ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলা গানের গন্তব্য সম্পর্কে দেশের ৬ জনপ্রিয় যা বললেন

স্বর্ণযুগের সেই শ্রোতা নেই, প্রজন্মের শ্রোতারা গান শোনে না- দেখে

প্রকাশিত: ১১:১৯, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৯

স্বর্ণযুগের সেই শ্রোতা নেই, প্রজন্মের শ্রোতারা গান শোনে না- দেখে

গৌতম পাণ্ডে ॥ ‘আরও বিদেশী শিল্পী আসুক, দেশকে আরও সমৃদ্ধ করুক, দেশকে আরও সম্মানের শিখরে নিয়ে যাক এটাই প্রত্যাশা করি। কারণ, আমাদের দেশের শিল্পীরা তো গান গাইতে জানে না। বিদেশী শিল্পীদের জন্য আমাদের দেশ কোটি কোটি টাকা খরচ করতে পারে, আমাদের জন্য তো কোন টাকা পয়সা খরচ করা যাবে না। এটা আমি কোন অভিযোগ থেকে বলছি না। যখন ফেসবুকে ছবি দেখি আহা! কী কণ্ঠ, কী চাহনি, কী লাইটিং এগুলো খুবই ভাল লাগে। একটা শিল্পীর জন্য যতখানি খরচ করা উচিত, সেটা করা হচ্ছে। আমাদের দেশ কিন্তু এসব পারে। আমরা যখন কোন প্রোগ্রাম করতে যাই তখন টাকা দিতে পারে না। বলে টাকা নেই, সাউন্ড নেই- এভাবেই গান গাইতে হবে। ভাবলাম, কেন এমন হয় তখন বুঝতে পারলাম যে আমাদের শিল্পীদের সম্মান নেই। শুধু বাইরের শিল্পীরাই এ সম্মান পাওয়ার যোগ্য। এক প্রকার ক্ষোভের সঙ্গে এসব বললেন জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী ফাহমিদা নবী। এক প্রকার হতাশায় বাংলা গান। শোনার মাধ্যম দ্রুত বদলে যাওয়ায় শ্রোতাও বিভ্রান্ত। গানের বোঝা বইতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। শিল্পী থেকে শুরু করে গীতিকার, সুরকার, যন্ত্রী, অডিও কোম্পানি সবাই অনিশ্চয়তায়। স্থিতিশীলতা নেই গানের বাজারে। এটা নিয়ন্ত্রণের কোন পদ্ধতিও নেই। একটা সময় ক্যাসেট প্লেয়ারে গান শোনার বিষয়টি ব্যাপক প্রচলিত ছিল। মূলত নব্বই দশক থেকে এই শতকের শুরু পর্যন্ত ক্যাসেটে গানের এ্যালবাম প্রকাশ করা হতো। এরপর সিডি প্লেয়ারে গান শোনা শুরু হলে দ্রুত হারিয়ে যায় ক্যাসেট। কিন্তু বর্তমানে সবকিছুকে ছাড়িয়ে জায়গা করে নিয়েছে অনলাইনে গানের প্রকাশনা। ইউটিউব, ফেসবুকের মাধ্যমে শ্রোতারা যে কোন সময় যে কোন স্থান থেকে উপভোগ করতে পারছেন ওসব গান। সেইসঙ্গে বিভিন্ন মোবাইল এ্যাপি কেশন্সের কারণে বদলে যাচ্ছে শ্রোতাদের গান শোনার অভ্যাস। অনেকেই একে বলছেন ডিজিটাল গানের যুগ। একটা সময় জনপ্রিয় কোন শিল্পীর লাখ লাখ কপি ক্যাসেট ও সিডি বিক্রি হতো। কিন্তু এখন তা নেই। ইউটিউবে গান প্রকাশ হচ্ছে। এতে সেটা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ও