ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দেশের প্রথম উচ্চ মাধ্যমিকের এ্যালামনাই শুরু

ঐতিহ্যের রাজশাহী কলেজে হাজার শিক্ষার্থীর মিলনমেলা

প্রকাশিত: ০৯:৪৪, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৯

 ঐতিহ্যের রাজশাহী কলেজে  হাজার শিক্ষার্থীর  মিলনমেলা

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী কলেজে দেশের প্রথম এইচএসসি পর্যায়ের এ্যালামনাই শুরু হয়েছে। শুক্রবার সকাল নয়টায় কলেজের রবীন্দ্র-নজরুল চত্বর থেকে ঢাকঢোল, তবলা আর গানের তালে আনন্দ শোভাযাত্রা বের করা হয়। শোভাযাত্রাটি মহানগরীর সোনাদীঘি মোড়, জিরোপয়েন্ট, আলুপট্টিসহ বিভিন্ন প্রধান সড়ক হয়ে আবারও রাজশাহী কলেজ মাঠে গিয়ে শেষ হয়। শোভাযাত্রায় রাজশাহী কলেজ এইচএসসি এ্যালামনাই পুনর্মিলনীর আহ্বায়ক ও কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মুহাঃ হবিবুর রহমান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, নাটোর-৪ আসনের এমপি আব্দুল কুদ্দুস, রাজশাহী-৩ আসনের এমপি আয়েন উদ্দিন, সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি আদিবা আনজুম মিতা, সিনিয়র এ্যালামনাস ব্যাচ ১৯৪৭-এর ডাঃ এসএএ বারীসহ রেজিস্ট্রেশনকারী অন্তত ১০ হাজার সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থী অংশ নেন। পরে শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে এ্যালামনাই অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন। এ সময় কলেজ অধ্যক্ষ মুহাঃ হবিবুর রহমান ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমসহ অন্য অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন। ১৯৫৫ সালে রাজশাহী কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের (এইচএসসি) শিক্ষার্থী ছিলেন জুলফিকার হোসেন। তিনিও যোগ দিয়েছেন মিলনমেলায়। তার মতে, এত অপরূপ সাজে তিনি এই কলেজকে কখনও দেখেননি। চোখ ধাঁধানো সাজসজ্জা দেখে অভিভূত অবসরপ্রাপ্ত এই অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। শুধু জুলফিকার হোসেন একা নন, তার মতো শত শত প্রবীণ ব্যক্তি এসেছেন রাজশাহী কলেজে। তারা সবাই রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। শুক্রবার সকালে তাদের নিয়েই শুরু হয় এইচএসসি এ্যালামনাই পুনর্মিলনী। ইংরেজ প্রকৌশলীর পরিকল্পনায় নির্মিত পুরনো গাঢ় লাল রঙের ভবনগুলো এমনিতেই কলেজের বিশেষ আকর্ষণ। সেসব ভবনের ওপর করা হয়েছে সাদা রঙের আলোকসজ্জা। এই আলোকসজ্জা ভবনগুলোর সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ। শুধু প্রশাসন ভবন নয়, কলেজের অন্য সব ভবনে করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন আলোকসজ্জা। বাদ যায়নি কলেজের ভেতরে থাকা গাছগুলোও। এ্যালামনাই উপলক্ষে রাজশাহী কলেজ মিলনায়তনের সামনের জায়গাটিতে নতুন করে দৃষ্টিনন্দন টাইলস বসানো হয়েছে। তার পাশে গাঁদা ফুলের বাগান। প্রশাসন ভবনের আদলে মাঠে তৈরি করা হয়েছে বিশালাকার এক মঞ্চ। কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী প্রখ্যাত কবি, গীতিকার এবং সুরকার রজনীকান্ত সেনের নামে মঞ্চের নাম দেয়া হয়েছে ‘রজনীকান্ত মঞ্চ’। শুক্রবার সন্ধ্যায় এই মঞ্চে গান গেয়ে মঞ্চ মাতান জেমস। শুক্রবার সকাল থেকে মূল অনুষ্ঠান শুরু হলেও বৃহস্পতিবার বিকেল থেকেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়। বিকেল