ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. শাহ্জাহান মন্ডল

এসডিজি অর্জনে জেলা জজের রিট এখতিয়ার

প্রকাশিত: ০৮:৩১, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৯

এসডিজি অর্জনে জেলা জজের  রিট এখতিয়ার

বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ, শেখ হাসিনার কাজের রেশ-এ দুইয়ের সমন্বয় হলে বাঙালীর আর চিন্তা থাকার কথা নয়। মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলের পর এবার সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল। এমডিজির পর এসডিজি। আপাতত লক্ষ্য ২০৩০। এর এগারো বছর পর উন্নত রাষ্ট্র হওয়ার বর্ণিল হাতছানি, ভিশন-২০৪১। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরেই বাংলাদেশ আজ হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়েছে। নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হয়েছে। আর ২০২১-এ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে। আজীবন সৎ থাকা বঙ্গবন্ধুর রক্তের উপযুক্ত উত্তরসূরি জননেত্রী শেখ হাসিনার সৎ কর্ম ও নেতৃত্বগুণেই আজ বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার ৮.১৫। আজকের ভাগ্যবান প্রজন্ম সত্যিই ধন্য। তারা আজ বিদ্যালয়ে সঠিক শিক্ষা পাচ্ছে। জানতে পারছে বাঙালী জাতির সঠিক ইতিহাস। তারা আজ পথভ্রষ্ট নয়। তারা ঠিকই জানতে পারছে আমার জাতীয়তা বাঙালী, আমার দেশ বাংলাদেশ, আমার স্বাধীনতার ঘোষক বঙ্গবন্ধু, আমার স্বাধীনতার মহান স্থপতি ও আমার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং সর্বোপরি আমার অন্ধকার গুহা থেকে আলো হাতে সঠিক পথের দিশারী দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব জননেত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতিসংঘের এসডিজি অর্জনের পথে আমরা আগুয়ান। নবমবারের মতো তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি। তাঁর ওপরেই আমাদের ভরসা। ২০৩০-এর মধ্যে রাষ্ট্রসংঘের যে এসডিজি ঘোষিত হয়েছে সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ১৭টি শর্ত রয়েছে। তার ১৬ নম্বর হলো ‘পিস, জাস্টিস এ্যান্ড স্ট্রং ইনস্টিটিউশন্স’ (শান্তি, ন্যায়বিচার ও শক্ত প্রতিষ্ঠান), যার একটি অন্যটির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য এবং একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। মাঝখানে ‘ন্যায়বিচার’। ২০৩০-এর মধ্যে ‘ন্যায়বিচার’ জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব আমাদের, অবশ্যই তা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। এই ন্যায়বিচারের এক বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে জনগণের মৌলিক মানবাধিকার সংক্রান্ত মামলা, যার নাম রিট মামলা। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের ২৭-৪৪ অনুচ্ছেদে রয়েছে এরকম মৌলিক ১৮টি অধিকার। যেমন- আইনের দৃষ্টিতে সমতা পাবার অধিকার, বৈষম্যের শিকার না হবার অধিকার, সরকারী চাকরির ক্ষেত্রে সমতা পাবার অধিকার, আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার, সংগঠন করা বা মত প্রকাশ ও আন্দোলনের অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগের অধিকার, সম্পত্তির অধিকার ইত্যাদি। এই মুহূর্তে হাজার হাজার গরিব বাঙালী রিটের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে ঢাকা হাইকোর্টের বারান্দায় ঘোরাঘুরি করছে। তাদের পেটে ভাত থাক বা না থাক ৫০০/৭০০ কিলোমিটার দূরের টেকনাফ বা তেঁতুলিয়া থেকে কোঁচায় চিড়া নিয়ে তারা এখন ঢাকার হাইকোর্টে। তাদের এই সঙ্গীন অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটানোর দায়িত্ব সরকারের। প্রায়ই আমরা সংবাদ মাধ্যমে জানতে পারছি যে, হাইকোর্ট বিভাগ রিট মামলায় জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষার পক্ষে রায় দিচ্ছে। ডাক্তার নূরুল ইসলাম বনাম বাংলাদেশ সরকার (৩৩ ডিএলআর) মামলায় দেখা যায়, শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (পূর্বের পি.