নেই। রাজধানীর অনেক সিডির দোকান বন্ধ হয়ে সেখানে হয়েছে পোশাকের দোকান। এর ওপর আবার ওয়েলকাম টিউন থেকে আয় কমে গেছে উল্লেখযোগ্য হারে। ফলে কোম্পানিগুলো গানে বিনিয়োগ করছে কম। এ বছর কোরবানির ঈদের পর এই গতি আরও কমে গেছে। এখন অনেকটাই স্থবিরতা বিরাজ করছে সঙ্গীতাঙ্গনে। অন্যদিকে ইউটিউবে যার ভিউ যত বেশি তার দিকেই ঝুঁকছে কোম্পানিগুলো। কারণ, ইউটিউবই এখন সবচেয়ে বড় মাধ্যম গান থেকে আয়ের। ফলে ভিউনির্ভর শিল্পীদেরই প্রাধান্য বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফলে মূলধারার শিল্পীদের বড় একটা অংশের ভেতর হতাশা ভর করেছে। কারণ, তাদের কাজ কমে গেছে। এমতাবস্থায় সার্বিকভাবেই সঙ্গীতাঙ্গনে বিরাজ করছে হতাশার কালো মেঘ। এখান থেকে কবে নাগাদ বের হওয়া যাবে সে বিষয়টিও নিশ্চিত নয়। অন্যদিকে সঙ্গীত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো গানের বদলে ঝুঁকছে নাটক কিংবা ওয়েব সিরিজ নির্মাণের দিকে। গানের চেয়ে ইউটিউবে নাটক কিংবা ওয়েব সিরিজের কাটতি বেশি বলে অনেক সঙ্গীত কোম্পানি এখন নাটকে বিনিয়োগ করছে। কোন কোন সময় নাটক কিংবা ওয়েব সিরিজে ব্যবহার করা হচ্ছে গান। সেক্ষেত্রে গানটি পরে ভিডিওসহ আলাদা প্রকাশ করা যাচ্ছে। ফলে কাজ কমছে শিল্পীদের। কারণ, কোম্পানি একটি কাজে বিনিয়োগ করে তিনটি অডিও-ভিডিও পাচ্ছে। সেক্ষেত্রে মুনাফাটাও বেশি হচ্ছে। অন্যদিকে হাতেগোনা কয়েক শিল্পীর বাইরে অন্য কোন শিল্পীর গান করে রিস্কও নিতে চাচ্ছে না কোম্পানিগুলোকে। সব মিলিয়ে এখন একটি তথৈবচ অবস্থা সঙ্গীতাঙ্গনে। এ প্রসঙ্গে ফাহমিদা নবী আরও বলেন, সত্যি বলতে আমিও বিরক্ত এসব নিয়ে। ভাল শিল্পীদের মূল্যায়নটা সেভাবে হচ্ছে না। এ জন্য দেশের সঙ্গীতের ভবিষ্যত নিয়ে আমি শঙ্কিত। তারকা শিল্পী ছাড়াও বিপাকে পড়ছেন নতুন শিল্পীরাও। কারণ, তারা কোন সাপোর্টই পাচ্ছে না। অনেকেই মেধাবী থাকা সত্ত্বেও অর্থ খরচ করে গান করতে পারছে না। এতে মেধাবী শিল্পীরাও সঙ্গীতাঙ্গনে ঢোকার আগেই হারিয়ে যাচ্ছে। তাদের মনে একটি বিরূপ মনোভাব তৈরি হচ্ছে। ফাহমিদা বলেন, অনেক আগে থেকেই দেশের শিল্পীদের পেছনে কোন টাকা লগ্নি করা হচ্ছে না। যখন আমরা ইয়ং ছিলাম অনেক কষ্ট করে গান শিখেছি। মাহমুদুন্নবীর মেয়ে হিসেবে নয়, অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়েই আমাকে এই জায়গায় আসা সম্ভব হয়েছে। প্রযুক্তির কারণেই আমরা তো সবকিছুতেই বিদেশী দেখি। ওরা তো কোয়ালিটি মেনটেন করে, শিল্পীদের যথার্থ মূল্যায়ন করে। বাংলাদেশে যখন ওসব শিল্পী নিয়ে আসে একইরকম সম্মানের সঙ্গে নিয়ে আসে। এজন্য ওরা ওদের মতোই দেখতে পায় কিন্তু আমরা পাই না। আমাদের নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের কোন রকমের সহযোগিতার হাত কেউ বাড়িয়ে দেয় না। বিদেশী শিল্পীরা এসে আমাদের খুশি করতে পারছে- দেখে ভালই লাগে। সামনে এমন আরও দেখব। নাইনটিনাইন পার্সেন্ট লোক এখন আর দেশী শিল্পীর গান শুনতে চায় না। আমরা আমাদের ভালবাসি না। আমাদের সমৃদ্ধশালী ভাবতে শিখিনি, শিখতেও চাই না। পারলে অন্য ভাষায় কথা বলি, বাংলা ভাষায় কথা বলতে চাই না। আমাকে একদিন একটি মেয়ে বলছে, এ্যাম আই এ ভেরি বিগ ফ্যান অব ইউ। সে বাঙালী, বাংলায় কথা বলতে পারে। তার কাছ থেকে ইংরেজীতে এ কথা শুনতে চাই না। এগুলো এক ধরনের মূর্খতা। আমরা দিনে দিনে মূর্খতার দিকে যাচ্ছি। আমরা যে শিক্ষিত হতে পারি তা স্বীকার করতে চাই না। বাংলাদেশের সঙ্গীত কোন দিকে যাচ্ছে জানি না। আমি আমার জায়গায় আছি। আমার শ্রোতা-দর্শক ধরে রেখেছি। বাঙালী সব সময় দুঃখ থেকেও বিনোদন খোঁজে। গান বিনোদনের চাহিদা মেটানোর অন্যতম মাধ্যম। তারপরও কেন গানের এই দশা? নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন, এখন যারা কাজ করছে তারা ঢালাও কাজ করে যাচ্ছে। বেশিরভাগ মিউজিশিয়ানই এখন যন্ত্রনির্ভর। ‘লুপ কেটে কাট কপি পেস্ট’ পদ্ধতিতে করছে গান তৈরির কাজ। তেমন কোন শিক্ষা ও ধারণা ছাড়াই গান করছে। এসব আবার রাতারাতি হিটও হচ্ছে। কেউ বলছেন এখন তরুণ যারা গান করছে তারা বড্ড বেশি অস্থির। এরা তাড়াহুড়োয় কাজ শেষ করতে চায়। রাতারাতি তারকা খ্যাতি পাওয়ার জন্য হাতে প্রচুর কাজ নেয়। জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী রবি চৌধুরী বলেন, এখনকার বেশিরভাগ শিল্পী অস্থির প্রকৃতির। তারা খুবই শট-কাটে মেরে দিচ্ছে। একটা গান পুরোপুরি করার ধৈর্য হারিয়ে ফেলছি। ওরা দশ-বারোটা গানের মুখ নিয়ে একটা গান বানায়। সেই প্রজন্মে আমরা আছি। কাজেই শ্রোতার কাছে আমরা ঠিকমতো গান পৌঁছতে পারছি না। এখন সিডি নেই, ক্যাসেট নেই। এখন গানের কথার মধ্যে কোন নতুনত্ব আমি পাই না। আমাদের সময় যখন আমরা বারোটা গান একটা সিডিতে করতাম, তখন বারো রকমের থিম নিয়ে কাজ করতাম। একটা গান নিয়ে আমরা গীতিকার, সুরকার ও গায়ক বসে কয়েকদিন সিটিং দিতাম। এখন ওই বিষয়টা নেই। এখন শিল্পী একাই সব করে ফেলে। আমি তুমি সবাই আছি আমির মধ্যে। তোমায় ছেড়ে আমি যাব কোথায়, তোমায় ছাড়া বাঁচি না, ও আমার জান, তুই