ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রধানমন্ত্রী কাল আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন ;###;বছরের প্রথম দিনেই চার কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থীর হাতে তুলে দেয়া হবে ৩৫ কোটি ৩১ লাখ বই

শতভাগ নতুন বই শিক্ষার্থীদের দোরগোড়ায় ॥ উৎসবের বাকি আর মাত্র একদিন

প্রকাশিত: ১০:০২, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৯

 শতভাগ নতুন বই শিক্ষার্থীদের দোরগোড়ায় ॥ উৎসবের বাকি আর মাত্র একদিন

বিভাষ বাড়ৈ ॥ আর মাত্র একদিন। দেশব্যাপী পাঠ্যপুস্তক উৎসব পালনের প্রস্তুতি প্রায় শেষ। আগামী শিক্ষাবর্ষে প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের চার কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য ৩৫ কোটি ৩১ লাখ কপি বিনামূল্যের পাঠ্যবইও প্রস্তুত। প্রতিটি শিক্ষার্থীর দোরগড়ায় পৌঁছে গেছে শতভাগ পাঠ্যবই। নতুন বছরের প্রথমদিন বুধবারই দেশজুড়ে পাঠ্যপুস্তক উৎসবে শামিল হয়ে ঝকঝকে নতুন পাঠ্যবই হাতে পাবে প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের প্রতিটি শিক্ষার্থী। গত ১০ বছরের মতো আবারও নতুন বছরের প্রথম দিনই ঝকঝকে বই নিয়ে উৎসবে শামিল হবে শিশুরা। জানা গেল, এ নিয়ে টানা ১১ বারের মতো শতভাগ বিনামূল্যের বই বিতরণ করতে যাচ্ছে সরকার। যেখানে বইয়ের পরিমাণ হবে ৩৩১ কোটি ৫২ লাখ কপি। সরকারের ব্যয় হচ্ছে নয় হাজার কোটি টাকারও বেশি। শতভাগ বই এখন উপজেলা শিক্ষা অফিস নয়তো স্কুলে স্কুলে। বই শিক্ষার্থীর দোরগোড়ায়-এমন মন্তব্য করে শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ সবাইকে আশ্বস্ত করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেছেন, আসলে নতুন পাঠ্যবই দেরিতে পাওয়ার দিন শেষ। ১০ বছর আগে বই শিক্ষার্থীরা পেতে মার্চ এপ্রিলে গিয়ে। আর এখন বছর শেষ হওয়ার আগেই উপজেলার গোডাউন ও স্কুলগুলোতে চলে গেছে শতভাগ বই। এবার ৩৫ কোটিও বেশি বই ছাপা হলেও গতবারের চেয়ে অন্তত ১০০ কোটি টাকা কম খরচ হয়েছে। জানা গেছে, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকার ১৯৮৩ সাল থেকে ছাত্রছাত্রীদের মাঝে কিছু বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ শুরু করে। ২০০৯ সাল পর্যন্ত নির্ধারিত কয়েকটি ক্যাটাগরির কেবল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের অর্ধেক নতুন ও অর্ধেক পুরনো পাঠ্যবই বিনামূল্যে দেয়া হতো। এসব বইও সময়মতো শিক্ষার্থীরা পেত না। বই পেতে পেতে মার্চ/এপ্রিল পার হয়ে যেত। এর ফলে ক্লাস শুরু হতেও অনেক দেরি হতো। প্রতিবারই অসাধু প্রেস মালিকদের সিন্ডিকেটের কবলে পড়ত পাঠ্যবই ছাপার কাজ। সময়মতো বই না পাওয়ায় এবং উচ্চ দরে বাজার থেকে বই কিনতে না পেরে প্রতিবছর ব্যাপক সংখ্যক ছাত্রছাত্রী প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর থেকে ঝরে পড়ত। হাতে গোনা কয়েকটি দেশ বাদ দিলে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই মোট জনসংখ্যাও নেই চার কোটি। সেখানে বছরের প্রথম দিনই দেশের প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের চার কোটিও বেশি শিক্ষার্থীর হাতে ৩০ থেকে ৩৫ কোটি বই তুলে দিচ্ছে সরকার। এনসিটিবির সদস্য (টেক্স্ট) অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, ভাল মানের বই দেয়ার ক্ষেত্রে তাদের চেষ্টার কথা তুলে ধরেন। এবার নির্ধারিত সময়ে যারা বই দিতে