জি. হাসপাতালের) অধ্যাপক ও পরিচালক ডাঃ নূরুল ইসলামকে চাকরিচ্যুত করার প্রক্রিয়া ছিল সংবিধানের ২৯ ও ১৩৫ (২) অনুচ্ছেদের (তথা সরকারী নিয়োগ লাভে বা পদে থাকার ক্ষেত্রে সুযোগের সমতা ও কারণ দর্শানোর সুযোগ পাবার অধিকারের) পরিপন্থী। তাঁর আনীত রিটের মাধ্যমে তিনি এসব মৌলিক মানবাধিকার কার্যকর করেন, চাকরি ফিরে পান। মেসার্স লতিফ বাওয়ানী জুট মিলস লিঃ চেয়ারম্যান, ২য় শ্রম আদালত ঢাকা ও অন্যান্য (রিট পিটিশন নং ১৪৪, ১৯৮৬) মামলায় আমির আলী নামক বাওয়ানী জুট মিলের হেড সর্দার তাঁর চাকরি ফেরত পান। সুতরাং এটা দেখে আমরা খুবই আনন্দিত এবং আশাবাদী যে, মৌলিক অধিকার বাস্তবায়ন ও সংরক্ষণের একটি ব্যবস্থা দেশে রয়েছে। এ কথাও আমরা সাংবিধানিক আইনের পুস্তকে পড়ে আনন্দ পাই যে, হাইকোর্ট বিভাগ হলো মৌলিক অধিকারের ‘guarantor and protector’। কিন্তু বাংলাদেশের মতো একটি দরিদ্র দেশের সকল মানুষের পক্ষে এই আইনী বিধানের সুফল যথাযথভাবে ভোগ করা সম্ভব হয় কি না তা আলোচনার দাবি রাখে। সমস্যা হলো, রিট মামলা দায়ের করার একমাত্র ফোরাম হলো রাজধানী ঢাকার হাইকোর্ট বিভাগ। কিন্ত দুঃখের বিষয় হলো, বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে প্রতিদিন জনগণের যে শত শত মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে তার কতটি যাচ্ছে হাইকোর্টে? একে তো মামলা-মোকদ্দমা হলো টাকা বা প্রভাবশালীদের কারবার, তার ওপর রিট কোন জমিজমার মামলা নয়, মারামারির মোকদ্দমাও নয়, এ হলো যেন এলিটদের মামলা! অধিকাংশ মানুষের অচেনা এ রিট মামলা। এগুলো যেন গরিব মানুষের নাগালের বাইরে। কিন্তু গরিব মানুষ কতজন এদেশে? ২০০৮ সালে বাংলাদেশের ৪৯.৮% মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত (দৈনিক ইত্তেফাক, ২৩ অক্টোবর ২০০৬)। জননেত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘ দশ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে আজ এটি নেমেছে হয়েছে ২০%। এদের পক্ষে কামলা ও কৃষকের কাজ করে দৈনিক ৪০০ টাকার বেশি আয় করা সম্ভব নয়। শ্রমিকের মাসিক বেতন হলো মাত্র ৮০০০ টাকা। তাও আবার কারখানার মালিকেরা ঠিকমতো পরিশোধ করে না বলে মাঝে-মধ্যেই দেখা যায় শ্রমিক আন্দোলন। ডিসেম্বরের ৩য় সপ্তাহেই দেখা গেল খুলনা, চট্টগ্রামসহ সারাদেশে শ্রমিকদের আমরণ অনশন। বাসায় বাসায় কাজ করা আয়া-বুয়া-খালাদের মাসিক বেতন ১০০০-৪০০০ টাকা মাত্র। সরকারী কর্মচারীদের বেতন দশ-বারো হাজার টাকা। এই স্বল্প আয়ের মানুষের পক্ষে কি ঢাকায় গিয়ে রিট পিটিশন পরিচালনা করা সহজ কাজ? উপরন্তু আওয়ামী লীগের দেশব্যাপী উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় যখন দেশের মানুষ একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে চাইছে, তখন তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য মীরজাফর আর মোস্তাকী চক্র নিত্যব্যবহার্য পেঁয়াজের কেজি বানাচ্ছে ২৫০ টাকা, মোটা চালের কেজি ৪০ টাকা, ডাল ৬০ টাকা, সয়াবিন তেল ১০০ টাকা। একজন শ্রমিক ৪/৫ জনের