কি আমার হবি রে এই সব আরকি! গান বাজনা এখন এই পর্যায়ে চলে গেছে। রবি চৌধুরী বলেন, গানের সুদিন অবশ্য আসবে। যারা গান লিখবেন তারা তো সময়ই দিচ্ছেন না। যারা লিখবেন তাদের ভেতরে তো কাব্যটা থাকতে হবে, তা এখন নেই। গীতিকার হচ্ছেন একজন কবি। ভাল গান লিখতে গেলে ভাল কবি হতে হবে। কবিরা গান লিখলে সুন্দর হবে। ভারতের নচিকেতা যখন বাংলাদেশে আসে, এদেশের গান যখন শোনে- তখন হাসে। বলে তোদের এখানে লেখকের খুব অভাব। আমি বলি লেখক আছে, ওদের কাছে আমরা পৌঁছতে পারি না। কয়েক বছর ধরে সঙ্গীতাঙ্গনের অনেকের মুখে শোনা যায় দুই একটি ছাড়া ভাল কথার গান হচ্ছে না। কিন্তু থেমে নেই শিল্পী, গীতিকার ও সুরকাররা। অনেক গানে কোটি কোটি ভিউ হচ্ছে বলে সংবাদ প্রকাশ হয়, আবার কয়েক দিন পর সেই গান ভুলেও যাচ্ছে শ্রোতা। অনেকের অভিযোগ এ প্রজন্মের অধিকাংশ শিল্পী ভাল কথার গানের পেছনে ছুটছেন না। ছুটছেন হিট গানের পেছনে। হিট গান চাই, হিট। এই হিটের প্রত্যাশাই ভাল গানের ধারাকে ধূলিসাত করছে। সৈয়দ আবদুল হাদী বলেন, সত্যিকার অর্থে আমাদের গান সেভাবে আর মানুষের মনে রেখাপাত করতে পারছে না। পারছে না এজন্য যে, আজ আছে কাল নেই। কেউ মনে রাখছে না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে আমাদের মধ্যে ক্রিয়েটিভিটি নেই। মেলোডি হারিয়ে ফেলেছে। দেশের শ্রোতা দেশেরই জলবায়ুতে বড় হয়েছে, শ্রোতাপ্রিয়তা পেতে গেলে তো কাজের মধ্যে শেকড়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে হবে। আমাদের তো একটা বৈশিষ্ট্য বা চরিত্র আছে। এর সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে এলিয়ান কিছু করলে তো হবে না। ক্রিয়েটিভিটি একদম নেই, সবই অনুকরণ। এমনকি বাংলা উচ্চারণ অনেকে বিকৃত করছে। এটা যে বাংলা ভাষা বোঝাই যায় না। এতে কি নতুন প্রজন্মের আগ্রহের অভাব মনে হয়Ñ এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এটা সময়ের প্রভাব, অস্বাভাবিকও কিছু না। এখন সারা পৃথিবী হাতের মুঠোয়। এই মুহূর্তে পৃথিবীতে কি হচ্ছে না হচ্ছে সবই মুহূর্তেই আমরা দেখছি। নিয়মই হচ্ছে এই, তোমার চেয়ে উন্নত, বড়, অগ্রসর এটা সব সময়ই অনুকরণ করবে। আমাদের এখানে তা-ই হচ্ছে। কিন্তু এটা করতে গিয়ে আমরা আমাদের শেকড় ভুলে যাচ্ছি। ‘সঙ্গীতের তরী’ কোন দিকে যাচ্ছে? প্রশ্নের উত্তরে স্বনামধন্য গীতিকবি শহীদুল্লাহ ফরায়জী বলেন, আমাদের সব জায়গায়ই অস্থিরতা। কিন্তু এর মধ্যেও নতুন গান হচ্ছে, বরেণ্য শিল্পীরা গান করছেন, নতুনরাও গাইছেন। ভাল-মন্দ মিলিয়েই চলছে। প্রচুর গান যে হচ্ছে তা অস্বীকারের উপায় নেই। ইউটিউবে প্রচুর গানের ভিউ বাড়ছে, টিভিতেও লাইভ গানের অনুষ্ঠান হচ্ছে। গানের কদর কমছে না, দিন দিন বরং বাড়ছে। তবে আরও ভাল ভাল গান দেয়ার চেষ্টা আমাদের করতে হবে। মানুষ যতদিন আছে গানও ততদিন থাকবে। এক সময়ে রেডিও ও ক্যাসেটই ছিল গান শোনার উল্লেখযোগ্য মাধ্যম। এখন ডিজিটাল হয়েছে। সবাই ইউটিউবে গান শোনে। সঙ্গে সঙ্গে গান এখন দেখার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিউজিক ভিডিও বলি যাকে, তার মাধ্যমে গান শোনার পাশাপাশি বিভিন্ন দৃশ্য বা মোমেন্ট উপভোগ করে দর্শক। তবে আগের গানের আবেদন বেশি। যে গানে সবাইকে মানবিক করে সেই গানের খুবই দরকার। তিনি বলেন, এখন ডিজিটালি গান প্রকাশ হচ্ছে ঠিক আছে। তবে আমি মনে করি একটা নিয়মের মধ্যে সব কিছু চলা উচিত। যে সব সমস্যা আছে তা একসঙ্গে বসে সমাধান করা উচিত। প্রয়োজনে সরকারের সঙ্গে অডিও কোম্পানি, শিল্পী ও সঙ্গীত সংশ্লিষ্টরা বসে আলোচনা করা উচিত। আমার মনে হয় সবার চেষ্টা থাকলে যে কোন সমস্যাই মোকাবেলা করা সম্ভব। জনপ্রিয় শিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ বলেন, গান শোনার মাধ্যম পাল্টালেও শ্রোতা শুনতে পারছে। অবশ্য কিছু বিপত্তি আছে। একটা শ্রেণী অনলাইন বেজে গান শোনার টেকনোলজিতে এ্যাডভান্স না। সো একটা শ্রেণী কিন্তু বাদ পড়ছে। আরেকটা শ্রেণী হচ্ছে সারাক্ষণ কাজেকর্মে ব্যস্ত থাকে। টিভি দেখার সময় হয় না। ক্যাসেট শোনার সময় হয় না। কাজের শেষে এসে এক টেলিফোনে সব কাজ সারে। হেসে কথা বলা, গান শোনা, নাটক দেখা। জিনিসটা আগে ছিল ভিজিবল, এখন ইনভিজিবল। সব কিছু এখন হয়ে গেছে অনলাইন বেজড। এখানে সশরীরী বিষয়টা নেই। একটা ক্যাসেট হাতে নেয়ার মধ্যে অন্যরকম একটা ফিলিংস আছে। আমরা এখন শুভেচ্ছাও অনেক ভাবে পাঠাই। জন্মদিনের কেক পাঠাই তাও ছবি। সব কিছু এখন ছবি কেন্দ্রিক হয়ে গেছে। একটা আমন্ত্রণপত্র পাঠিয়ে দাওয়াত আর একটা এসএমএস পাঠিয়ে দাওয়াতের মধ্যে তফাত আছে। মনে করুন আমার জন্মের কিছু আগে হয়ত আমার বাবা মারা গেছেন। আমার বাবার ছবি দেখে যে ফিলিংস আর বাবাকে স্বশরীরে দেখায় অনেক পার্থক্য। গানের সঙ্গে মিউজিক ভিডিওর মিল হচ্ছে না এটা কিভাবে দেখছেন? প্রশ্নের উত্তরে কুমার বিশ্বজিৎ বলেন, এতে আমার একটু অন্য মত আছে। গান প্রকৃতপক্ষে শোনার বিষয়, উপলব্ধির বিষয়। আপনি যখন মিউজিক ভিডিও বানিয়ে দেবেন তখন একটা পরিম-ল বা একটা সার্কেলের মধ্যে দর্শককে ঢুকিয়ে দিলেন এই