ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন বছরে ভাল শুরুর প্রত্যাশা

বছরব্যাপী নানা আইনী সংস্কারেও শেয়ারবাজারে ছন্দপতন

প্রকাশিত: ০৮:৫৩, ১ জানুয়ারি ২০২০

বছরব্যাপী নানা আইনী সংস্কারেও শেয়ারবাজারে ছন্দপতন

অপূর্ব কুমার ॥ ২০১৯ সালে বিশ্ব শেয়ারবাজারের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি দেশের শেয়ারবাজার। বিশ্বজুড়ে শেয়ারবাজারগুলো মূল অর্থনীতিতে ১৭ ট্রিলিয়ন ডলার যোগ করেছে। এ তথ্য জানিয়েছে জার্মানির ডয়েচে ব্যাংক। কিন্তু বাংলাদেশে অর্থনীতিতে যোগ করেছে সামান্যই। তবে নতুন বছরকে ঘিরে প্রত্যাশার বীজ বুনেছে বিনিয়োগকারী ও বাজার সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, গত এক বছরে সূচকের টানা পতনের কারণে বাজারের বেশিরভাগ শেয়ারের দর এখন লোভনীয় পর্যায়ে রয়েছে। দেখেশুনে শেয়ার কিনলে এই পর্যায় থেকে লোকসানের সম্ভাবনা কম। উল্টো আগামীবছরে নতুন আশার সঞ্চার করতে পারে শেয়ারবাজার। সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে শেয়ারবাবাজার থেকে টাকা উত্তোলনের হার কমেছে। বিগত ১১ বছরের মধ্যে ২০১৯ সালে শেয়ারবাজারে শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে সর্বনিম্ন অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে। এ বছরে শেয়ারবাজারের মাধ্যমে ৬৪১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে। যার পরিমাণ ২০১৮ সালেও ছিল ৬৫৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা। তবে শেয়ারবাজারকে চাঙ্গা করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগ ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু বিদেশী বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রির চাপ ও তারল্য সঙ্কটের কারণে সার্বিক সূচক কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। মোদ্দা কথা ২০১৯ সাল মোটেই ভাল যায় না বিনিয়োগকারীদের জন্য। জার্মানির ডয়েচে ব্যাংক জানায়, ২০১৯ সালের শুরুতে পুঁজিবাজার থেকে বৈশ্বিক অর্জিত আয়ের পরিমাণ ছিল ৭০ ট্রিলিয়ন ডলার। যা এ মুহূর্তে ৮৫ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। মূল কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, এ বছর তিন দফা সুদহার কমিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ও ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক। যা চাঙ্গা করেছে পুঁজিবাজারকে। সেই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর মুদ্রানীতির পরিবর্তনও পাল্টে দিয়েছে চিত্র। সমাপ্ত বছরে বিভিন্ন নীতি সংস্কার ও প্রণোদনা দেয়ার পরেও আলোর মুখ দেখেনি দেশের পুঁজিবাজার। শুধু সরকারই নয় পুঁজিবাজারকে তুলে ধরতে সংস্কারমূলক নানা পদেক্ষেপ ছিল নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি)। এই বছরে পুঁজিবাজার উন্নয়নের জন্য খাতটির সমস্যা ও করণীয় নিয়ে সচেষ্ট ছিল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালনা পর্ষদ। এছাড়া বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স এ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ), ডিএসই ব্রোকার্স এ্যাসোসিয়েশন (ডিবিএ) অর্থমন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডেরও (এনবিআর) উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। এতকিছুর পরও বাজারকে ঘুরে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। লেনদেন ও সূচকের অবস্থান এখন প্রায় চার বছরের মধ্যে সবচেয়ে নিচে। চলতি বছরে পুঁজিবাজারে মূলত তিনটি কারণে পতন হয়েছে। গত দুই মাসে