ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পরীক্ষিৎ চৌধুরী

পাঠ্যপুস্তক বিতরণে সাফল্য

প্রকাশিত: ০৮:৩৮, ১ জানুয়ারি ২০২০

পাঠ্যপুস্তক বিতরণে সাফল্য

ইংরেজী বছরের প্রথম দিনে সারাদেশের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা মেতে উঠে এক অন্যরকম উৎসবে। বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণের উৎসব। যে উৎসব বিনামূল্যে চকচকে নতুন পাঠ্যবই হাতে পাওয়ার উৎসব। বছরের প্রথম দিনই স্কুলে যেয়ে নতুন বই হাতে পেয়ে দেশের শিশু-কিশোররা মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। বইয়ের সুঘ্রাণ শুঁকতে শুঁকতে তারা বাড়ি ফিরে। বাড়ি ফিরেও তারা বারবার নতুন বই হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে, নাকের কাছে নিয়ে সুবাস খুঁজে বেড়ায়। প্রতি বছর একই দিনে কয়েক কোটি শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যে নতুন পাঠ্যপুস্তক তুলে দিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয় বাংলাদেশ। বছরের প্রথম দিনে সবাই এক অন্য বাংলাদেশকে দেখতে পায়। এই বাংলাদেশ এক উচ্ছ্বসিত, উদ্ভাসিত, আলোকিত বাংলাদেশ। ১৯৮৩ সাল থেকে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় শুরু হয় বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিতরণ। তবে ২০০৯ সাল পর্যন্ত প্রাথমিক স্তরের নির্ধারিত কয়েকটি বিষয়ের বই শিক্ষার্থীদের দেয়া হতো। ওই সময়ে এক শিক্ষার্থীকে অর্ধেক নতুন আর অর্ধেক পুরনো বই দেয়া হতো। অর্থাৎ বিনামূল্যের পাশাপাশি বাজার থেকে বেশ কিছু বইও তখন কিনতে হতো অভিভাবকদের। বেসরকারী পর্যায়ে যখন বই বিতরণ করা হতো তখন বইয়ের মূল্য ছিল অস্বাভাবিক। কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের জিম্মি করে বই গুদামজাত করা হতো। বেসরকারী প্রকাশকরা যাচ্ছেতাইভাবে এ কাজটি করত প্রতিবছর। অসাধু প্রেস মালিকদের সিন্ডিকেটের কবলে পড়ত পাঠ্যবই ছাপার কাজ। সব বই পাওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের মার্চ-এপ্রিল মাস পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হতো। প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেই অপেক্ষা জুন মাস পর্যন্ত গিয়ে ঠেকত। স্বাভাবিকভাবেই তখন পূর্ণোদ্যোমে ক্লাস শুরু হতেও অনেক দেরি হতো। সময়মতো বই না পাওয়ায় এবং উচ্চ মূল্যে বাজার থেকে বই কিনতে না পেরে প্রতিবছর ব্যাপক সংখ্যক ছাত্রছাত্রী প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর থেকে ঝরে পড়ত। ঝরেপড়া রোধ করে শতভাগ শিশুকে বিদ্যালয়ে ধরে রাখার লক্ষ্যে ২০০৯ সালে মাধ্যমিক পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে পাঠ্যবই দেয়ার যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তৎকালীন সরকার। সর্বস্তরের শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করা এবং ঝরেপড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমানোই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। ২০১০ শিক্ষাবর্ষ থেকে জানুয়ারির ১ তারিখেই প্রাথমিক, মাধ্যমিক, এবতেদায়ী, দাখিল, কারিগরিসহ সর্বস্তরের শতকরা একশত ভাগ শিক্ষার্থীর মাঝে বিনামূল্যে বই বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়। শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দিয়ে নতুন শিক্ষাবর্ষ সূচনার উদ্যোগ নেন শেখ হাসিনা। এভাবেই বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণের উৎসব পালন শুরু হয় দেশে। পরে যুক্ত হয় প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ও। আর সেইসঙ্গে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের হাতেও সরকার তুলে দিচ্ছে ডিজিটাল পাঠ্যবই, ব্রেইল বই ও মাল্টিমিডিয়া সিডি। শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির লক্ষ্যে এটুআই প্রোগ্রাম, সমাজকল্যাণ এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে এই কার্য়ক্রম বাস্তবায়ন