্যন্ত প্রায় ৭৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। সাসেক-২ প্রকল্পের আওতায় বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম প্রান্তের হাটিকুমরুল থেকে রংপুর সিটির মডার্ন মোড় পর্যন্ত প্রায় ১৯১ কিমি ছয় লেন রাস্তার কাজ এ বছর শুরু হয়ে ’২৩ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। এরপরই সাসেক-৩ প্রকল্পের আওতায় রংপুর থেকে বাংলাবান্ধা পর্যন্ত চার লেন রাস্তার কাজ শুরু হবে। অপর একটি সূত্রের মতে ঠিকাদার নিয়োগসাপেক্ষে সাসেক-৩ কাজ দ্রুতই শুরু হতে পারে। বাংলাবান্ধা ঘিরে পর্যটক আকর্ষণে পর্যটন কর্পোরেশন (বিপিসি) পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। ভারত নেপাল ও ভুটানে বাংলাদেশের পর্যটকের আকর্ষণ রয়েছে। ওসব দেশের পর্যটকের কাছে যেন বাংলাদেশের পর্যটন ও প্রতœসমৃদ্ধ এলাকা আকর্ষণ করে সরকারী- বেসরকারী পর্যায়ে সেই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বেসরকারী সংস্থা জয়পুরহাটের একটি প্রতিষ্ঠান বলেছে উল্লিখিত দেশগুলোর ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক অঞ্চল বহুকাল ধরে পর্যটক আকর্ষণের সঙ্গে বাণিজ্যের পথ খুলে দিয়েছে। এই পথে বিভিন্ন জেলার বেসরকারী ট্যুর অপারেটরদের মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন কমপ্যান্ট ট্যুরিজম চলছে, যাতে চতুর্দেশীয় ট্যুরিজম ও বাণিজ্য শুরু করা যায়। একই কথা বলেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের এ্যাসোসিয়েশন ফর কনজারভেশন এ্যান্ড ট্যুরিজম নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। তাদের মতে, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বগুড়া নওগাঁ দিনাজপুর রাজশাহী নাটোর পাবনা রংপুর কুমিল্লা ঢাকা ময়মনসিংহ চট্টগ্রাম কক্সবাজার বরিশাল যশোর খুলনা সিলেটসহ বিভিন্ন স্থানে এবং ভারতের প্রতিটি রাজ্যে যত পর্যটন স্পট এবং যে প্রতœ সম্পদের সম্ভার রয়েছে তা যুগে যুগে পর্যটক আকর্ষণ করেছে। একইভাবে নেপাল ভুটানেও রয়েছে পর্যটক সম্পদ। বাংলাবান্ধা সীমান্ত হয়ে উঠতে পারে চার দেশের মেল বন্ধন। পঞ্চগড় চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির ভাইস প্রেসিডেন্ট মেহেদী হাসান বাবলা বললেন, বাংলাবান্ধা সীমান্ত পর্যটনের পাশাপশি চতুর্দেশীয় বাণিজের অপার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। বছর কয়েক আগে চার দেশের বাণিজ্যমেলা হয়েছে পঞ্চগড়ে। পঞ্চগড় এম আর সরকারী কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ দেলোয়ার হোসেন বলেন, পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া থেকে হিমালয়ের কাঞ্চনজঙ্ঘা চূড়া যে অপার সৌন্দর্যে দৃশ্যমান হয় বাংলাবান্ধা বন্দর সেই সৌন্দর্যই বয়ে আনবে চারদেশের সম্প্রীতির মেলবন্ধনে। বাংলাবান্ধা সীমান্তের অপর প্রান্তে ভারতের ফুলবাড়ী। ফুলবাড়ী থেকে ৩২ কিলোমিটার পর নেপালের কাঁকরভিটা। বাংলাবান্ধা থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে শিলিগুড়ি। সেখান থেকে জলপাইগুড়ি জেলার ওপর দিয়ে ভুটানের সীমান্ত জয়গা। বাংলাবান্ধা ইমিগ্রেশন থেকে জানা যায় বছর তিনেক আগে প্রতিদিন গড়ে ৬০ যাত্রী পারাপার হতো। বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে অন্তত চার শ’ যাত্রী এই পথে যাতায়াত করে। ঈদের ছুটি ও সরকারী ছুটির সঙ্গে বাড়তি কোন ছুটি মিললে এই সংখ্যা বেড়ে দেড় থেকে দুই হাজারে ওঠে। ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস কর্মকর্তাদের হিমশিম খেতে হয়। সীমান্ত অতিক্রমের ৮০ শতাংশই ট্যুরিস্ট। বাকিদের কেউ চিকিৎসা ও কেউ স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য যান।
×