দৃষ্টিতে দেখেন। আমি আমার চোখে দেখব আপনি আপনার দৃষ্টিতে, যার যার মনে ভিডিওর দৃষ্টিতে ভিন্নতা। অবতারণা থাকে না। উপলব্ধির বিষয়টা ফিক্সড করে দেয়া হচ্ছে। এটা একেবারেই ঠিক না। যেহেতু বিশ্বায়নের যুগে টিকতে হলে আপনাকে একটু চাকচিক্যের বিষয় থাকে। কিন্তু সঙ্গীতের সব চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে গানের কথা, সুর ও গায়কী। আমার কাছে মূল বিষয়ের চেয়ে অনুষঙ্গ যদি বড় হয়ে যায় তাহলে হবে না। আমি ভিডিওটাকে একটা অনুষঙ্গ মনে করি। আমি টেলিভিশনে যখন গাইছি অনেকে তখন বলছেন আপনাকে খুব সুন্দর লাগছে, এটা আমার জন্য অপমানজনক। বাংলা গানে আমরা কি সেই স্বর্ণযুগে ফিরে যাচ্ছি নাকি পিছিয়ে পড়ছিÑ প্রশ্নের উত্তরে প্রজন্মের শিল্পী কোনাল বলেন, সঙ্গীতের স্বর্ণযুগের অডিয়েন্স আর এখনকার অডিয়েন্স এক না। স্বর্ণযুগে যে গান শুনত এখনকার অডিয়েন্স সে গান শোনে তবে অন্যরকম চায়। চাহিদা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চেঞ্জ হয়, হয়েছেও। আমরা আগের মতো খাই না। সব কিছু বদলেছে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মিউজিকটাও সেভাবে দেয়ার চেষ্টা করছে সবাই। আমার তো মনে হয় বাংলা গান সুন্দরের দিকে এগোচ্ছে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা হয়ত অনেক কিছু পাই না কিন্তু দেয়ার চেষ্টা করি। খারাপের ভিড়ে অনেক ভাল জিনিস হারিয়ে যাচ্ছে এটা কি বিশ্বাস করেন? প্রশ্নের উত্তরে কোনাল বলেন, খারাপের ভিড়ে ভাল হারিয়ে যাওয়া সব সময়ই ছিল, শুধু এখন না। সব সময়ই এটা থেকে থাকে, তবে সেখান থেকে শ্রোতাই চুজ করে কোনটা তারা সব সময়ের জন্য রাখবে কোনটা রাখবে না। ধরুন ত্রিশ বছর আগের গান আমরা এখনও শুনি, আজ থেকে ত্রিশ বছর পর আমার গান কিংবা আমাদের প্রজন্মের শিল্পীদের গান শ্রোতা শুনবে কিনা তা ত্রিশ বছর গেলে বোঝা যাবে। এর আগে কেউ গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারবে না। যে কোন কাজ সবার কাছে পৌঁছানোর জন্য একটা সময় দিতে হবে। আমার মনে হয় প্রজন্মের শিল্পীদের ভাল কাজ যেগুলো হচ্ছে সেগুলোও শ্রোতার মনে রেখাপাত করবে। চোখের দিকে চলে গেছে, তখন থেকে প্রাণ হারাতে বসেছে সঙ্গীতশিল্প। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে এসব মেনে নিতে হবে। সময়ের দাবির কাছে নতশিরে গানে ভিডিওর প্রাসঙ্গিকতা মেনে নিতে হবে। তবে প্রাণবন্ত সুর আর কথানির্ভর গানে আবার ভরে উঠুক আমাদের সঙ্গীতাঙ্গনÑ আমি সব সময় সেই প্রত্যাশা করি।
×