ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

২০১৯ সালের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি

প্রকাশিত: ০৯:১০, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯

২০১৯ সালের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি

২০১৯ সালের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে নতুন বছরকে শুভেচ্ছা জানাতে উদগ্রীব সারাদেশ। দেখতে দেখতে পার করলাম পুরো ১টি বছর। আশা-নিরাশা, অর্জন, বিসর্জনের পাল্লায় চুলচেরা বিচার, বিশ্লেষণে- সব মিলিয়ে পেয়েছি অনেক, অপ্রাপ্তিও কম নয়। ২০১৯ সালটা শুরু হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনী বিজয়ের শুভযাত্রায়। ১০ বছরের উন্নয়ন দশককে অতিক্রম করার দুঃসাহসিক কর্মযোগের যাত্রাপথটা খুব সহজ আর নির্বিঘœ ছিল বলা যাবে না। তারপরেও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রায় দেশ এগিয়েছে অত্যন্ত সাবলীলভাবে। বিপরীতে অপশক্তিকে দৃঢ় মনোবলে মোকাবেলা করে সামনে চলার পথকে নিষ্কণ্টক করতে সব ধরনের কর্মপ্রচেষ্টা গ্রহণ করতেও পিছপা হয়নি বর্তমান সরকার। জনগণের সামনে নির্বাচনী অঙ্গীকারে প্রধানমন্ত্রীর প্রদত্ত প্রতিশ্রুতিগুলোর সফল বাস্তবায়নে সময়োচিত কর্মসূচী সারাদেশের একটি চলমান প্রক্রিয়া যা এখনও নিরন্তর কার্যপ্রবাহের অবিচল শক্তি। নাগরিকের ৫টি মৌলিক অধিকারের কর্মপ্রকল্পে পার করা দশ বছরে অনেকখানি এগিয়ে নেয়া সম্ভব হয়েছে। কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, অবকাঠামো, স্বাস্থ্যসেবা, আবাসন প্রকল্প, গ্রামকে শহরের কাছাকাছি আনার আনুষঙ্গিক প্রণোদনায় সর্বক্ষেত্রে উন্নয়নের সফল চিত্র দৃশ্যমান হতে সময় লাগেনি। যা বিশ্ব প্রতিবেদনেও বাংলাদেশের অবস্থানকে নজরকাড়া করেছে। অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া অর্ধাংশ নারী সমাজের সফল কর্মোদ্যোতনা দেশকে সমতাভিত্তিক দক্ষিণ এশিয়ার সমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবেও চিহ্নিত করেছে। গত দুই বছরের বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের প্রতিবেদনে লিঙ্গ সমতায় বাংলাদেশ পৃথিবীতে ৪৯তম ১৫১টি দেশের মধ্যে। আর দক্ষিণ এশিয়ায় একেবারে শীর্ষস্থানে অভিষিক্ত। বাংলাদেশ সেখানে শিক্ষা এবং রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নারীর ক্ষমতায়ন এবং জন্মহারে নারী-পুরুষের সমচিত্রে বিশ্বের ১ নম্বরে। প্রাথমিক এবং জুনিয়র শ্রেণীতে ছাত্রছাত্রীর কোন বৈষম্য তো নেই-ই ঝরে পড়ারও তেমন চিত্র অনুপস্থিত। তবে যথার্থ অর্থে রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং নেতৃত্বে এখনও লিঙ্গবৈষম্যকে কাটিয়ে উঠতে পারেনি বাংলাদেশ। নতুন বছরের নবউদ্দীপনায় এমন বিষয়টি আরও তীক্ষè পর্যবেক্ষণে নারীর রাজনীতিতে অংশীদারিত্ব বাড়াতে হবে। সেখানে তৃণমূল থেকে নতুন নেতৃত্ব এবং জাতীয় সংসদে সরাসরি ভোটে নির্বাচিতদের সংখ্যা আরও বাড়ানো সময়ের দাবি। তবে উদ্যোক্তা তৈরিতে বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে অর্ধাংশ এই গোষ্ঠী জোর কদমে এগিয়ে যাওয়ার চিত্রও সমাজকে আলোকিত করছে। সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে নারীর উচ্চপদে অভিষিক্ত হওয়ার সংখ্যাও ক্রমন্বয়ে বাড়ছে। ব্যবসায়িক সংগঠনের নেতৃত্বেও নারীদের সফলতা ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে। তবে নতুন সময়ও আবেদনকে সবক্ষেত্রে অবারিত করা এখনও সেভাবে অর্জন সম্ভব হয়নি। যার কারণে আজও বাল্যবিয়ে ঠেকানোর মতো অভিশাপ দৃশ্যমান হয় সংবাদ মাধ্যমে। এটা শুধু বাংলাদেশেই নয় পৃথিবীর অনেক দেশেই