পারেনি তাদের ওই লটের বইয়ের মোট টাকার (মূল্য) ওপর ১০ শতাংশ পর্যন্ত জরিমানা দিতে হবে। কেউ মাফ পাবে না। আর নিম্নমানের একটি বইও এনসিটিবি গ্রহণ করেনি। বইয়ের মানের ক্ষেত্রে কারও সঙ্গে আপোসও করা হচ্ছে না। আমরা কাজের প্রতিটি পর্যায়ে মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা পেয়েছি। শতভাগ বই চলে গেছে শিক্ষার্থীর দোরগোড়ায়। বছরের প্রথম দিন বিতরণ করা হবে বই। কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার বই ছাপা ও বিতরণের শেষ পর্যায়ে এসে নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছিল এনসিটিবিকে। বই বিতরণ কাজের মধ্যেই অসাধু ব্যবসায়ীদের তৎপরতা সামাল দিতেই ব্যস্ত থাকতে হয়েছে এনসিটিবিকে। মান মূল্যায়ণের কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠান ব্যুরো ভেরিটাস বাংলাদেশ (প্রাইভেট) লিমিটেড এবং কন্টিনেন্টাল ইনস্পেকশন বিডি লিমিটেডকে সামাল দিতে হয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীদের মূল কর্মকান্ড। অভিযোগ পাওয়া গেছে, আন্তর্জাতিক দরপত্রে বিদেশী প্রতিষ্ঠান ঠেকাতে এবার প্রাক্কলিত দরের চেয়ে কমমূল্যে প্রাথমিক স্তরের সব বই ছাপার কাজ নিয়েছিল দেশীয় কিছু মুদ্রাকর (প্রিন্টার্স)। অনেক প্রতিষ্ঠানই কম দামে কেনা নিম্নমানের কাগজে বই ছেপে লাভ পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টায় লিপ্ত ছিল। তবে সফল হতে পারেনি। যারা চেষ্টা করেছে তারাই ধরা পড়েছে। নিম্নমানের কাগজে বই ছাপাসহ নানা অনিয়মের কারণে সাতটি ছাপাখানার প্রায় এক লাখ কপি বই ধ্বংস করে দিয়েছে এনসিটিবির পরিদর্শকরা। মাধ্যমিক স্তরের বই ছাপতে নিম্নমানের কাগজ কেনায় ১৮ প্রতিষ্ঠানের কাগজ ছাপার অযোগ্য ঘোষণা ও বাতিল করেছে এনসিটিবি। ওইসব প্রতিষ্ঠানকে শর্ত অনুযায়ী কাগজ কিনে বই ছাপতে বাধ্য করেছে সংস্থাটি। আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য ৩৫ কোটি ৩১ লাখ ৪৪ হাজার ৫৫৪ বই ছাপানো হয়েছে। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য ১০ কোটি ৫৪ লাখ ২ হাজার ৩৭৫ বই এবং মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য ২৪ কোটি ৭৭ লাখ ৪২ হাজার ১৭৯ বই বিনামূল্যে বিতরণ করা হবে। এদিকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পাঁচটি ভাষার ৯৭ হাজার ৫৭২ শিশুর জন্য প্রাক-প্রাথমিক, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর দুই লাখ ৩০ হাজার ১৩০ বই ছাপানো হয়েছে। দেশের ৭৫০ জন্য দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর জন্য ছাপা হয়েছে নয় হাজার ৫০৪ বই। এবতেদায়ী মাদ্রাসা স্তরের জন্য ছাপানো হয়েছে দুই কোটি ৩২ লাখ ৪৩ হাজার ৩৫ বই। এসএসসি ভোকেশনালের জন্য ১৬ লাখ ৩ হাজার ৪১১ বই, এইচএসসি বিএম ভোকেশনালের জন্য ২৭ লাখ ৬ হাজার ২৮ বই এবং দাখিল ভোকেশনালের জন্য ছাপানো হয়েছে এক লাখ ৬৭ হাজার ৯৬৫ বই। বিনামূল্যের বই ছাপাতে সরকারের ব্যয় হয়েছে এক হাজার ১০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রাথমিকের জন্য ৩৫০ কোটি এবং মাধ্যমিকের জন্য ব্যয় হয়েছে ৭৫০ কোটি টাকা। এদিকে কোটি কোটি শিক্ষার্থীর জন্য বই বিতরণের যে কর্মযজ্ঞ নিয়ে বছরের পর বছর ধরে আলোচনা চলছে তার পরিসংখ্যান বলছে, গত ১০ বছরে শিক্ষার্থীদের মাঝে ২৯৬ কোটি আট লাখ বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিতরণ করেছে সরকার। আগামী বছরের জন্য প্রস্তুত করা বইয়ের