ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ফনিন্দ্র সরকার

মুজিববর্ষের প্রেরণায় বিকশিত হোক মানবিক মূল্যবোধ

প্রকাশিত: ০৯:০৯, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯

মুজিববর্ষের প্রেরণায় বিকশিত হোক মানবিক মূল্যবোধ

ইতিহাসের মহানায়ক বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকী পালিত হবে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ। এ উপলক্ষে ২০২০ সালকে মুজিববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। এমন ঘোষণা যথেষ্ট তাৎপর্য বহন করে। কেননা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্ম না হলে বাংলাদেশ নামক একটি দেশের জন্ম হতো না এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়। বিশে^ রাজনৈতিক সভ্যতার ইতিহাস নানা বাঁকে প্রবাহিত হয়ে একটা সময় উচ্চতর স্তরে উপনীত হয়ে মানব হৃদয়ে স্থায়ী আসন লাভ করতে সক্ষম হয়। বঙ্গবন্ধুর ঘটনাবহুল রাজনৈতিক জীবনের ইতিহাসও বাঙালীর হৃদয়ে স্থায়ী আসন লাভ করেছে। সেইসঙ্গে গোটা মানবজাতির হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। এমন একজন মহান ব্যক্তির জন্মতিথিকে কেন্দ্র করে বর্ষ গণনা সভ্যতার মানদ-েই যৌক্তিক বলে মনে করি। ২০২০ সালকে মুজিববর্ষ হিসেবে কায়মনোবাক্যে পালন করা সকলের নৈতিক দায়িত্ব। এ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারলে আমাদের সংস্কৃতি হয়ে উঠবে অধিক সমৃদ্ধিশালী। মানবিক চেতনার ঘটবে পুনর্জাগরণ। বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শে যে মানবিক মূল্যবোধ ছিল তা বিকশিত হবে বর্ষপালনের আনুষ্ঠানিকতায়। মানবসভ্যতা ও সম্মিলিত মানবীয় প্রচেষ্টা সমন্ধে মূল সত্যটি কী তা জানা যাবে মুজিব আদর্শের চর্চা থেকে। বাঙালীর সংস্কৃতির গতিটা ঢেউয়ের মতোÑ একবার পড়ে আবার ওঠে। ঐতিহাসিকভাবেই এ দৃশ্যটি লক্ষ্য করে আসছি। তবে উঠে আসার সূত্রপাত সর্বদা ঘটিয়েছেন কোন না কোন মহান ব্যক্তি। যেমনÑ ক্ষুদিরাম, নেতাজী সুভাষ বসু, শেখ মুজিবুর রহমান। এ উপমহাদেশ ২০০ বছরেরও বেশি সময় ব্রিটিশ রাজের অধীনে ছিল। ব্রিটিশ শাসন-শোষণের যাঁতাকলে বাঙালী নিষ্পেশিত হলেও তাদের সংস্পর্শে কুসংস্কারে একটা ধাক্কা লেগেছিল। সঙ্কীর্ণ ও গোষ্ঠীবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গির একটা পরিবর্তন ঘটেছিল। এই পরিবর্তনগুলো দৃষ্টিভঙ্গিকে সৃজনমুখী আন্দোলনে পরিণত করতে প্রয়োজন দূরদর্শী নেতৃত্বের। অসাধারণ চিন্তা পদ্ধতির প্রভাব পড়েছিল আমাদের ওপর। বিভিন্ন পর্বের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন সংঘটিত হলে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের পতন ঘটে। সে পতন পর্বটি ছিল প্রায় শান্তিপূর্ণ। ভারতবর্ষ বিভক্ত হলো দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে। হিন্দু-মুসলিম বিভাজন দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের মননে যে চাপ তৈরি হয়েছিল তাতে একটা সংস্কার ভর করেছিল গোটা সমাজ ব্যবস্থার ওপর। তা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যেই বঙ্গবন্ধুর মতো মহাপুরুষের জন্ম হয়েছিল। শৈশব থেকেই তিনি নির্ভীক চেতনা ধারণ করেছিলেন। সেটি ছিল অন্যায় অপরাধ তথা অপকর্মের বিরুদ্ধে। ভারতবর্ষ ভেঙ্গে যখন পাকিস্তানী অবাঙালী ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা চলছিল সে ব্যবস্থায় তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালী জাতির কোন অধিকার প্রায় ছিল না। যে আশায় ব্রিটিশমুক্ত হয় সে আশার আলো মুহূর্তেই নিভে যায়। আবার নেমে আসে গাঢ় অন্ধকার। এ জাতিকে কে করবে উদ্ধার? পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে অবাঞ্ছিত সংঘাতের সূত্রপাত হলে তরুণ মুজিব জেগে ওঠেন। তিনি বাঙালী জাতির আত্মসম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু করেন। তাঁর আন্দোলন ছিল