হচ্ছে। এভাবেই বিনামূল্যে কোটি কোটি বই ছেপে সেই বই শিক্ষার্থীদের নাগালে পৌঁছে দিয়ে পৃথিবীর বুকে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাংলাদেশ। বছরের শুরুটাই কত রোমাঞ্চকর আমাদের শিশুদের জন্য। নতুন বই প্রাপ্তির খুশিতে দেশের প্রতিটি জেলার শহর-গ্রাম-গঞ্জের স্কুলে স্কুলে ১ জানুয়ারি সাড়া পড়ে যায়। প্রথম শ্রেণী থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত সব শিশু-কিশোরই শরিক হয় এই উৎসবে। বছরের প্রথম দিনে স্কুলগামী শিশুদের জন্য এর চেয়ে বড় উপহার, বড় আনন্দের বিষয় আর কি হতে পারে! বিভিন্ন প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে প্রতি বছরই প্রথম দিনে প্রায় সকল শিক্ষার্থীর হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে নতুন নতুন বই। শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই পুরোদমে শুরু হচ্ছে ক্লাস। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমরা সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে এগিয়ে যাচ্ছি। উন্নয়ন যতই হোক না কেন এখনও দেশের হতদরিদ্রদের কথা সরকারকে ভাবতে হয়। এই ভাবনার প্রতিফলন দেখতে পাই সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়ানোর উদ্যোগের মধ্য দিয়ে। অর্থনৈতিক বৈষম্য কমাতে এবং সর্বজনীন শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে বিনামূল্যে বই দেয়ার ব্যবস্থা করেছে সরকার। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে চতুর্থবারের মতো সরকার গঠিত হওয়ার পর এই ধারাবাহিকতা আরও বেগবান হয়েছে। বর্তমান সরকারের প্রধান সাফল্যগুলোর একটি হচ্ছে সময়মতো শিশুদের হাতে নতুন বই তুলে দেয়া। আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রাক-প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের চার কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থীর হাতে ৩৫ কোটি ৩১ লাখ ৪৪ হাজার বিনামূল্যের পাঠ্যবই তুলে দেয়া হবে। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরের ১০ কোটি ৫৪ লাখ দুই হাজার ৩৭৫টি, মাধ্যমিক স্তরের ২৪ কোটি ৭৭ লাখ ৪২ হাজার ১৭৯টি। বছরের প্রথম দিন দেশজুড়ে স্কুলে স্কুলে উৎসবের মধ্য দিয়ে প্রতিটি শিক্ষার্থীর হাতে তুলে দেয়া হবে নতুন ঝকঝকে পাঠ্যবই। শিক্ষার্থীরা আবারও আনন্দ-উল্লাসে মেতে উঠবে। গত ১০ বছরে শিক্ষার্থীদের মাঝে ২৯৬ কোটি পাঠ্যবই বিতরণ করেছে সরকার। এ বছরের বইয়ের সংখ্যা যুক্ত করলে এ সংখ্যা হবে ৩৩১ কোটি ৫২ লাখ। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় পাসের হার বৃদ্ধি, নারী শিক্ষার্থীদের ক্লাসে উৎসাহব্যঞ্জক উপস্থিতি এবং মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত বিনামূল্যে বই বিতরণ- এগুলো শিক্ষাক্ষেত্রে ধনাত্মক নির্দেশক। পরিসংখ্যানই দেখিয়ে দিচ্ছে বিদ্যালয়ে আসা শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়ছে । গত ১১ বছর আগে দেশে বিদ্যালয়ে আসা শিশুদের হার ছিল ৮০ শতাংশের একটু বেশি। কিন্তু ১০ বছরের মাথায় এখন প্রায় শতভাগ শিশু স্কুলে আসছে। শিক্ষাবিদসহ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিনামূল্যের পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে এনেছে, যা দেশের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আন্তর্জাতিক মহলেও বাংলাদেশের এই চিত্র ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। দেশটি মাত্র মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। আমাদের সম্পদও সীমিত। দেশে দারিদ্র্যের হার কমে বর্তমানে ২০.৫ এবং অতি দারিদ্র্যের হার কমে ১০.৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আর্থিক দৈন্যতার কারণে দেশের অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের বেশিদিন বিদ্যালয়ে পাঠাতে পারে না। দ্রুত অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। এমন অর্থনৈতিক অবকাঠামোর প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেয়ার এই সরকারী উদ্যোগ যে কতটা স্বস্তিদায়ক তা সেই অভিভাবকরাই অনুভব করতে পারেন। আজকের শিক্ষার্থীরা সৌভাগ্যবান, বইয়ের জন্য তাদের অপেক্ষার প্রহর কাটাতে হয় না। অভিভাবকদেরও দুশ্চিন্তায় পড়তে হয় না যে, তাদের সন্তানদের জন্য আদৌ নতুন বই তারা কিনতে পারবেন কিনা। অর্থের অভাবে বই ক্রয় করতে না পারা অভিভাকরাও এখন তাদের শিশুদের নিশ্চিন্তে বিদ্যালয়ে পাঠাতে পারছেন। সামর্থ্যবান আর সামর্থ্যহীনের ভেদাভেদ ভুলিয়ে দেয়ার এই অনির্বচনীয় দৃশ্য বছরের প্রথমদিনই দেশবাসী দেখতে পাচ্ছে। ধনী-গরিব নির্বিশেষে সকল শিশু-কিশোর আজ নতুন বই হাতে পাচ্ছে একই দিনে। স্কুলে আসা শিক্ষার্থীদের মাঝে সব ভেদাভেদ মিলিয়ে দিয়েছে এই একটি দিন। হতদরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য এই মহতী পদক্ষেপ আশীর্বাদ হিসেবে দেখা দিয়েছে। তাদের শিক্ষাজীবনে বিশাল ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে এই উদ্যোগ। এ কৃতিত্ব নিঃসন্দেহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। পাঠ্যবই বিতরণের এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের ফলে দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের লিঙ্গ বৈষম্যও হ্রাস পেয়েছে। যার মাধ্যমে লিঙ্গ সমতা আনয়নে বাংলাদেশ এমডিজি অর্জনে সমর্থ হয়েছে। আর এ গৌরবের হৃদয়স্পর্শী আবেগ ছুঁয়ে যায় সকল শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, পুরো জাতিকে। শিক্ষা একটা জাতিকে স্বনির্ভর করে। ভাল শিক্ষা নির্ভর করে ভাল শিক্ষক ও ভাল বইয়ের ওপর। শিক্ষার শক্ত ভিত তৈরির জন্য নতুন বই হাতে তুলে দেয়া কিন্তু যথেষ্ট নয়। মেধাবী এবং মননশীল নাগরিক সৃষ্টির লক্ষ্যে বর্তমান সরকার সর্বোচ্চ আন্তরিকতা প্রদর্শন করছে। দেশের সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থার মানোন্নয়নে সরকার সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। নতুন নতুন স্কুল ভবন তৈরি করা হয়েছে। ক্লাসে ভাল আসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে শিক্ষাদানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। শিক্ষকরা যাতে পাঠদানে আরও উৎসাহী হন সেজন্য তাদের বেতন-কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। তাদের প্রশিক্ষণের আওতা বাড়ানো হয়েছে। স্কুলের এমপিওভুক্তির পরিধিও ব্যাপকহারে বাড়িয়েছে সরকার। পাশাপাশি এ কথা মাথায় রাখতে হবে, শিশুশিক্ষা যতবেশি আনন্দময় হবে ততবেশি তাদের মেধার উন্মেষ ঘটবে। কিন্তু আমাদের সরকারী-বেসরকারী বিদ্যালয়গুলোর নীতিনির্ধারকদের অদূরদর্শিতার কারণে বইয়ের বোঝা, কোচিংয়ের শৃঙ্খল আমাদের শিশুদের মনের আনন্দ অনেকটাই কেড়ে নিচ্ছে। শৈশবেই শিক্ষা হয়ে উঠছে ভীতিকর এক অধ্যায়। এ থেকে শিশুদের মুক্ত করার দৃশ্যমান উদ্যোগ নেয়া খুবই জরুরী। তাদের জন্য আনন্দময় শৈশব নিশ্চিত করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী অনেকবারই বলেছেন যে, শিশুদের কাঁধে বইয়ের বোঝা কমাতে স্কুল কর্তৃপক্ষগুলো যেন নজর দেন। এই ঘোষণার পর পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও আশানুরূপ সাড়া মিলছে না। বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ কর্মসূচী শিক্ষার প্রসার ও মান বৃদ্ধির সহায়ক তাতে সন্দেহ নেই। তবে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যোগ্য ও দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার লক্ষ্য অর্জনে এটাই একমাত্র শর্ত নয়। এজন্য শিশুর জানার ও ভাবনার জগৎকে প্রসারিত এবং গভীর করতে হবে। শিশু-কিশোররা যেন তাদের চিন্তার পরিধিকে বাড়াতে পারে তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পরিবার উভয়েরই। নতুন বই হাতে শিক্ষার্থীদের মুখগুলো যে আনন্দে উদ্ভাসিত হচ্ছে তাকে আরও আলোকিত করার প্রত্যয় যেন থাকে সকল অভিভাকের মাঝে। এই অঙ্গীকারের মশাল আগামী প্রজন্মকে পথ দেখাবে নিরন্তরÑএটা সময়ের প্রত্যাশা।
×