ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

জিএম কাদের জাপার চেয়ারম্যান, রাঙ্গা মহাসচিব

প্রকাশিত: ১১:১৬, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৯

জিএম কাদের জাপার চেয়ারম্যান, রাঙ্গা মহাসচিব

স্টাফ রিপোর্টার ॥ গঠনতন্ত্র সংশোধন করে নবম কাউন্সিলে জাতীয় পার্টির (জাপা) নতুন সৃষ্টি করা প্রধান পৃষ্ঠপোষক পদে রওশন এরশাদকে নির্বাচিত করা হয়েছে। আর চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছেন দলটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সহোদর জিএম কাদের। মহাসচিব হয়েছেন মশিউর রহমান রাঙ্গা। শনিবার রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন প্রাঙ্গণে আয়োজন করা হয় জাপার এবারের কাউন্সিল। এরশাদের মৃত্যুর পর প্রথমবারের মতো সম্মেলনের মধ্য দিয়ে নতুন নেতৃত্ব পেল দলটি। আগামী তিন বছর নির্বাচিতরা দায়িত্ব পালন করবেন। তবে সম্মেলনে এরশাদের সহধর্মিণী রওশন এরশাদ ও ছেলে সাদ এরশাদ উপস্থিত ছিলেন না। রওশনের অনুপস্থিতি অনেককে হতাশ করেছে। জানানো হয়, দলের বাদবাকি পদগুলো নির্বাচিত চেয়ারম্যান পূরণ করে পরবর্তীতে নাম ঘোষণা করবেন। সম্মেলনে সভাপতির বক্তব্যে ১৮ দফা তুলে ধরে নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে জিএম কাদের বলেন, দল ভাগাভাগির চেষ্টার ফাঁদে পা দেবেন না। যখন ভাইয়ে ভাইয়ে সদ্বাভ ছিল না তখন জাতীয় পার্টি দুর্বল হয়েছে। তাই দলকে চাঙ্গা রাখতে হলে বা শক্তিশালী করতে ঐক্য ধরে রাখতে হবে। ঐক্যের কোন বিকল্প নেই বলেও মনে করেন সাবেক এই মন্ত্রী। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টির কাউন্সিলে শুভেচ্ছা বার্তা নিয়ে আসেন ওবায়দুল কাদের। নিজ দলের পক্ষ থেকে দেয়া শুভেচ্ছা বক্তব্যে তিনি বলেন, ’৯৬ সালে জাতীয় পার্টির অবদানের কথা আমরা ভুলিনি। সেদিন জাপা সমর্থন দিয়েছিল বলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল। জাতীয় পার্টির কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। সম্মেলনে রওশনপন্থী হিসেবে পরিচিত সাবেক মন্ত্রী ও জাপার শীর্ষ নেতা ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বক্তব্য দেয়ার সময় নেতাকর্মীরা দালাল দালাল, ধর ধর বলে চিৎকার করতে থাকেন। এ সময় সম্মেলন স্থলে তুমুল হট্টগোল শুরু হয়। আনিসুল ইসলামকে বক্তব্য না দিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে যাওয়ার দাবি জানান সবাই। পরে অন্য নেতাদের পক্ষ থেকে পরিস্থিতি শান্ত করা হয়। সম্মেলনে আলোচনা পর্ব শেষে গঠনতন্ত্র সংশোধনী প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে পাস করানো হয়। এরপর প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও চেয়ারম্যানের নাম প্রস্তাব করেন। এ সময় উপস্থিত কাউন্সিলররা কণ্ঠভোটে তা পাস করেন। এরপর জাতীয় পার্টির মহাসচিব হিসেবে মসিউর রহমান রাঙ্গাকে নির্বাচন করেন দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের। সম্মেলনে আসা কাউন্সিলররা পার্টির চেয়ারম্যানকে দলের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের ক্ষমতা দেন। পরবর্তীতে তিনি পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করবেন। শেখ সিরাজুল ইসলাম জানান, জাতীয় পার্টিতে প্রধান পৃষ্ঠপোষকের পদ ছাড়াও সৃজন করা হয়েছে অতিরিক্ত মহাসচিবের পদ। দেশের আট বিভাগে আটজন অতিরিক্ত মহাসচিবকে নির্বাচিত হবেন। তারা প্রত্যেকেই প্রেসিডিয়ামের পদমর্যাদা লাভ করবেন। এছাড়াও কো-চেয়ারম্যান পদে আসছেন আরও ৫ নেতা। তবে রওশনের প্রধান পৃষ্ঠপোষকের পদটি কার্যত অলঙ্কারিক হলেও বলা হচ্ছে দলের সর্বোচ্চ স্থান। কোন সভায় তিনি উপস্থিত থাকলে প্রধান অতিথির পদ অলঙ্কৃত করবেন। গঠনতন্ত্রে আগের মতোই দলের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী থাকছেন চেয়ারম্যান। এদিকে গঠনতন্ত্রের সংশোধিত ধারা অনুযায়ী কেউ অন্য দল থেকে জাপায় আসতে চাইলে পদত্যাগপত্র দেখাতে হবে। বৈদেশিক কমিটি উপজেলা কমিটির মর্যাদা পাবে। এছাড়া দফতর সম্পাদক হবেন দুইজন। জাতীয় তরুণ পার্টি, মোটরযান শ্রমিক পার্টি, জাতীয় শ্রমিক পার্টিকে জাতীয় পার্টির অঙ্গসংগঠনের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। গণতন্ত্রের জন্য শক্তিশালী বিরোধী দল দরকার- ওবায়দুল কাদের ১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টির (জাপা) সহযোগিতায় আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করছিল বলে মন্তব্য করেছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘১৯৯৬ সাল থেকে জাতীয় পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগের মিত্রতা শুরু হয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সেদিন আমাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে জাতীয় পার্টির একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ওই সময় আমাদের সরকার গঠন করার জন্য কিছু আসন কম ছিল। তখন জেলে বসেও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান আমাদের সমর্থন দিয়েছিলেন। আমরা সরকার গঠন করতে পেরেছিলাম। ৯৬ সালে জাতীয় পার্টির অবদানের কথা আমরা ভুলিনি। জাতীয় পার্টির কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় সম্মেলনে দেয়া শুভেচ্ছা বক্তব্যে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী কাদের আরও বলেন, জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান বাংলাদেশে পল্লীবন্ধু নামে খ্যাত। তিনি আমাকে ব্যক্তিগতভাবে ছোট ভাইয়ের মতো ¯েœহ করতেন, ভালবাসতেন। তিনি একজন বিনয়ী রাজনীতিক ছিলেন। জাতীয় পার্টি এবং এইচএম এরশাদ একই বৃন্তে দুটি ফুলের মতো। সারাদেশে জাতীয় পার্টির অনেক কর্মী রয়েছে উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, এরশাদ বেঁচে থাকলে আজ পরিবেশ আরও ভিন্নমাত্রা পেত। আজ জাতীয় পার্টির জাতীয় সম্মেলনে তার স্মৃতি বারবার মনে পড়ছে। জাতীয় পার্টি বিরোধী দলে আসার পর সংসদের কার্যক্রমে নতুন মাত্রিকতা এসেছে। তারা সংসদের ভেতরে ও বাইরে কখনও ভায়োলেন্সের রাজনীতি করেনি। সংসদে জাতীয় পার্টি দায়িত্বশীল, গঠনমূলক বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছে। কাদের বলেন, ‘গণতন্ত্রে সরকারী দল একা শক্তিশালী হলে সরকার শক্তিশালী হবে না। গণতন্ত্রকে অর্থবহ করতে হলে শক্তিশালী বিরোধী দল প্রয়োজন। জাতীয় পার্টি এ ভূমিকাটি যথাযথভাবে এ পর্যন্ত পালন করে আসছে। জাপা ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের রাজনীতি করেনি। দেশের উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা দলটি পালন করছে। ভবিষ্যতে জাপা ঐক্যবদ্ধ থাকবে এমন আশার কথা জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, বিরোধী দল শক্তিশালী হলে রুলিং পার্টি আওয়ামী লীগও শক্তিশালী হবে। তিনি আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে জাপা নেতাকর্মীদের শুভেচ্ছা জানান ও সম্মেলনের সফলতা কামনা করেন। ষড়যন্ত্রের শিকার হবেন নাÑ জি এম কাদের দলের নেতাকর্মীদের কোন প্রকার ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পাড়া না দেয়ার আহ্বান জানিয়ে জিএম কাদের বলেন, জাতীয় পার্টি দুর্বল নয়। কেউ তা বলতে পারবে না। যদি দুর্বল হতো তাহলে সম্মেলনে লোকজনের জায়গা দিতে পারছি না কেন। মানুষ মনে করে দল বিভক্ত এ কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, দলে কি আসলে কোন বিভক্তি আছে। নেই। দলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ না থাকলে অনেকেই মনে করেছিলের জাতীয় পার্টি থাকবে কিনা। কিন্তু সকলের সহযোগিতা ও আন্তরিকতায় জাপা এখন আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী। দলের নেতাকর্মীদের ষড়যন্ত্রেও শিকার না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, দল নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছে। তিনি বলেন, ৪৮ বছর পরও মানুষ স্বাধীনতার পূর্ণাঙ্গ সুফল ভোগ করতে পারছে না। সর্বত্মক অর্থনৈতিক মুক্তি আসেনি। সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি। সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও মাদক এখনও সমাজকে বিপর্যস্ত করে রেখেছে। সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার পূরণে এখনও ঘাটতি রয়ে গেছে। বেকারত্ব যুব সমাজকে