এখনও অবোধ বালিকাদের বিয়ে দেয়ার ঘটনাও হাতে গোনার অবস্থায় নয়। নারীর প্রতি সহিংসতা গণমাধ্যমকে সচকিত করলেও তার যথার্থ নির্মূল এখনও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। নারীকে মানুষ ভাবার মানবিক মূল্যবোধ সমাজকে নাড়া দিতে ব্যর্থ হলে উন্মত্ত পাশবিকতাকে ঠেকানো সম্ভব হতে আরও অপেক্ষা করতে হবে। গতানুগতিক সামাজিক অপসংস্কারকে শুধু তথ্যপ্রযুক্তি দিয়ে জয় করা সম্ভব হয় না। প্রযুক্তিগত বিদ্যার বিকাশমান যুগে চেতনার যথার্থ অগ্রগামিতা নতুন সময়ের এক আবিশ্যক শর্ত। অপসংস্কারের কঠিন রুদ্ধদ্বারে সজোরে আঘাত করতে হবে যাতে পুরনো সব ভাবনায় যা সংশ্লিষ্টদের জন্য মোটেও শুভ আর মঙ্গলজনক নয়। নতুনভাবে সম্পদকে অবারিত করাও অত্যন্ত জরুরী। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে শুধু নারী-পুরুষ নয় উচ্চ ও নিম্নবিত্ত ছাড়াও ধর্ম আর বর্ণের পার্থক্যও পাহাড়সম। এমন সব সামাজিক বিভাজনকে শেকড় থেকে উপড়ে ফেলা ছাড়া নতুন সময়কে তার গন্তব্যে পৌঁছানো কঠিন হবে। ২০২০ সালকে স্বাগত জানাতে এমন সব পিছিয়ে পড়া মান্ধাতা আমলের চিন্তা-চেতনাকে আধুনিক জগতের অনুষঙ্গ করে নতুন আলোকিত বিশ্বকে আয়ত্তে আনতে হবে। এটা খুব একটা কঠিন বিষয় নয়। ভাল মন্দ, ন্যায়-অন্যায় বোধ আর নতুন-পুরনোর দ্বন্দ্ব-সংঘাতকে নবচেতনায় উদ্দীপ্ত করতে পারলেই প্রযুক্তির সহগামিতা নিশ্চিত হবে। প্রযুক্তিসমৃদ্ধ বিশ্বে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব সময়ের যৌক্তিক দাবিতে এগিয়ে যাচ্ছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন আর নতুন নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চলের সম্ভাবনাময় কর্মযোগে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আর পরিবহন খাতকে উন্নত বিশ্বের সমপর্যায়ে নিতে খুব বেশি সময় লাগবে না। ইতোমধ্যে উন্নত সড়ক-মহাসড়কের নতুন ব্যবস্থাপনা এবং মেট্রো রেলের উন্নয়ন যাত্রা দৃশ্যমান হয়েছে। পদ্মা সেতুও তার নির্মাণাধীন মেগা প্রকল্পে অনেকখানি এগিয়ে যা দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ আর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার নতুন যুগ উন্মোচিত করবে। শিল্পায়নের এমন যুগসন্ধিক্ষণে নেতিবাচক অনেক কর্মযোগও সমাজকে বিভিন্নভাবে বিপন্ন করছে। উন্নয়নের ক্রমবর্ধমান অভিযাত্রায় এসব বিপরীত প্রতিক্রিয়াও সমান তালে দৃশ্যমান হতে থাকে সব যুগে ও দেশে। তাকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় অতিক্রম করা ছাড়া বিকল্প কোন পথ থাকে না। বর্তমান সরকার সমাজের দৃশ্যমান সঙ্কটগুলো সামলানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল। সেখানেও প্রয়োজনীয় নজরদারি, পর্যবেক্ষণ এবং চিহ্নিতকরণের মাধ্যমে অপরাধী এবং জড়িতদের শনাক্ত করা হচ্ছে- দলমত নির্বিশেষে। ক্যাসিনোর মতো অপরাধ চক্রকেও কঠোর নজরদারিতে এনে এর বিরুদ্ধে আইনী পদক্ষেপ নিতে সরকারকে ভাবতে হয়নি। নির্দ্বিধায়, নির্বিঘেœ দলীয় ছত্রছায়ায় গজিয়ে ওঠা অনেক চিহ্নিত দুর্বৃত্তকে আইনের বিধিতে আটক করা হয়েছে এবং অপরাধের যথাযথ বিচারেও কোন ধরনের ছাড় দেয়া হচ্ছে না। সামাজিক আবর্জনাকে নির্মূল করতে আইনী পদক্ষেপের বিভিন্ন কর্মপ্রবাহকে চলমান রাখা হচ্ছে। তবে বাংলাদেশে শিক্ষার হারে সমতাভিক্তিক অর্জন যেমন দৃশ্যমান একইভাবে মেধা ও মননে প্রাইমারি ও জুনিয়র পর্যন্ত এর অর্জনও কম নয়। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক তার নির্দিষ্ট গন্তব্যে এগিয়ে যাচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রায় সমান অংশীদারিত্বে। কিন্তু সবচাইতে সঙ্কটাপন্ন অবস্থা দৃশ্যমান হয়েছে উচ্চশিক্ষার পাদপীঠ সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরারের পাশবিক অত্যাচারে খুন হওয়া থেকে শুরু করে মেধা ও মননের এই তীর্থস্থানটিকে যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে তাও সারাদেশকে উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠায় ফেলে দেয়। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে নিয়ে এক পক্ষের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের যে আন্দোলন ও বিক্ষোভ, তারও যথার্থ সুরাহা এখন অবধি হয়নি। অমীমাংসিত অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়টি এখনও তার ক্রান্তিকাল পার করছে। বাংলাদেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় তেমন সুস্থির আর স্বস্তিতে নেই। তবে নতুন সালকে বরণ করার প্রাক্কালে এসব অনাকাক্সিক্ষত দুর্যোগও আস্তে আস্তে সামলানো সম্ভব হবে বলে আমরা আশান্বিত। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি থেকে শুরু হওয়া ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপে সারাদেশ উদ্বিগ্ন আর উৎকণ্ঠায় দুঃসহ সময় পার করেছে। ডেঙ্গু জ্বরের এমন আঘাত স্মরণকালের ইতিহাসে এক অনাকাক্সিক্ষত দুর্যোগ। অবশ্য এটা শুধু বাংলাদেশেই নয় উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায়ও এই মরণব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বজুড়ে চলে এর বিরুদ্ধে অভিযান, প্রতিকারের চেষ্টা। আমাদের দেশে তাৎক্ষণিক গৃহীত পদক্ষেপে এর বিস্তার অনেকাংশে হ্রাস পায়। তাই নতুন বছরের শুরুতেই ঘটে যাওয়া এসব দুর্যোগকে আমলে নিয়ে এর আগাম সতর্কতা এবং প্রয়োজনীয় কার্যক্রমকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় আনা দেশের জনগণের দায়িত্ব। বিদায়ী বছরে আমরা জেনেছি বসতবাড়ির আঙিনায় কিভাবে প্রাণঘাতী এডিস মশা তাদের আস্তানা তৈরি করে প্রজনন কর্মযোগে বংশ বিস্তারে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। সঙ্গত কারণে তীব্র শীতের কাঁপন পার হতে না হতেই এই এডিস মশাকে নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। ২০২০ সালের আকাক্সিক্ষত সম্ভাবনায় ডেঙ্গুর মতো ভয়ঙ্কর ব্যাধির আক্রমণে যাতে সাধারণ নিরীহ মানুষের জীবন আতঙ্কিত পর্যায়ে পৌঁছতে না পারে। সারাদেশের নগর, শহর এবং গ্রাম কর্তৃপক্ষের যেমন প্রয়োজনীয় কর্মসূচীর যথার্থ প্রয়োগ জরুরী পাশাপাশি মানুষের সর্বক্ষণিক নজরদারিও এক্ষেত্রে একান্ত আবশ্যক। নুসরাত, আবরার, রেণু এমন সব নির্মম হত্যাকা-ে সারাদেশ বিচলিত হলেও অভিযুক্তদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। ফলে নুসরাত হত্যার বিচারের রায়ে অভিযুক্তদের ফাঁসির আদেশ দেশকে বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থাশীল করেছে। আবরার হত্যার আসামিদের বিচারাধীন প্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান হবে এমন আশা অমূলক নয়। এদিকে ২০১৬ সালের হলি আর্টিজান হামলার মূল আসামিদের চিহ্নিত করে বিচারিক প্রক্রিয়ায় তাদেরও সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে আদালত। নির্যাতন ও সহিংসতার পাশাপাশি বিচার ব্যবস্থার দ্রুত কর্মপ্রক্রিয়াও আমাদের অবিস্মরণীয় অর্জন। বিচার ব্যবস্থা দ্রুত এবং কঠিন হলে অপরাধের ওপর তার ইতিবাচক প্রভাব পড়তে সময় লাগবে না। ফলে দুর্বৃত্তদের পাশবিক দাপট অনেকাংশে কমে আসবে। সবার উপরে মানুষের মধ্যে মানবিক বোধ, পরমত সহিষ্ণুতা, নারীর প্রতি যথার্থ দৃষ্টিভঙ্গি সর্বোপরি মনুষ্যত্বের নিয়ত পরিচর্চা আমাদের সুন্দর ও আধুনিক সমাজ গঠনে উৎসাহিত করবে। লেখক : সাংবাদিক
×