ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সাধারণ সভা ঘিরে মুখরিত বাংলা একাডেমি

গল্প আড্ডা কুশল বিনিময়ই বড় লাভ এবং লোভ

প্রকাশিত: ১১:১৫, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৯

গল্প আড্ডা কুশল বিনিময়ই বড় লাভ এবং লোভ

মোরসালিন মিজান ॥ বুড়োরাও এত গল্প আড্ডা জমাতে পারেন? সেই সকাল থেকে শুরু। বিকেল পর্যন্ত চলল। ম্যারাথন গল্প আড্ডা। বিভিন্ন বয়সীদের সমাবেশে লিড দিলেন বুড়োরাই। অবশ্য সামনা সামনি তাদের ‘বুড়ো’ অপবাদ দেয়ার সাহস কেউ দেখাননি। বরং প্রবীণদের দেখে অপেক্ষাকৃত কম বয়সীরাও উৎসাহিত হয়েছেন। কবি সাহিত্যিক গবেষক ইতিহাসবিদ প্রত্নত্ত্ববিদ শিল্পী ও সুধীজনের এ মিলনমেলা শনিবার বাংলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত হয়। খুব সকালে, তাও শীতের সকাল, বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ সরব হয়ে ওঠেছিল। সবুজ খোলা চত্বরে ক্রমেই বাড়তে থাকে উপস্থিতি। কেউ গায়ে চাদর জড়িয়ে আসেন। কারও গলায় মাফলার। মাথায় উলের টুপি। দেখে বোঝা যায়, শীতের সঙ্গে লড়াই করতে করতে এখানে এসেছেন তারা। ঢাকার সভ্যরা যেমন এসেছিলেন, তেমনি এসেছিলেন বাইরে থেকে। উপলক্ষ্য- বাংলা একাডেমির সাধারণ পরিষদের বিয়াল্লিশতম বার্ষিক সভা। আরও সহজ করে বললে, এজিএম। বরাবরের মতোই এ সভায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হয়। তবে মূল আগ্রহ ছিল দেখা- সাক্ষাতে। সমবেত সকলেই কম বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সহজে এক জায়গায় হন না। সাধারণ সভা তাদের একত্রিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। সে সুযোগে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি অঙ্গনের বিশিষ্টজনদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল একাডেমি চত্বর। একটি আড্ডার মধ্যমণি হয়ে ছিলেন লেখক গবেষক আইয়ুব হোসেন। দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বরের রচনা সমগ্র সম্পাদনা করেন তিনি। সাধারণ সভা প্রসঙ্গ তুলতেই বললেন, এক বছর পর অনেক লেখক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলো। আমাদের প্রথম প্রশ্নটাই, কেমন আছ? পরের কথাটি আরও মজার। তিনি বলেন, সভার আনুষ্ঠানিকতার চেয়েও পরস্পরের সঙ্গে কুশলবিনিময়ের লোভ এবং লাভ আমাদের এখানে টেনে নিয়ে এসেছে। এবারের আয়োজন পরিপাটি হলেও, প্রশ্ন উত্তর পর্বের সময় আরও বাড়ানো উচিত ছিল বলে মনে করেন তিনি। বলেন, আগেও এ বিষয়ে একাডেমির অনীহা দেখা গেছে। এর ফলে জবাবদিহিতার জায়গাটা কমে যায়। গায়ে মেরুন রঙের চাদর জড়িয়ে একাডেমিতে এসেছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার। তাকে ঘিরেও একাধিক আড্ডা জমতে দেখা যায়। একই রকম গল্প আড্ডা জমেছিল আসাদুজ্জামান নূরকে ঘিরে। সংসদ সদস্য ও সাবেক সংস্কৃতি মন্ত্রীকে এবার সম্মানসূচক ফেলোশিপ প্রদান করে একাডেমি। সঙ্গত কারণেই সুহৃদরা তাকে অভিনন্দিত করছিলেন। অসুস্থ অভিনেতা আলী যাকেরের পক্ষে ফেলোশিপ গ্রহণ করতে এসেছিলেন স্ত্রী অভিনেত্রী সারা যাকের। তিনিও এ আড্ডায় যোগ দেন। দলবল নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে জনকণ্ঠকে নূর বলেন, একাডেমির জেনারেল মিটিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছুই আলোচিত হয়। একইসঙ্গে পন্ডিত ব্যক্তিদের দেখা সাক্ষাত পাওয়া যায়। ঢাকার বাইরে থেকে যারা সাহিত্য চর্চা করেন, হয়ত অতো প্রচারে আসেন না, তাদেরকেও আজ এখানে পেয়েছি। এ পাওয়াগুলোকে বড় করে দেখতে চাই। অবশ্য দেশের