হতাশাগ্রস্ত করে রেখেছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিরাজ করছে শূন্যতা। সহমর্মিতা ও সহনশীলতার রাজনীতিক প্রবণতা ক্রমান্বয়ে ক্ষীণ হয়ে আসছে। মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম মূলমন্ত্র ছিল বৈষম্যহীন ন্যায়বিচার ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা। সেই লক্ষ্যের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নই এখন আমাদের রাজনীতি, আমাদের সংগ্রাম আমাদের যুদ্ধ। তিনি বলেন, সম্মেলন থেকে অঙ্গীকার নিয়ে দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পরতে হবে। গোটা জাতীকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। আমরা গতানুগতিক ধারায় কোন নেতিবাচক রাজনীতি করি না। জনগণ বিশ্বাস করে, আমরা নিজেরা ঐক্যবদ্ধ, সংগঠিত ও সুশৃঙ্খল হতে পারলেই তাদের সব প্রত্যাশা পূরণ করতে পারব। তিনি বলেন, আজকের সম্মেলনের দীক্ষা হলো দেশ ও জাতিকে মুক্তি দেয়ার দীক্ষা। ক্ষুধা ও দারিদ্র্য থেকে মুক্তি। সন্ত্রাস ও বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি। তিনি বলেন, ক্ষমতায় গেলে বিচার বিভাগে কখনও হস্তক্ষেপ করব না। ইমাম, মুয়াজ্জিন, পুরোহিত ও ধর্মজাযকদের ভাতা দেয়ারও ঘোষণা দেন তিনি। নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে জিএম কাদের বলেন, দলের মালিকানা আপনাদের। দলের ভাল হলে আপনাদের, আর ক্ষতি হলে আপনাদের ক্ষতি। এ কথাটি অন্তরে ধারণ করবেন। মসিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, আমার দলের নেতাকর্মীদের নামে মামলা দেয়া হয়েছে। তাদের নির্যাতন করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকারকে বলতে চাই, আপনারা এ সব করবেন না। আমাদের আঘাত দেবেন না, আঘাত দিলে এর প্রতিঘাত পাবেন। ওবায়দুল কাদেরের অনুপস্থিতে তিনি বলেন, ‘সরকারকে বলব, আমার কোন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে আর যেন মামলা দেয়া না হয়। যাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে সেগুলো তুলে নিতে হবে। দলের প্রতিবেদন উপস্থাপনের সময় মসিউর রহমান রাঙ্গা আরও বলেন, আমরা ৫৪ জেলায় এরইমধ্যে কমিটি করেছি। আগামী একমাসের মধ্যে বাকি জেলাতেও কমিটি করা হবে। ২০১৬ সালের মার্চে জাতীয় পার্টির অষ্টম কাউন্সিলে দলটির প্রয়াত চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তার ভাই জি এম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যানের পদে বসান। পরে রওশনের জন্য সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান পদ তৈরি করেন এরশাদ। এ বছরের মে মাসে এরশাদ জি এম কাদেরকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন। গত ১৪ জুলাই ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান এরশাদ। তার কিছুদিন পর মসিউর রহমান এক সংবাদ সম্মেলন করে দলের চেয়ারম্যান হিসেবে জি এম কাদেরের নাম ঘোষণা করেন। এ ঘোষণার বিরোধিতা করে রওশনপন্থীরা সেপ্টেম্বর মাসে পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করে রওশন এরশাদকে জাপার চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন। পরে দুই পক্ষের সমঝোতার কথা জানিয়ে মসিউর রহমান সংবাদ সম্মেলন করে জি এম কাদেরকে চেয়ারম্যান এবং রওশনকে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ঘোষণা করেন। সম্মেলনে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখেন, সভাপতিম-লীর সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, মুজিবুল হক চুন্নু, কাজী ফিরোজ রশীদ, মশিউর রহমান রাঙ্গা, সালমা ইসলাম, মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, নাজমা আখতার, ফখরুল ইমাম, নাসরিন জাহান রতœা, সাহিদুর রহমান টেপা, সাঈফুদ্দিন আহমেদ মিলন, লিয়াকত হোসেন খোকা, খালেদ আখতার, ফয়সল চিশতী, মীর আব্দুস সবুর আসুদ, ব্যারিস্টার দিলারা খন্দকার, অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন, আলমগীর সিকদার লোটন প্রমুখ। মঞ্চে পুরো সময় ব্যাপক বিশৃঙ্খলা লক্ষ্য করা গেছে। এর আগে সকাল ১০টায় পায়রা উড়িয়ে সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করা হয়।
×