সংখ্যা যোগ করলে যোগফল দাঁড়ায় ১১ বছরে ৩৩১ কোটি ৫২ লাখ কপি। যে কাজে সরকারের ব্যয় হয়েছে নয় হাজার কোটি টাকারও বেশি। এর মধ্যে আগামী বছরের জন্য প্রস্তুত করা বইয়ে সরকারের ব্যয় হচ্ছে এক হাজার ১১ কোটি টাকারও বেশি। সরকারের এ বিশাল কর্মযজ্ঞের তথ্য দেখলেই স্পষ্ট হয় প্রায় প্রতিবছরই বেড়েছে বিনামূল্যের বইয়ের সংখ্যা। বেড়েছে শিক্ষার্থী বিশেষ করে বিদ্যালয়ে আসা শিক্ষার্থীর সংখ্যা। শিক্ষাবিদসহ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে এনেছে। যা দেশের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রভাব ফেলেছে। তথ্য বলছে, গত ১১ বছর আগে দেশে বিদ্যালয়ে আসা শিশুদের হার ছিল ৮০ শতাংশের একটু বেশি। কিন্তু ১০ বছরের মাথায় আজ প্রায় শতভাগ শিশু আসছে বিদ্যালয়ে। বিষয়টি ইতোমধ্যেই নজর কেড়েছে আন্তর্জাতিক মহলের। বিদ্যালয়ে শতভাগ শিশুর উপস্থিতিকে বাংলাদেশের একটি বড় অর্জন বলেও উল্লেখ করা হচ্ছে। শতভাগ বিনামূল্যের পাঠ্যবইয়ের প্রথম বছর বইয়ের সংখ্যা ছিল ২০১০ সালে ১৯ কোটি ৯০ লাখ ৯৬ হাজার ৫৬১ কপি, ২০১১ সালে ২৩ কোটি ২২ লাখ ২১ হাজার ২৩৪ কপি, ২০১২ সালে ২২ কোটি ১৩ লাখ ৬৬ হাজার ৩৮৩ কপি, ২০১৩ সালে ২৬ কোটি ১৮ লাখ ৯ হাজার ১০৬ কপি, ২০১৪ সালে ৩১ কোটি ৭৭ লাখ ২৫ হাজার ৫২৬ কপি, ২০১৫ সালে ৩২ কোটি ৬৩ লাখ ৪৭ হাজার ৯২৩ কপি, ২০১৬ সালে ৩৩ কোটি ৩৭ লাখ ৬২ হাজার ৭৭২ কপি, ২০১৭ সালে বই ছিল ৩৬ কোটি ২১, লাখ ৮২ হাজার ২৪৫ কপি। ২০১৮ বছর বইয়ের সংখ্যা ছিল ৩৫ কোটি ৪২ লাখ ৯০ হাজার ১৬২ কপি। চলতি বছর ৩৫ কোটি ২১ লাখ ৯৭ হাজার ৮৮২ কপি। আর আগামী বছরের জন্য বই হচ্ছে ৩৫ কোটি ৩১ লাখ ৪৪ হাজার কপি। এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা জানিয়েছেন, আগামীকাল ৩১ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে উৎসবের উদ্বোধন করবেন। এক জানুয়ারি দেশজুড়ে উৎসবের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেয়া হবে। বইয়ের পরিবর্তন ২০২১ সালে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচীতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হচ্ছে। কমিয়ে দেয়া হচ্ছে বিষয়বস্তু (কনটেন্ট)। প্রাথমিকের শিশুদের বোঝা কমাতে বই কমিয়ে দেয়ারও চিন্তাভাবনা হচ্ছে। তবে সব কিছুই ২০২১ সালের বই থেকে শুরু হবে। এনসিটিবি বলছে, ২০২১ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত পর্যাক্রমে শিক্ষার্থীদের নতুন পাঠ্যক্রমের বই হাতে তুলে দেয়া হবে। এতে করে পাঠ্য বিষয়ও কমে যাবে। ধারাবাহিক মূল্যায়নকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে পরীক্ষার নম্বর কমিয়ে দেয়া হবে। ফলে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার বোঝাও কমবে। এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা জানিয়েছেন, শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচী পরিবর্তন করার কাজ চলছে। পাঠ্যসূচীর যেসব বিষয় নিয়ে বিতর্ক ছিল, সেসব বিষয় খতিয়ে দেখছে কমিটি। তবে ২০২১ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে পরিবর্তিত পাঠ্যবই আসবে। প্রাথমিকের শিশুদের বইয়ের সংখ্যাও কমিয়ে দেয়া হবে। জানা গেছে, ২০২১ সালে প্রথম, দ্বিতীয় ও ষষ্ঠ শ্রেণী, ২০২২ সালে তৃতীয়, চতুর্থ, সপ্তম ও নবম, ২০২৩ সালে পঞ্চম ও অষ্টম, ২০২৪ সালে একাদশ এবং ২০২৫ সালে দ্বাদশ শ্রেণীর পরিবর্তিত পাঠ্যক্রমের বই পেতে পারে শিক্ষার্থীরা।
×