যে পরিমাণে সূচক কমেছে তার কারণ হচ্ছে বিদেশীদের বিক্রয় এবং গ্রামীণ ফোনের ইস্যু বলে জানান নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেন। বছরের শুরুর দিকে ডিএসই ব্রোকার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি শাকিল রিজভী প্লেসমেন্ট নিয়ে কথা বললে এ বিষয়টি আলোড়ন সৃষ্টি করে। এর মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে বলে দাবি জানান তিনি। পরে বিষয়টি সমাধানের জন্য কমিশনের কাছে ডিএসই প্রস্তাব করলে প্লেসমেন্টের লক-ইন বাড়ানো হয়। এবং পরবর্তীতে পাবলিক ইস্যু রুলস ২০১৫ সংশোধন করে চূড়ান্ত করা হয়। সংশোধনে মোট ২২টি বিষয় তুলে ধরা হয়। এতে বুক বিল্ডিংয়ে পরিবর্তনসহ আইপিও ইস্যু রুলসেও পরিবর্তন আনা হয়। বুক বিল্ডিংয়ে যোগ্য বিনিয়োগকারীদের কোটা ৬০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫০ শতাংশ করার সিদ্ধান্ত নেয়। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কোটা ৩০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ করা হয়। অন্যদিকে ফিক্সড প্রাইস পদ্ধতিতে যোগ্য বিনিয়োগকারীদের কোটা ৪০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩০ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কোটা ৪০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করা হয়। এছাড়া উদ্যোক্তা/পরিচালক ও ১০ শতাংশ বা তার বেশি শেয়ারধারণকারীদের শেয়ারে লক-ইন এর মেয়াদ বাড়ানো, পরিচালকদের পৃথকভাবে ২ শতাংশ ও সম্মিলিতভাবে ৩০ শেয়ার ধারণ কড়াকড়ি আরোপ, ঘোষণা ছাড়াই উদ্যোক্তা/পরিচালকদের শেয়ার বিক্রির রাস্তা বন্ধ, সেকেন্ডারিতে স্বল্প শেয়ারের কারণে কারসাজি রোধে আইপিওতে ফিক্সড প্রাইস মেথডে কমপক্ষে ৩০ কোটি টাকা ও বুক বিল্ডিং মেথডে ৭৫ কোটি টাকা উত্তোলন করা। এছাড়া ‘জেড’ ক্যাটাগরির কোম্পানির উন্নয়নে কমিটি গঠন, লেনদেনের প্রথমদিন সার্কিট ব্রেকার আরোপ, স্মল ক্যাপ মার্কেট গঠন, অল্টারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ড বিধিমালা প্রণয়ন, কাস্টমার কমপ্লেইন্ট এ্যাড্রেস মডিউল চালু, ফান্ডের লভ্যাংশ প্রদানের ক্ষেত্রে রি-ইনভেস্টমেন্ট ইউনিট (আরআইইউ) বাতিল ইত্যাদি সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। বিএসইসির পাশাপাশি শেয়ারবাজারকে সহযোগিতার জন্য অর্থমন্ত্রণালয় ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার্থে প্রণোদনা স্কিমের আওতায় আদায়কৃত (সুদ ও আসল) ৮৫৬ কোটি টাকা পুনর্ব্যবহারের অর্থাৎ আবার পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের সম্মতি দিয়েছে। আর তারল্য সঙ্কট কাটিয়ে তুলতে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা থেকে অতালিকাভুক্ত (ইক্যুইটি শেয়ার, নন-কনভার্টএ্যাবল প্রেফারেন্স শেয়ার, নন-কনভার্টএ্যাবল বন্ড, ডিবেঞ্চার, ওপেন-ইন্ড মিউচুয়্যাল ফান্ড) সিকিউরিটিজকে বাদ দিয়ে সার্কুলার জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বাজেটে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর জন্য মুনাফার সর্বনিম্ন অংশ ও নগদ লভ্যাংশ প্রদানে উৎসাহী করা হয়। গত ২৯ এপ্রিল স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বৈঠকে বিতর্কিত প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) পূর্ব প্লেসমেন্টে শেয়ার ইস্যু (ক্যাপিটাল রেইজিং) নিয়ে কঠোর অবস্থানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। এরপরের দিন, ৩০ এপ্রিল অতালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য প্রাইভেট প্লেসমেন্টে অর্থ উত্তোলন সংক্রান্ত আবেদন গ্রহণ করা হবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয় বিএসইসি। একইসঙ্গে পাবলিক ইস্যু রুল সংশোধন হওয়ার আগে নতুন করে আর কোন প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) আবেদন না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এছাড়া বিনিয়োগসীমা সমাধানে গত ১৬ মে সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ লক্ষ্যে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা থেকে অতালিকাভুক্ত (ইক্যুইটি শেয়ার, নন-কনভার্টএ্যাবল প্রেফারেন্স শেয়ার, নন-কনভার্টএ্যাবল বন্ড, ডিবেঞ্চার, ওপেন-ইন্ড মিউচুয়্যাল ফান্ড) সিকিউরিটিজকে বাদ দিয়ে সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। যাতে শেয়ারবাজারে ব্যাংক থেকে বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ানো যাবে। আগামীতে কোম্পানির সম্প্রসারণ, সুষমকরণ, আধুনিকীকরণ, পুনর্গঠন ও বিস্তার (বিএমআরই) এবং গুণগতমান উন্নয়ন ব্যতীত বোনাস শেয়ার ঘোষণা করা যাবে না বলেও ২১ মে সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। বোনাস শেয়ার ঘোষণার নিয়ে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য (পিএসআই) প্রকাশের সময় বোনাস শেয়ার ঘোষণার কারণ এবং এর বিপরীতে রেখে দেয়া মুনাফা কোথায় ব্যবহার করা হবে, তা উল্লেখ করতে হবে। চলতি বছরে সংসদে বাংলাদেশের ৪৯তম ও বর্তমান সরকারের ১১তম বাজেটে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোন কোম্পানির নির্দিষ্ট বছরের মুনাফার ৭০ শতাংশের বেশি রিটেইন আর্নিংস, রিজার্ভ বা সারপ্লাস হিসেবে রাখলে, তার ওপরে ১০ শতাংশ হারে কর দেয়ার সংশোধিত প্রস্তাব করা হয়। অর্থাৎ ৭০ শতাংশের বেশি রিজার্ভে রাখার ক্ষেত্রে, পুরো অংশের ওপরে ১০ শতাংশ কর দিতে হবে। এছাড়া নির্দিষ্ট বছরে নগদ লভ্যাংশের থেকে বেশি বোনাস শেয়ার ঘোষণা বা বিতরণ করলে, তার ওপরে ১০ শতাংশ হারে কর দিতে হবে। আর নগদ লভ্যাংশ না দিলেও বোনাস শেয়ারের ওপরে ১০ শতাংশ হারে কর দিতে হবে। গত ১৬ জুলাই বুক বিল্ডিং পদ্ধতির সংশোধনীর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এতে প্রস্তাবিত দরেই শেয়ার কিনতে হবে নিলামে অংশগ্রহণকারীদের। এছাড়া যে পরিমাণ শেয়ার কেনার জন্য দর প্রস্তাব করবে, সেই পরিমাণ কিনতে হবে বলে বিএসইসি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। ওইদিনেই বুক বিল্ডিং সংশোধনীর সিদ্ধান্তের পাশাপাশি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত মিউচুয়্যাল ফান্ডের লভ্যাংশ প্রদানের ক্ষেত্রে রি-ইনভেস্টমেন্ট ইউনিট (আরআইইউ) পদ্ধতি বাতিল করে বিএসইসি। সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (মিউচুয়্যাল ফান্ড) বিধিমালা ৬৬ অনুযায়ী লভ্যাংশ প্রদানের ক্ষেত্রে রি-ইনভেস্টমেন্ট ইউনিট (আরআইইউ) পদ্ধতি এখন বাতিল। ফলে বে-মেয়াদী এবং মেয়াদী উভয় ধরনের ফান্ডের ক্ষেত্রেই কেবলমাত্র নগদ লভ্যাংশ প্রদান করা যাবে। গত ৩০ সেপ্টেম্বর উন্নত পুঁজিবাজার গঠনের লক্ষে বিনিয়োগকারীদের সকল সমস্যা এবং অভিযোগ সম্পর্কে জানতে অনলাইন মডিউল চালু করেছে বিএসইসি। ‘কাস্টমার কমপ্লেইন্ট এ্যাড্রেস মডিউল’ (সিসিএএম) নামে তৈরি করা এই সফটওয়্যার আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করা হয়। গত ২৮ অক্টোবর বিএসইসির চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেনের পরামর্শে স্বচ্ছ ও ভাল কোম্পানি আনয়নের লক্ষ্যে আইপিও রিভিউ টিম গঠন করেছে ডিএসই। ডিএসইর দাবিতে গত ১৫ নবেম্বর আইপিও কোম্পানি বাজারে লেনদেনের প্রথমদিন সার্কিট ব্রেকার আরোপের নতুন নিয়ম চালু করে কমিশন।
×