সংসার চালাতে হিমশিম খায় বিধায় খাবারের সংস্থান করতে গেলে তার অন্য কোন চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। শুধু খাদ্যের পেছনেই সমস্ত বেতন ব্যয় করলে লাখ লাখ শ্রমিককে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে চিকিৎসাহীনভাবে ধুঁকে মরতে হবে, বস্ত্রহীন থাকতে হবে এবং ফুটপাথে রোদ-বৃষ্টিতে জীবন ক্ষয় করতে হবে। বাসস্থান সে তৈরি করতে পারবে না, সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ তো অচিন্ত্যনীয়। এরকম একজন শ্রমিকের পক্ষে উত্তরের তেঁতুলিয়া বা দক্ষিণের টেকনাফ থেকে রাজধানী ঢাকায় গিয়ে হাইকোর্টের উকিলদের লাখ টাকার ফি আর হাজার টাকার স্ট্যাম্প ডিউটি দিয়ে রিট মামলা চালানো প্রায় অসম্ভব। বিজ্ঞজনরা হয়তো বলবেন, কুঁজোর এত চাঁদ ছোঁয়ার শখ কেন? গরিবের ঘোড়া রোগ কেন? কৃষক-শ্রমিকের রিটের এত শখ কেন? তবে একটি কথা পাঠক হয়তো প্রলাপ বলে উড়িয়ে দেবেন না যে, এই দরিদ্র কৃষক-শ্রমিকের পক্ষে গ্রাম থেকে ২৫/৩০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে জেলা শহরের উকিলের পকেটে দু-পাঁচ শ’ টাকা গুঁজে দিয়ে, এক শ’ টাকার স্ট্যাম্প ডিউটি দিয়ে রিট দায়ের করাটা খুব একটা অসম্ভব কাজ নয়। কাজেই জেলা শহরে যদি জেলা ও দায়রা জজের হাতে রিট এখতিয়ার প্রদান করা হয় তাহলে এদেশের আপামর মানুষ তাদের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক অধিকার তথা মৌলিক অধিকার বাস্তবায়ন ও কার্যকর করার ন্যূনতম অধিকারটুকু পাবে। আর ঠিক এতে করেই রাষ্ট্রসংঘের ঈপ্সিত ১৬ নম্বরের এসডিজি ‘ন্যায়বিচার’ প্রতিষ্ঠার পথে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে বহুদূর। হয়তো ২০৩০-এর অনেক আগেই পৌঁছে যাব আমরা এই অভীষ্ট লক্ষ্যে। তবে এতে করে সুপ্রীমকোর্টের ক্ষমতার কোন হানি হবে কি? রিটের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জেলা জজের হাতে দেয়া ঠিক হবে কি? এর উত্তর আছে সংবিধানের ৪৪(২) অনুচ্ছেদে : আমাদের পার্লামেন্ট সুপ্রীমকোর্ট ছাড়াও অন্য কোন আদালতকে হাইকোর্ট বিভাগের যে কোন ক্ষমতা প্রদান করতে পারে। অর্থাৎ, জেলা ও দায়রা জজকে যদি রিট এখতিয়ার দেয়া হয় তাহলে তাতে সুপ্রীমকোর্টের অসুবিধা হওয়ার কারণ নেই। একজন জেলা ও দায়রা জজ যদি মৃত্যুদ- দিতে পারেন তাহলে রিটের রায় দেয়ার ক্ষমতা কেন তাঁর থাকতে পারবে না? রিট-প্রতিকারের চেয়ে জীবনহানির প্রতিকার মোটেও ছোট নয়। অতএব, সরকার যদি জেলা জজের আদালতকে রিট মামলা গ্রহণ ও বিচারের ক্ষমতা প্রদানের জন্য একটি আইন পাস করে তাহলেই সমাধান। নিদেনপক্ষে প্রাক্তন ২২ জেলার জজ আদালতে রিট এখতিয়ার দিলেও রক্ষা হয়। রিট এখতিয়ার জেলা জজ কোর্টে না দেয়া হলে বঙ্গবন্ধু যে কৃষক-শ্রমিক-জেলে-জোলাকে রাষ্ট্রের সবচেয়ে দামী ও সম্মানিত মানুষ বলে ভূষিত করেছিলেন সেই গরিব মানুষের কাছে সংবিধান ও মৌলিক অধিকার শুধু ধনীদের স্বার্থরক্ষার যন্ত্র হিসেবে পরিচিত হয়ে থাকবে। এগুলো গরিবের নিকট আকাশের চাঁদের মতো নাগালের বাইরে থাকবে। অধিকার ও প্রতিকারবিহীন অবস্থায় থাকবে গ্রাম-গঞ্জের সাধারণ মানুষ। ব্যর্থ হয়ে যাবে আমাদের প্রথম সংবিধান ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলের ‘স্বাধীনার ঘোষণাপত্রে’ উল্লিখিত ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য সমতা, মানব মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার’ নিশ্চিত করার প্রত্যয়। লেখক : অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া [email protected]
×