নিয়মানুবর্তী ও সৃজনশীল শক্তি তথা মানবোচিত শক্তির এক অসামান্য পর্যায়ের। কী বিস্ময়কর প্রেরণার সৃষ্টি হয়েছিল বাঙালীর হৃদয়ে! বঙ্গবন্ধুর উদার দৃষ্টিভঙ্গি সঞ্চারিত হতে থাকে গোটা বাঙালী জাতির মধ্যে। মানবতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা সম্বন্ধে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দিলেন তিনি। যে পাকিস্তান সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় বিভাজন নীতিতে পরিচালিত হতো সেই পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক উদার মনোভাবকে জনগণ গ্রহণ করল। তাঁর ডাকে ঐক্যবদ্ধ হলো গোটা বাঙালী জাতি। পরম সৃষ্টিকর্তার সরাসরি আশীর্বাদ ছাড়া তা কি সম্ভব? বঙ্গবন্ধু সেরকম আশীর্বাদপ্রাপ্ত হয়েছিলেন বলেই তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে একত্রিত করা। মানবিক মূল্যবোধ, শান্তি ও সমন্বয়ের মাহাত্ম্য প্রচারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হয়ে উঠলেন অদ্বিতীয়। আমাদের একটি কথা মনে রাখা দরকার যে, কোন একটি বিশেষ ঘটনাকে দর্শন বলা যায় না। তবে সেই একটি বিশেষ ঘটনা থেকে বিশ^জনীন ধারণার উদ্ভব ঘটানো যায় তাকে জীবনদর্শন বলা চলে। বিশেষ ঘটনাকে বিশ^জনীন বা সর্বজনীন রূপ দিতে সক্ষম যে নেতা সেটি তাঁর জীবনদর্শন। ওই জীবনদর্শনের নির্যাস থেকে তৈরি হয় মানবিক মূল্যবোধ। সে ব্যক্তি একজন অসাধারণ পুরুষ, যিনি কোন ঐশ^র্য, কোন ক্ষমতা বা কোন সম্পদের অধিকারী না হয়েও আনন্দময়, উৎসাহপূর্ণ মানুষের জন্য, কোন সহায়ক না থেকেও যিনি অসাধারণ শক্তির অধিকারী, কোন ইন্দ্রিয় ভোগে লিপ্ত না হয়েও যিনি তৃপ্ত, নিজে অতুলনীয় হয়েও যিনি অন্য সকলকে নিজের সঙ্গে সমান জ্ঞান করেন। আমাদের জীবনে রাজনীতির ক্ষেত্রে এমন আদর্শের কাছাকাছি পৌঁছেছিলেন মহাত্মা গান্ধী, পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জনগণকে অবশ্যই আরও বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে চিন্তা করতে এবং অনুভব করতে হবে মুজিববর্ষের সূচনালগ্ন থেকেই। আজ প্রশ্ন জাগে মনে, মুজিব আদর্শ ধারণ করছে ক’জনে? কেবল কালো কোটের ছড়াছড়ি। আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু যে ধরনের কোট ব্যবহার করতেন, আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতা থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ের সকল স্তরের নেতাই মুজিব কোট ব্যবহার করে মুজিবভক্ত হিসেবে নিজেকে জাহির করে। কিন্তু মুজিবের চিন্তা-চেতনার সঙ্গে তাদের চিন্তা-চেতনার প্রায় কোন মিল নেই। বর্তমানে আমরা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার দ্বারা পরিচালিত। গণতন্ত্রের সাফল্য নির্ভর করে অধিক লোকের চিন্তাশক্তির জাগরণ এবং লোকপ্রীতি ও জনসেবামূলক কার্যক্রমে শামিল হওয়ার সামর্থ্যরে ওপর। যাদের জীবন অসংযত আবেগ ও কাজের মাতামাতিতে ভরা, এখনকার অধিকাংশ রাজনীতিকের ক্ষেত্রে যেমন হয়ে থাকে, তারা আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে নস্যাত করে দিতে পারে। কিন্তু দৃঢ় প্রতিষ্ঠ গণতন্ত্রে আমাদের প্রয়োজন আরও বেশিসংখ্যক মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষের। সমাজের সবরকম উন্নতির মূলে হলো চিন্তা-সামর্থ্য। চিন্তা-সামর্থ্য ছাড়া লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। যে শিক্ষা বঙ্গবন্ধু রেখে গেছেন সে শিক্ষা কি আমরা ধরে রাখতে পেরেছি? সে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সবার মনে। মুজিববর্ষে সে শিক্ষা পুনরায় গ্রহণ করে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্কল্প করতে হবে। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় লাভের পর বাংলাদেশ প্রায় একটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় কাঠামো পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুর নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি কর্মপ্রেরণা জুগিয়েছিল নতুন প্রশাসনের সর্বস্তরের কর্মকর্তাদের মাঝে। তাঁর একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। এ প্রসঙ্গে একটি কথা উল্লেখ করতে হচ্ছে যে, প্রায় ৮০ বছর পূর্বে প্রসিদ্ধ ইংরেজ লেখক এলপি জ্যাকসিই তাঁর ‘স্পিরিট অব ওয়ার্ক’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছিলেন ‘তুমি যদি কর্মের গতি লক্ষ্য করে চলো তবে শেষে দেখবে তা নৈষ্কর্ম্যে পরিণত হয়েছে। আর যদি নৈষ্কর্ম্যরে গতি লক্ষ্য করে চল শেষে দেখবে কর্মই রয়েছে।’ সকল সমাজেই এরকম দেখা যায়। কর্ম আমাদের কাছে দুর্জ্ঞেয় তত্ত্ব। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু দেশবাসী ও সরকারী কর্মকর্তাদের উদ্দেশে যে সকল বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন তাতে উপরোক্ত সত্যই প্রতিভাত হয়েছে। এই সত্যের ওপর ভর করে কী দেশ এগিয়ে যাচ্ছে? এ প্রশ্নের মীমাংসা করতে হলে অনাসক্তির দৃষ্টিভঙ্গিতে কাজের ওপর জোর দিতে হবে। অনাসক্তি মানে ফলাকাক্সক্ষা ত্যাগ করা। প্রথম প্রথম আকাক্সক্ষাহীন কর্ম করতে কঠিন লাগবে। তাতে ক্ষতি নেই। কিন্তু লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে আসক্তি ত্যাগ করতে হবে। আসক্তিতে লোভ-লালসার জন্ম দেয়। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, যারা রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়েছেন তাদের অধিকাংশই ব্যবসাদার। মুনাফার দৃষ্টিভঙ্গিতে রাজনীতি করা হচ্ছে বলে গোটা রাজনীতিটাই যেন ব্যবসা ও শিল্পের মূলধন বলে বিবেচিত হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী উদার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু কাজ কতটা হচ্ছে? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেবা ও ত্যাগের মানসিকতাকে রাজনীতির আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করলেও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা কি সেটা গ্রহণ করেছে? উত্তর হবে, না। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জনকল্যাণের ঐতিহ্য ধারণকারী একটি রাজনৈতিক দল। জনগণের প্রত্যাশাটা আওয়ামী লীগের কাছে একটু বেশিই থাকে। অন্য যে সকল রাজনতৈকি দল আছে সেগুলো হিসেবের মধ্যেই পড়ে না। বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি এগুলো কার্যত কোন আদর্শিক দল নয়। এগুলো নিয়ে আলোচনা না করাই ভাল। তবে বঙ্গবন্ধুর বহুত্ববাদী দর্শনের ভিত্তিতে অনেক রাজনৈতিক দল হতে পারে। সেগুলো প্রত্যেকটির রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে থাকবে নিরাসক্তির কর্মপ্রক্রিয়া। অনাসক্তির মধ্যে প্রচুর আনন্দ লুকিয়ে আছে। আমরা রাজনীতিকগণ যে কাজ করছি তাতে কাজ থেকে আনন্দকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়েছি। কাজে আনন্দ আছে এটি উপলব্ধি করতে হবে। নিরস খাটুনি থেকে আনন্দে উত্তরণ কখনও হতে পারে না। কাজই আনন্দে পূর্ণ হতে পারে, যদি হৃদয়ে ভালবাসা থাকে। তখন সবই বেশ সুন্দর হয়। এ শিক্ষাটি বঙ্গবন্ধুর। দেশ গড়ার জন্য যারা নিয়োজিত যদি তাদের জাতির প্রতি ভালবাসা থাকে তবে তারা আনন্দের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবে। দূরবর্তী কোন জেলায় সরকারী পদস্থ কর্তাব্যক্তিকে দায়িত্ব দেয়া হলে তিনি জনগণের প্রতি আন্তরিক ভালবাসা নিয়ে দায়িত্ব পালন করবেন। যদি হৃদয়ে জনগণের প্রতি ভালবাসা না থাকে তাহলে স্বার্থবুদ্ধি নিয়ে কাজ করবেন। এতে মহৎ অর্জন সম্ভব নয়। আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু মহৎ অর্জনের লক্ষ্য সামনে রেখেই কাজ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। মুজিববর্ষে সে আহ্বানের প্রতি শ্রদ্ধা রাখতে পারলেই মুজিববর্ষ পালন সার্থক ও সফল হবে। লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক [email protected]
×