ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

৬ লেনের ৪৮ কিমি এই সড়ক যুক্ত হবে ঢাকা- টাঙ্গাইল ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সঙ্গে;###;উত্তর-পূর্বাঞ্চল যোগাযোগ সহজ হবে

অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলবে ঢাকা বাইপাস

প্রকাশিত: ১১:১১, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৯

অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলবে ঢাকা বাইপাস

রাজন ভট্টাচার্য ॥ যানজটের নগরী খ্যাত ‘ঢাকা’র ভেতরে প্রবেশ ছাড়াই দেশের পূর্বাঞ্চল থেকে উত্তরাঞ্চলে সড়কপথে যোগাযোগ আসছে হাতের নাগালে। এই অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলবে জয়দেবপুর-দেবগ্রাম-ভুলতা-মদনপুর সড়ক (ঢাকা বাইপাস) ফোরলেন প্রকল্প। সব মিলিয়ে ছয়লেন বিশিষ্ট ৪৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কটি উত্তরে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক ও দক্ষিণে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে সংযুক্ত করবে। এর বাইরে ভুলতায় ঢাকা-সিলেট ও ভোগরায় সংযোগ ঘটাবে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে রাজধানী ঢাকার ভেতরে প্রবেশ ছাড়াই পূর্বাঞ্চল থেকে উত্তরাঞ্চলে যানবাহন সহজেই চলাচল করতে পারবে। দেশের প্রথম প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত এক্সপ্রেসওয়েটি ব্যবহার করতে যাত্রী ও পণ্যবাহী যানবাহনগুলোকে টোল দিতে হবে। প্রায় চার হাজার কোটি টাকায় ব্যয়ে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) ভিত্তিক প্রকল্পটি শেষ হবে ২০২২ সালে। বৃহস্পতিবার নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার ব্রাহ্মণখালী এলাকায় জয়দেবপুর-দেবগ্রাম-ভুলতা-মদনপুর সড়ক (ঢাকা বাইপাস) উন্নীতকরণ প্রকল্পের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, চায়নার বেসরকারী কোম্পানি সিচুয়ান রোড এ্যান্ড ব্রিজ গ্রুপ কর্পোরেশন লিমিটেড, শামীম এন্টারপ্রাইজ প্রাইভেট লিমিটেড ও ইউডিসি কনস্ট্রাকশন লিমিটেড যৌথভাবে ২০১৮ সালের ৬ ডিসেম্বর পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ চুক্তি স্বাক্ষর করে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ কাজের জন্য। পিপিপির আওতায় ঢাকা বাইপাস সড়কের নির্মাণ কাজ আগামী তিন বছরের মধ্যে শেষ হবে। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ঢাকা এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ কাজ নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই শেষ হবে। মাঝে প্রকল্পের অর্থ বরাদ্দ নিয়ে কিছু জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার কারণে এক্সপ্রেসওয়ের কাজ কিছুটা মন্থরগতিতে চলেছিল। অর্থ বরাদ্দের বিষয়টি ইতোমধ্যে সমাধান হয়েছে। যে কারণে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই এ প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শেষ হবে বলেও জানান তিনি। চার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে প্রকল্পের নির্মাণ কাজে। এরমধ্যে ২২৩ কোটি টাকা অর্থ মন্ত্রণালয় অনুদান হিসেবে বরাদ্দ দেবে। বাকি টাকা পিপিপির আওতায় চুক্তিবদ্ধ বিদেশী দুটি কোম্পানি বহন করবে। জমি অধিগ্রহণ ও সার্ভিস চার্জ হিসেবে সড়ক ও জনপথ বিভাগ পাঁচ শ’ কোটি টাকা ব্যয় করবে। বাকি ৩ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা বেসরকারী বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করবেন। ২০২২ সালের মধ্যে ঢাকা-বাইপাস সড়কের ছয়লেন বিশিষ্ট এক্সপ্রেস সড়ক নির্মাণ কাজ শেষ হবে। ৪৮ কিলোমিটার সড়ক এশিয়ান হাইওয়ে রুটে অন্তর্ভুক্তির জন্য জয়দেবপুর-দেবগ্রাম-ভুলতা-মদনপুর পর্যন্ত ৪৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ৪ লেন বিশিষ্ট ঢাকা বাইপাস সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। এই সড়কে স্থানীয় যানবাহন চলাচল করতে দুইলেন বিশিষ্ট সার্ভিস লেন নির্মাণ করা হবে। গাড়ি চলবে ১২০ কিলোমিটার বেগে এশিয়ান হাইওয়ের দুইটি আন্তর্জাতিক (এএইচ-১, এএইচ-২) ও একটি আঞ্চলিক (এএইচ-৪১) রুট বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে অতিক্রম করেছে। রুট তিনটির অন্তর্ভুক্ত ১ হাজার ৭৪১ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়ন করা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে এশিয়ান হাইওয়ে রুটে যুক্ত করার জন্য জয়দেবপুর-দেবগ্রাম-ভুলতা-মদনপুর পর্যন্ত ৪৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা বাইপাস সড়ক নির্মাণ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এশিয়ান হাইওয়ে মানের সড়ক মূলত ‘প্রাইমারি বা ধমনী সড়ক’ নামে পরিচিত। এগুলোয় প্রবেশ সংরক্ষিত থাকে, যাতে অযান্ত্রিক ও ধীরগতির যানবাহন প্রবেশ করতে না পারে। এগুলোর জন্য পৃথক সড়ক (সার্ভিস রোড) থাকবে। আর প্রাইমারি সড়কের দুই পাশে নিরাপত্তামূলক বেষ্টনী বা সীমানা প্রাচীর থাকে যাতে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চলতে পারে। ন্যূনতম চার লেনের এসব সড়কে কোন মোড় থাকবে না। এছাড়া সড়কের দুইপাশে কমপক্ষে ৫০ মিটারের মধ্যে কোন জনবসতি বা স্থাপনা থাকা যাবে না। প্রতি এক কিলোমিটার পর পর উল্লেখ থাকবে পরবর্তী জেলার নাম ও দূরত্ব। এসব সড়কের পাশ দিয়ে পথচারী চলাচল বা আড়াআড়ি সড়ক পারাপারও নিষিদ্ধ প্রকল্প সূত্র জানায়। সময় কমবে বাঁচবে জ্বালানি খরচ প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের মদনপুর থেকে গাজীপুরের কড্ডা পর্যন্ত ঢাকা বাইপাস সড়ক এক্সপ্রেসওয়ে সড়ক হিসেবে রূপান্তর হবে। এটি হবে ঢাকা-মাওয়ার পর দেশের দ্বিতীয় এক্সপ্রেস সড়ক। নির্মাণে ইতোমধ্যে সড়ক ও জনপথ বিভাগের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে কোম্পানি তিনটি। প্রকল্পের আর্থিক পরামর্শক হিসেবে কাজ করছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এই সড়ক নির্মাণ হলে মদনপুর থেকে কড্ডা পর্যন্ত পৌঁছতে সময় লাগবে মাত্র ৪০ মিনিট। এখন যানজটের কারণে পণ্যবাহী বা যাত্রীবাহী পরিবহনগুলোকে গাজীপুর থেকে ঢাকা হয়ে ভুলতা বা মদনপুর যেতে সময় লাগে কমপক্ষে তিন থেকে চারঘণ্টা। প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে চার ভাগের একভাগ সময়ে এই রাস্তা অতিক্রম করা সম্ভব হবে। ঢাকার বাইরে থেকে যেসব যানবাহন প্রতিদিন রাজধানীতে প্রবেশ করে ও বেরিয়ে যায়, তাদের যদি ভিন্নপথে রাজধানী অতিক্রম করানো যেত, তাহলে যানজট সমস্যার অনেকটাই সমাধান হয়ে যেত নগর বিশেষজ্ঞরা অনেক আগে থেকেই এমন পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। এ পরামর্শ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে এবার জয়দেবপুর-দেবগ্রাম-ভুলতা-মদনপুর পর্যন্ত ঢাকা বাইপাস সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। এই বাইপাস সড়ক নির্মিত হলে পণ্য নিয়ে ট্রাক এবং ট্যাংক-লরির মতো ভারি যানবাহন আর রাজধানী শহরে প্রবেশ করতে হবে না। রাজধানী শহরের পাশ দিয়ে চট্টগ্রাম ও উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় ১২০ কিলোমিটার গতিতে চলে যাবে এসব পণ্যবাহী যান। ঢাকা বাইপাস সড়ক নির্মাণ এশিয়ান হাইওয়ের অংশ হিসেবে গৃহীত হয়েছে বলে জানা গেছে। আশার কথা হলো এ প্রকল্পটিতে এবার যুক্ত হলো এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্পে আর্থিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করবে এই উন্নয়ন সংস্থাটি। প্রকল্পের আওতায় মদনপুর থেকে কড্ডা পর্যন্ত মূল এক্সপ্রেস সড়ক হবে চার লেনের। এর বাইরে সড়কের দুই পাশে থাকবে আরও দুটি লেন। এগুলোর প্রশস্ত হবে দেড় লেন করে। এ প্রকল্পে সরকারের অংশগ্রহণ হচ্ছে ২২৩ কোটি টাকা। যা ২৫ বছরে পরিশোধ করবে সরকার। থাকছে পাঁচটি উড়াল সড়ক প্রকল্পের আওতায় গাজীপুরের ভোগড়া, মিরেরবাজার, বস্তুল, ধীরাশ্রম ও কাঞ্চন সেতুর আগে নির্মাণ করা হবে পাঁচটি ফ্লাইওভার। ২৫টি আন্ডারপাস। যেহেতু সড়কের একটা বড় অংশ যাবে পূর্বাচলের ওপর দিয়ে, সে কারণে আন্ডারপাসকেই অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। কাঞ্চনে শীতলক্ষ্যা নদীর চার লেনের সেতুসহ তিনটি বড় সেতু নির্মাণ করা হবে। এর সবই হবে চার লেনের। এর একটি হবে উলুখোলা ও অন্যটি হবে নাগদায়। সড়কটিতে নির্বিঘেœ যানবাহন চলাচলের জন্য চারটি ইন্টারচেঞ্জ, ৫টি টোলফ্লাজা, ২টি রেলওয়ে ওভারপাস ও ৪টি ওভারপাস নির্মাণ করা হবে। এর বাইরে ৬টি সেতু প্রশস্ত করা এবং পথচারী ও ধীরগতির যানবাহনের জন্য একাধিক আন্ডারপাস নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) সবুজ উদ্দীন খান জানান, নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছে তাতে নির্মাণ কাজ শুরুর দিন থেকে চার বছরের মধ্যে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সরকারের এ মেয়াদেই এই প্রকল্পের কাজ শেষ করে এক্সপ্রেসওয়েটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে। চলতে হবে টোল দিয়ে প্রকল্প সূত্র জানায়, নির্মাণের পর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ২৫ বছর এটি তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখবে। ওই সময়ের মধ্যে সড়কের টোল থেকে তারা নির্মাণ ব্যয় তুলে নেবে। এরপর সড়কটি সড়ক ও জনপথ অধিদফতরকে বুঝিয়ে দেবে। যেসব যানবাহন এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে চলাচল করতে চাইবে না সেগুলো দুই পাশের লেন ব্যবহার করতে পারবে। সেক্ষেত্রে তাদের কোনরকম টোল দিতে হবে না। বর্তমানে একই এ্যালাইনমেন্টে দুই লেনের বাইপাস সড়ক রয়েছে। এটিতে চার লেনের এক্সপ্রেসওয়ে ও দুই পাশে ধীরগতির যান চলাচলের জন্য পৃথক লেন নির্মাণ করা হবে। পিপিপি কর্তৃপক্ষের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ আফসার এইচ উদ্দিন বলেন, এ প্রকল্প বাংলাদেশে জনসেবার ক্ষেত্রে একটি নতুন মাত্রা এনে দেবে। এটি দেশের প্রথম প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত এক্সপ্রেসওয়ে।
×