থেকেই কলেজে আসতে শুরু করেন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা সাবেক শিক্ষার্থীরা। কেউ আসেন স্ত্রীকে নিয়ে, কেউ স্বামীকে, কেউ সন্তান এবং কেউ নাতি-নাতনিদের নিয়ে। কলেজে গিয়ে মেতে ওঠেন কলেজ জীবনের বন্ধুদের সঙ্গে। কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর হবিবুর রহমান জানান, গত বছরের ডিসেম্বরে এইচএসসি এ্যালামনাই আয়োজনের ব্যাপারে প্রাথমিক কথাবার্তা শুরু হয়। তারপর এ বছরের মার্চে অনুষ্ঠিত হয় এ্যালামনাই আয়োজনের প্রথম সভা। দফায় দফায় সভা করে সবকিছু চূড়ান্ত হলে শুরু হয় নিবন্ধন প্রক্রিয়া। দুই দিনের এই এ্যালামনাইয়ে ৯ হাজার প্রাক্তন শিক্ষার্থীর পাশাপাশি এক হাজার অতিথিও অংশ নেন। এ্যালামনাই আয়োজনে দুই কোটি টাকারও বেশি খরচ হচ্ছে। দুই দিনের এই অনুষ্ঠানে থাকছে আলোচনা, স্মৃতিচারণ, ছাত্রাবাসের স্মৃতিচারণ, সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা, ফানুস উড়ানো, আতশবাজিসহ নানা আয়োজন। রাজশাহী কলেজ দেশের তৃতীয় পুরাতন কলেজ। দেশভাগের আগে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং রাজশাহী কলেজের শিক্ষকদের মধ্যে বদলি-পদায়ন হতো। তাই এই কলেজকে প্রেসিডেন্সি কলেজের সমতুল্য ধরা হয়। তারা এটি প্রমাণও করেছেন। চার বছর ধরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তালিকায় দেশসেরা এই কলেজ। আর তিন বছর ধরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিংয়েও এই কলেজ শীর্ষ স্থান ধরে রেখেছে। পরের র‌্যাংকিং এখনও ঘোষণা হয়নি। তবে তারা ইতোমধ্যে জানতে পেরেছেন রাজশাহী কলেজই আবার দেশসেরা হচ্ছে। প্রসঙ্গত, রাজশাহী শহরের প্রাণকেন্দ্রে প্রমত্তা পদ্মার পাশ ঘেঁষে অবস্থিত কলেজটি ঢাকা ও চট্টগ্রাম কলেজের পরে বাংলাদেশের তৃতীয় প্রাচীনতম কলেজ। ১৮৭৩ সালের পহেলা এপ্রিলে মাত্র ছয় জন ছাত্র নিয়ে যাত্রা শুরু করে কলেজটি। বর্তমানে প্রায় সাতাশ হাজার শিক্ষার্থীকে পাঠদানের মাধ্যমে উত্তরবঙ্গ ও দেশের শিক্ষাঙ্গনে বড় ভূমিকা রেখে চলেছে প্রাচীন এই বিদ্যাপীঠ। ১৪৭ বছরের দীর্ঘ পথ চলায় বিভিন্ন চড়াই-উতরাই পার হয়ে কলেজটি এখনও স্বমহিমায় উজ্জ্বল। গতিশীল সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাজশাহী কলেজ নিজেকে রাঙিয়েছে আধুনিকতার ছোঁয়ায়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ২৮টি সূচকের ভিত্তিতে তিনবার দেশসেরার মুকুট অর্জন করেছে। এছাড়াও পেয়েছে ডিজিটাল কলেজের খেতাব। প্রায় সাতাশ হাজার শিক্ষার্থীর পদচারণায় মুখর ক্যাম্পাসটিতে ২৪টি বিভাগে স্নাতক সম্মান, স্নাতকোত্তর, ডিগ্রী ও এইচএসসি শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান করা হয়। বর্তমানে কলেজে ২৬০ জন কর্মঠ শিক্ষক কর্মরত আছেন। আধুনিক প্রযুক্তির যুগে পিছিয়ে নেই রাজশাহী কলেজ। কলেজের নিরাপত্তার স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে স্থাপন করা হয়েছে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা। প্রতিটি বিভাগে চালু করা হয়েছে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম। শিক্ষকদের জন্য সরবরাহ করা হয়েছে প্রয়োজনীয় ল্যাপটপ। প্রতিটি বিভাগে রয়েছে সুদৃশ্য কম্পিউটার ল্যাব। ক্লাসের শিক্ষার্থীদের বহির্বিশ্বের সঙ্গে সর্বদা যোগাযোগ রাখার জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে ফ্রি ওয়াই-ফাই সেবা।
×