প্রতিনিধিত্বশীল কবি কথা সাহিত্যিকদের অনেককে, আমি যতক্ষণ ছিলাম, দেখিনি। নাটকের লোক, চিত্রশিল্পী, সঙ্গীত শিল্পীদের উপস্থিতিও কম ছিল বলে মনে হয়েছে। এর পরও যারা ছিলেন, তাদের সঙ্গে সুন্দর সময় কাটিয়েছেন বলে জানান তিনি। ভাষা শহীদ ভাস্কর্যের সামনে সামনে হালকা রোদ এসে পড়েছিল। সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলেন ইতিহাসবিদ ড. ফিরোজ মাহমুদ ও হাশেম সুফী। ড. ফিরোজের আলোচনার বিষয় ছিল ইউনেস্কোর ইনটেজিবল কালচারাল হেরিটেজ। তিনি বলছিলেন, বাংলাদেশের নক্সীকাঁথা আগামী বছর এ স্বীকৃতি লাভ করতে পারে। সে লক্ষ্যে সরকার আবেদন করেছে। তবে ন্যাশনাল ইনভেন্টরি আপডেট না করায় অর্জনের পথে সমস্যা হতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। আর সুফী তার ঢাকা বিষয়ক গবেষণার কথাই তুলে ধরছিলেন। বলছিলেন, এখনও বলা হয় ঢাকা ৪০০ বছরের। এটা ভুল। আমি দেখিয়ে দিতে পারি, ঢাকা বয়স হাজার বছরের বেশি। নজরুল মঞ্চের পেছনের অংশে গল্প জামিয়েছিলেন সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ ও একাডেমির পরিচালক জালাল আহমেদ। এ সময় সভা উপলক্ষে উপহার দেয়া ব্যাগ এত ভারি কেন? জানতে চান গোলাম কুদ্দুছ। উত্তরে হাসলেও, জালাল আহমেদ পরে বই প্রদর্শনী স্থলে গিয়ে বলেন, আগামী বার ব্যাগ খালি রাখতে হবে। সবাই তাহলে এখান থেকে বিশেষ ছাড়ে বই কিনে ব্যাগ ভরতে পারবেন। ব্যক্তিগত গল্পও কম হয়নি। বর্ধমান হাউসের সামনে গল্প জমিয়েছিলেন ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুন, কবি তারিক সুজাতসহ কয়েকজন। নানা বিষয়ে আলোচনা চলছিল। হঠাৎ-ই ওঠে এলো ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ। মুনতাসীর মামুন বলছিলেন, পৈত্রিক সূত্রে আমি একটি পাহাড়ের মালিক। চট্টগ্রামে অবস্থিত পাহাড়টি ভাবছি বিক্রি করে দেব। পরিচিত কারও একটি পাহাড় আছে, সেটি আবার বিক্রিও করে দেবেন, শুনে বিস্ময় ও বেদনা প্রকাশ করলেন উপস্থিত দু’ একজন। পরে ইতিহাসবিদ জানালেন, নিজের আরও যা আছে সবই দান করে দেয়ার কথা ভাবছেন তিনি। খ্যাতিমান শিল্পীদের আঁকা অমূল্য চিত্রকর্মের বড় সংগ্রহ, ইতিহাসের নানা গুরুত্বপূর্ণ দলিল তার কাছে আছে। আরও কিছু নিদর্শন নিয়ে ঢাকায় একটি সংগ্রহশালা গড়তে চান। নতুন জায়গা কিনে এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের কথা বলতেই তাকে থামান তারিক সুজাত। বলেন, আপনি এখন যে বাড়িতে আছেন সেখানেই চমৎকার মিউজিয়াম হতে পারে। অবশ্য শেষতক কী হবে তা জানার আগেই মুনতাসীর মামুন অন্য একটি আড্ডায় যোগ দিতে চলে যান। তরুণদের মধ্যে নিয়মিত আড্ডায় ছিলেন লোক গবেষক সায়মন জাকারিয়া। সম্প্রতি ফ্রান্স ঘুরে এসেছেন তিনি। বলছিলেন, সেখানে সতের শ’ সালের পুরনো বাংলা পুঁথি দেখে এসেছি। কী যে যত্নের সঙ্গে সংরক্ষণ করা হচ্ছে! এর পরই কিছুটা বেদনাবোধ। গবেষণা কাজ করতে গিয়ে নানা বিপত্তির মধ্যে পড়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, এ দেশে ভাল কিছু হওয়া সত্যি কঠিন। ভাল কিছু করতে গেলেই বাধা। এত বাধা টপকিয়ে দেশ এগোতে পারে না আসলে। তার বক্তব্যকে সমর্থন ভিতরগড় দুর্গ নিয়ে কাজ করা শিক্ষক ড. শাহনাজ হুসনে জাহান লীনা। এভাবে নানা গল্প। বহুবিধ আলোচনা। ভাললাগা মন্দলাগার অনুভূতি। লম্বা সময় ধরে চলে। বিকেল চারটার দিকে সভার কার্যক্রম সমাপ্ত ঘোষণা করেন একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ্ সিরাজী। এর পরই ভাঙতে শুরু করে মিলনমেলা। ‘দেখা হবে, ‘আইসেন’ ইত্যাদি বলে প্রিয় প্রাঙ্গণ ছেড়ে যান বিদগ্ধজনেরা।
×