ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মাদকের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান আরও জোরদার

ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীকেও ছাড় নয়

প্রকাশিত: ১০:২০, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৯

ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীকেও ছাড় নয়

গাফফার খান চৌধুরী ॥ দেশের সার্বিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে মাদক নিমর্ূূলে সম্মিলিত অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়েছে সরকার। থার্টিফার্স্ট নাইট সামনে রেখে সারাদেশে মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান আরও জোরদার করা হয়েছে। জঙ্গী নির্মূলের মতো মাদক নির্মূল করার নির্দেশনা দিয়েছে সরকারের হাইকমান্ড। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী মাদক সেবন বা ব্যবসা বা মাদক ব্যবসার নেপথ্যে থাকলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাদের দল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করার নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। মাদক মামলার তদন্তের ক্ষেত্রে কোন ছাড় না দেয়ার কড়া নির্দেশনা জারি হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে কোন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হলে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে সরাসরি যোগাযোগ করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যেই মাদকের বিষয়ে সুস্পষ্ট কড়া নির্দেশনা এসেছে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। সেই নির্দেশনার সঙ্গে পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশনা যোগ করে পুলিশের প্রতিটি ইউনিটকে জানানো হয়েছে। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, দেশের সার্বিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ছাড়া অন্য আর কোন উপায় নেই। মাদক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলে দেশ মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়বে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হবে। মিয়ানমারের নেত্রী আউং সান সুচি ইয়াবার বিষয়ে তার অপারগতার কথা বিভিন্ন সময় সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছে স্বীকার করেছেন। তাই বাংলাদেশকেই নানাভাবে মাদক নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এছাড়া আর কোন উপায় নেই। এমনটাই বলা হয়েছে নির্দেশনায়। নাফ নদীসহ সীমান্তের যেসব পয়েন্ট দিয়ে মাদক আসে, সেসব পয়েন্ট প্রয়োজনে সিল করে দেয়া হবে। এক কথায় মাদক বিরোধী সারাদেশে অলআউট অপারেশন চালাতে হবে। যেখানে মাদক সেখানেই কাঁচা টাকা, আর সেখানেই অস্ত্রগোলাবারুদ। আর সেখানেই জঙ্গী আস্তানার মতো অভিযান চালাতে হবে। সেখানে অভিযান চালাতে গেলে বন্দুকযুদ্ধ হবে। এটিই স্বাভাবিক। শুধুই আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে কাউকে হত্যা করা যাবে না। নির্দেশনায় জানানো হয়েছে, সারাদেশের ৬৮টি কারাগারের মধ্যে ৩টি জেলে মাদক নিরাময় কেন্দ্র স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে। পর্যায়ক্রমে আরও স্থাপন করা হবে। এসব জেলে ধারণ ক্ষমতা ৩৫ হাজার। অথচ ৮৬ হাজারের বেশি বন্দী রয়েছে। বন্দীদের মধ্যে শতকরা ৪৪ ভাগের বেশি বন্দী মাদক মামলায় গ্রেফতার হয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক জামাল উদ্দীন আহমেদের বরাত দিয়ে নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে ৪ কোটি ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে। চলতি বছরেও ইয়াবা সংক্রান্ত মামলা প্রায় কাছাকাছি। তবে গত বছরের তুলনায় কিছুটা কম। এ সংক্রান্ত মামলায় এক লাখ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশীট দেয়া হয়েছে। পলাতক আসামিদের দ্রুত গ্রেফতার করতে বলা হয়েছে। ইনজেকশনের মাধ্যমে নেয়া মাদকের কারণে দেশে এইডস রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তাই নেশাজাতীয় ইনজেকশন বিক্রির ক্ষেত্রে আরও নজরদারি বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। মাদক নিয়ন্ত্রণে দেশের ৮৭ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাদকবিরোধী কমিটি আছে। পর্যায়ক্রমে সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কমিটি গঠন করতে হবে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ৫০ শয্যার মাদক নিরাময় কেন্দ্রটিকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করতে হচ্ছে। সারাদেশে বেসরকারীভাবে ২৯৯টি মাদক নিরাময় কেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দেয়া হয়েছে। তা সঠিকভাবে হচ্ছে কিনা তার ওপর গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে হবে। মাদকের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ৭০ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। একইভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ মাদকের সঙ্গে জড়িত থাকলে অতীতের মতো তাদেরও চাকরিচ্যুত করা হবে। পুলিশের কোন সদস্য মাদকসেবী হলে তাকে নির্দিষ্ট সময়ের পর চাকরিচ্যুত করার কথা বলা হয়েছে। মাদক মামলা পরিচালনার জন্য পৃথক আদালতের প্রয়োজনীয়তার প্রসঙ্গ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। পাশাপাশি মাদক মামলা বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে তদন্তের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। গ্রীন টির আড়ালে আসা নতুন মাদক এনপিএসের বিষয়ে পুলিশের প্রতিটি ইউনিটকে বিশেষ নজর রাখতে বলা হয়েছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির সিরিয়াস ক্রাইম স্কোয়াডকে এনপিএস সম্পর্কে শতভাগ সতর্ক ও অভিযান চালানোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার জানান, অনেক চাঞ্চল্যকর মামলার তদন্ত করতে গিয়ে মাদকের প্রভাব থাকার তথ্য বেরিয়ে আসে। বিশেষ করে হত্যাকা- ও ধর্ষণ সংক্রান্ত মামলায় মাদকের উপস্থিতি বা প্রভাব তুলনামূলক বেশি। পুলিশের এক উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, মাদক পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হওয়ায়, সরকারের উচ্চ পর্যায় খুবই ক্ষিপ্ত। সরকারের তরফ থেকে মাদকের সঙ্গে জড়িতদের পৃথক পৃথক তালিকা করতে বলা হয়েছে। রাজনৈতিক দলের যারা মাদকের সঙ্গে জড়িত তাদের আলাদা তালিকা হবে। এদের দল থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করার কথা বলা হয়েছে। আর যারা পুলিশ বা অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য হয়েও মাদকের সঙ্গে জড়িত তাদের তালিকা হবে পৃথক। এভাবে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই মাদকের সঙ্গে জড়িতদের তালিকা করার কথা বলা হয়েছে। মাদক ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণ কতটা সুফল বয়ে আনবে, তা নিয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। যেসব মাদক ব্যবসায়ী কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার মালিক হয়েছে, তাদের টাকার বিষয়ে কি সিদ্ধান্ত হবে, তা নিয়েও আলোচনা চলছে। আত্মসমর্পণকারীদের বিরুদ্ধে থাকা মামলার কি হবে তা নিয়ে আইনজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম জনকণ্ঠকে জানান, সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক থার্টিফার্স্ট নাইট নির্বিঘœ ও মাদকমুক্ত করতে সারাদেশে অভিযান অব্যাহত আছে। অভিযানের ধারাবাহিকতায় গত ২৬ ডিসেম্বর ঢাকার কুর্মিটোলা থেকে জীপে করে আনা সোয়া চার শ’ বোতল ফেনসিডিল ও চার হাজারের বেশি বিয়ার জব্দ করা হয়েছে। জব্দ করা হয়েছে দুটি জীপ গাড়ি। গ্রেফতার করা হয়েছে আব্দুল্লাহ আল মামুন (৩৯) ও রাসেল হোসেন (২৮) নামের দুই মাদক ব্যবসায়ীকে। এক সপ্তাহে মাদকসংক্রান্ত ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছে শতাধিক। পুলিশ সদর দফতরের মিডিয়া বিভাগের সহকারী পুলিশ মহাপরিদর্শক সোহেল রানা জনকণ্ঠকে জানান, সারাদেশে মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত রাখা হবে। মাদক নির্মূলে পুলিশের তরফ থেকে সমাজের সকল স্তরের মানুষকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা চলছে। এক সপ্তাহে হাজারের অধিক ব্যক্তি মাদক সংক্রান্ত ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছে। ডিএমপির মিডিয়া বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, আসন্ন থার্টিফার্স্ট নাইট উপলক্ষে রাজধানীতে মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান চলছে। গত এক সপ্তাহে তিন শতাধিক ব্যক্তিকে মাদক সংক্রান্ত ঘটনায় গ্রেফতার করা হয়েছে।
×