ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

৩০ লাখ কিয়াতসহ রোহিঙ্গা আটক

জিরো লাইনে বাড়ছে অবৈধ বাণিজ্য

প্রকাশিত: ০৯:২৬, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯

জিরো লাইনে বাড়ছে অবৈধ বাণিজ্য

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ তুমব্রু কোনারপাড়া বরাবর মিয়ানমার সীমান্তের জিরো লাইনে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের কারণে বিভিন্ন সমস্যা বাড়ছে। উখিয়া টেকনাফের ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গারা জিরো লাইনে থাকা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার পাশাপাশি এপারে নিয়ে আসছে ইয়াবা, স্বর্ণের চালান ও অবৈধ পণ্যাদি। রবিবার সন্ধ্যায় বিজিবি ৩০ লাখ কিয়াতসহ তিন রোহিঙ্গাকে আটক করেছে। জানা যায়, রাখাইন রাজ্যে স্থাপিত ইয়াবা তৈরির কারখানাগুলো থেকে বস্তাভর্তি ইয়াবার চালান এনে প্রথমে জমা করা হচ্ছে জিরো লাইনের ওই ক্যাম্পে। বিজিবি সদস্যদের পাহারায় রেখে সুবিধাজনক অবস্থা বুঝে রোহিঙ্গারা জিরো লাইনের ওই ক্যাম্প থেকে এপারে নিয়ে আসছে ইয়াবার চালান। সীমান্তের দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ ও স্থানীয়দের কেউ বুঝে উঠার আগেই ওই সব চালান ঢোকানো হয়ে থাকে কুতুপালং ও বালুখালী আশ্রয় শিবিরে। বাংলাদেশে পালিয়ে আসার সময় নিয়ে আসা মিয়ানমারের কিয়াত (মিয়ানমার মুদ্রা) চিহ্নিত কারবারিরা স্বল্পদামে কিনে ইয়াবার মূল্য বাবদ বুঝিয়ে দিচ্ছে সীমান্তের ওপারের ব্যবসায়ীদের। ইয়াবার চালান বিক্রি বাবদ মূল্য পরিশোধ করতে যাওয়ার সময় ঘুমধুম বিজিবি জওয়ানরা ত্রিশ লাখ কিয়াতসহ তিন রোহিঙ্গা যুবককে আটক করে। কক্সবাজার ৩৪ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে.কর্নেল আলী হায়দার আজাদ আহমেদ জনকণ্ঠকে জানান, রবিবার সন্ধ্যায় ঘুমধুম বেতবুনিয়া চেকপোস্টের বিজিবি সদস্যরা তুমব্রুগামী সিএনজি ট্যাক্সিতে তল্লাশি চালিয়ে ত্রিশ লাখ কিয়াত ও এক হাজার আট শ’ টাকাসহ তিন রোহিঙ্গাকে আটক করেছে। আটক রোহিঙ্গারা হচ্ছে-উখিয়ার কুতুপালং লম্বাশিয়া ক্যাম্প-১ এর আশ্রিত রোহিঙ্গা ইমাম হোসেনের পুত্র মোঃ সেলিম, বালুখালী ক্যাম্প নং-৯ এ আশ্রিত রোহিঙ্গা শাহ আলমের পুত্র মোঃ বাশের ও একই ক্যাম্পের মোঃ রফিকের পুত্র নুরুল আমিন। তাদের নাইক্ষ্যংছড়ি থানায় সোপর্দ করা হয়েছে। সূত্র জানায়, বাংলাদেশে পালিয়ে আসলেও রোহিঙ্গারা চোরাচালান বাদ দেয়নি। ওপারে বসবাসরত রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের সঙ্গে ঠিকই সম্পর্ক রেখেছে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা। উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে মিয়ানমারে পাঠানোর প্রাক্কালে ৩০ লাখ কিয়াতসহ তিন রোহিঙ্গাকে আটকের ঘটনা ভাবিয়ে তুলেছে সচেতন মহলকে। রবিবার সন্ধ্যায় ঘুমধুম বেতবুনিয়া এলাকার চেকপোস্টে তাদের আটক করতে সক্ষম হয়েছে বিজিবি জওয়ানরা। সচেতন মহল বলেন, রোহিঙ্গারা এদেশে আশ্রিত উদ্বাস্তু। তারা লাখ লাখ টাকা, মিয়ানমারের বিপুল কিয়াত লেনদেন ও ইয়াবার চালান আনা নেয়ার মানে হয় না। শরণার্থী আইন অনুসারে উদ্বাস্তুরা ব্যবসা করতে পারেনা। মিয়ানমার অভ্যন্তরে জিরো লাইনে থাকা রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশকারী বা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গা নয়। তারা এখনও মিয়ানমার অভ্যন্তরে রয়েছে। তাদের জন্য অতি উৎসাহী কতিপয় এনজিও নিয়মিত ত্রাণ সামগ্রী পাঠাচ্ছে ওখানে। দু’দেশের সরকারের লাইসেন্স ছাড়া এক দেশ থেকে অন্য রাষ্ট্রে কোন ধরনের মাল পাঠানো যায়না। অনুমতি বিহীন কোন পণ্য পাঠালে তা চোরাচালানের আওতায় পড়ে। সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে মিনি ট্রাকভর্তি করে বিভিন্ন ত্রাণ সামগ্রী মিয়ানমারে পাচার করার সময় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে কোন ধরনের বাধা দেয়া হয়না। এক শ্রেণীর অসৎ কর্মচারীর সঙ্গে গোপন আঁতাত করে মিয়ানমারে ত্রাণ সামগ্রী পাচার করা হচ্ছে। সকাল-সন্ধ্যা ওপার থেকে রোহিঙ্গারা এ পারের তুমব্রু বাজারে এসে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি নিয়ে ফিরে যায় জিরো লাইনের ক্যাম্পে। এমনকি অনেকে ওই ক্যাম্প থেকে অনুপ্রবেশ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিচরণ ও ছবি ধারণ করে ফের পার হয়ে যাচ্ছে জিরো লাইনের ওই ক্যাম্পে। পরবর্তীতে ওইসব ছবি বা ভিডিও সরবরাহ দিচ্ছে ওপারের বিভিন্ন সংস্থার লোকজনকে। এটি দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ বলে মত প্রকাশ করেছেন অভিজ্ঞ মহল। আশ্রয় ক্যাম্পে দেয়া অতিরিক্ত ত্রাণ সামগ্রী, বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার তরফ থেকে নগদ টাকা পাওয়ার লোভে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা যেমন তাড়াতাড়ি প্রত্যাবাসন হতে আগ্রহী নয়, তেমনি জিরো লাইনের রোহিঙ্গাদেরও দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা জিরো লাইন ছেড়ে আরও ভেতরে এসে বসবাস করতে বললেও ত্রাণের লোভে ওই রোহিঙ্গারা জিরো লাইনের ক্যাম্প ছেড়ে যেতে রাজি হচ্ছেনা। জানা গেছে, মিয়ানমারে জিরো লাইনে অবস্থানকৃত রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ থেকে কোন ধরনের পণ্য পাঠানোর জন্য কাউকে অনুমতি প্রদান করা হয়নি। সীমান্তের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, রাখাইন রাজ্যে থাকা রোহিঙ্গা ও রাখাইন যুবকরা বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রিত চিহ্নিত রোহিঙ্গার কাছে ইয়াবার চালান পাঠায়। ইয়াবা বিক্রি করে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের কিয়াত ও বাংলাদেশী টাকা পৌঁছে দেয় রাখাইন অভ্যন্তরে স্থাপিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। ওপারের রাখাইন যুবক কারবারিরা জিরো লাইনের ওই ক্যাম্পে এসে নিয়ে যায় ইয়াবা বিক্রি বাবদ নগদ টাকা ও কিয়াত। জিরো লাইনের ওই ক্যাম্পে রাখাইন যুবক ও কতিপয় রোহিঙ্গা নিয়মিত ইয়াবা এবং স্বর্ণের চালান এনে জমা করে থাকে। বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা কারবারিরা সুবিধামতো সময়ে গিয়ে চোরাই পথে নিয়ে আসে ওই চালান। টেকনাফের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে ইয়াবার চালান রোধে বিজিবি কড়াকড়ি আরোপ করায় ওপারের কারখানা মালিক ও এজেন্টরা এখন ইয়াবার চালান পৌঁছাচ্ছে জিরো লাইনের ক্যাম্পে। চালান জমা রাখার জন্য ওই ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গা নেতাদের ওপারের ইয়াবা কারবারিরা বখশিশ দিয়ে থাকে বলে জানা গেছে।
×