ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আজ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্মদিন

প্রকাশিত: ১১:১৬, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৯

আজ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্মদিন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ শিল্পের প্রধান শর্তই হচ্ছে সারল্য। চিত্রশিল্প হবে চিন্তার অকপট প্রকাশ। এমন সর্বজনীন ভাবনায় ক্যানভাস রাঙিয়েছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন শিল্পের আবেদন। রুচির দুর্ভিক্ষকে সরিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন শিল্পের পথরেখা। তার রঙ-তুলির আঁচড়েই যাত্রা শুরু হয়েছিল এদেশের চারুকলার। আপন মনন ও সৃজনশীলতার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে বিকশিত করেছেন বাংলার চিত্রকলা ভুবন। অনন্য সব শিল্প সৃষ্টি করে বিশ্বসভায় তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের শিল্প ও সংস্কৃতি। আলোকবর্তিকা হয়ে শিল্পের পথ দেখিয়েছেন প্রকৃতি ও মানুষের ছবি আঁকা এই চিত্রকর। শুধু তাই নয়, বাংলার চারুশিল্প আন্দোলনেও রেখেছেন পথিকৃতের ভূমিকা। আজ রবিবার এই কিংবদন্তী শিল্পীর ১০৫তম জন্মবার্ষিকী ও ১০৬তম জন্মদিন। ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর এই পথিকৃৎ চিত্রশিল্পী কিশোরগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। শিল্পাচার্যের জন্মদিন উপলক্ষে তিন দিনব্যাপী জয়নুল উৎসবের আয়োজন করেছে ঢাবির চারুকলা অনুষদ। চারুকলার নিকটবর্তী শিল্পাচার্য জয়নুলের সমাধিসৌধে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণের মধ্যদিয়ে শুরু হবে উৎসব। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জয়নুল সম্মাননা দেয়া হবে ভারতের শিল্পী অধ্যাপক ড. জনক ঝঙ্কার নার্জারি আর বাংলাদেশের দুই শিল্পী অধ্যাপক হামিদুজ্জামান খান ও অধ্যাপক মাহামুদুল হককে। এছাড়া উৎসবের উদ্বোধনী দিনে নবসজ্জিত জয়নুল শিশুকলা নিকেতন ও স্থায়ী সংগ্রহশালা উদ্বোধন করা হবে। উৎসবের পথম দিন থেকেই চারুকলার লিচুতলায় হবে জয়নুল মেলা। এই মেলায় অংশ নেবেন সারাদেশ থেকে আসা ৪০ কারুশিল্পী। মঙ্গলবার পর্যন্ত চলমান উৎসবের অংশ হবে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। আজ সকালে উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি। ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক মোঃ আখতারুজ্জামানের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেবেন ঢাবির উপউপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ। বাংলাদেশে চারুকলা চর্চা ও আন্দোলনের পথের দিশারী বিরল প্রতিভার অধিকারী শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ জেলায় জš§গ্রহণ করেন। বাবা তমিজউদ্দীন আহমেদ ও মা জয়নাবুন্নেছা। বেড়ে উঠেছেন ব্রহ্মপুত্র নদের প্লাবন অববাহিকার শান্ত, সুনিবিড় ও রূপময় প্রাকৃতিক পরিবেশে। শৈশব থেকেই ছবি আঁকার প্রতি ছিল প্রবল ঝোঁক। রং-তুলির খেলায় ফুল, ফল, বৃক্ষ, লতাপাতা, মাছ, পাখিসহ নানা বিষয় মেলে ধরতেন ক্যানভাসে। আর এই ছবি আঁকার টানেই ১৯৩৩ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ না নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান কলকাতায়। ভর্তি হন সেখানকার গবর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টসে। ’৩৮ সাল পর্যন্ত ওখানেই চলে শিল্পাচার্যের চারুশিক্ষার দীক্ষা। ’৩৮ সালে ড্রইং এ্যান্ড পেন্টিং বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে অর্জন করেন স্নাতক ডিগ্রী। ততদিনে শিল্পী হিসেবেও শিল্পরসিকদের স্বীকৃতি অর্জন করে নেন। স্থান করে নিয়েছেন মুষ্টিমেয় আধুনিক ভারতীয় শিল্পীর তালিকায়। এরপর তিনি কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন। এদেশের শিল্পের ভিত রচনার এক উজ্জ্বল নক্ষত্র জয়নুল আবেদিন। তার হাত ধরেই বিকশিত হয় এদেশের চারুশিল্প মাধ্যম। ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকা আর্ট কলেজ (বর্তমানে চারুকলা অনুষদ)। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই দেশে আধুনিক শিল্পচর্চার প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। ’৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি এ প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। আর শুধু আধুনিক শিল্পচর্চার বিকাশসাধন নয়, তিনি চেয়েছিলেন এদেশের লোকশিল্পের উন্নয়ন ও তার সঙ্গে আধুনিক শিল্পের মেলবন্ধন। সেই আকাক্সক্ষায় ’৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেরণায় না’গঞ্জের সোনারগাঁয় প্রতিষ্ঠা করেন লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন। ’৭২ সালে তিনি বাংলা একাডেমির সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ’৭৪ সাল পর্যন্ত এই পদে বহাল থাকেন। ’৭৪ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির অন্যতম উপদেষ্টা মনোনীত হন। যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় কংগ্রেস ফর ওয়ার্ল্ড ইউনিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ’৭৪ সালে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় অধ্যাপক নিযুক্ত হন এবং আমৃত্যু এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। শিল্পীজীবনে রং-তুলির ছোঁয়ায় জয়নুল আবেদিন ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে এঁকেছেন দুর্ভিক্ষের রেখাচিত্র। ১৯৬৯ সালে তার ক্যানভাসে উঠে এসেছে গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট। ’৭০ সালে এঁকেছেন ৬৫ ফুট দীর্ঘ বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘নবান্ন’। একই বছর মনপুরা নামে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের হƒদয়স্পর্শী চিত্র সৃজন করেছেন। শিল্পীর এসব কালজয়ী শিল্পকর্ম দেশের সীমা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিম-লে পেয়েছে ব্যাপক প্রশংসা ও স্বীকৃতি। শিল্পীর আঁকা দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা ছাড়াও বিদ্রোহী, মুক্তিযোদ্ধা, গুনটানা, সাঁওতাল রমণী, সংগ্রাম, গ্রামীণ নারীর চিত্রমালা শীর্ষক ভাস্কর্য শিল্পকলায় অক্ষয় হয়ে আছে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন বাংলার প্রকৃতি, জীবনাচার, প্রাচুর্য, দারিদ্র্য ও বাঙালীর স্বাধীনতার স্পৃহা তার রং-তুলি আর ক্যানভাসে মূর্ত করে তুলেছেন। শিল্পকলার সুবাদে বাঙালী সংস্কৃতিকে পৌঁছে দেন বিশ্ব দরবারে । একই সঙ্গে আমৃত্যু সমাজ থেকে রুচির দুর্ভিক্ষ দূর করে সৌন্দর্যবোধ জাগ্রত করার সাধনায় নিমজ্জিত রাখেন নিজেকে। ’৪৬ সালে জয়নুল আবেদিন ঢাকানিবাসী তৈয়ব উদ্দিন আহমদের মেয়ে জাহানারা বেগমকে বিয়ে করেন। জাহানারা বেগম পরে জাহানারা আবেদিন নামে নিজেকে পরিচিত করেন। তাদের দাম্পত্য জীবনের ফসল তিন ছেলে। এরা হলেন সাইফুল আবেদিন, খায়রুল আবেদিন ও মঈনুল আবেদিন। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ’৭৬ সালের ২৮ মে ৬১ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন।
×