ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পর্যালোচনা করছে বাংলাদেশ

বাণিজ্য বাড়াতে দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি চায় ভারত

প্রকাশিত: ১১:০৯, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৯

বাণিজ্য বাড়াতে দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি চায় ভারত

এম শাহজাহান ॥ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়াতে বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব (সিপা) চুক্তি করতে চায় ভারত। প্রতিবেশী দেশটির পক্ষ থেকে সিপা চুক্তির প্রস্তাব পাওয়ার পর তা পর্যালোচনা করছে বাংলাদেশ। এই চুক্তির ফলে বাংলাদেশ কতটুকু লাভবান হবে কিংবা ক্ষতির কোন ঝুঁকি রয়েছে কি না তা পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করছে বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউট (বিএফটিআই)। আগামী ১৩-১৬ জানুয়ারি ভারতের দিল্লীতে অনুষ্ঠিতব্য ‘বাংলাদেশ-ভারত জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ অন ট্রেড’ এর গুরুত্বপূর্ণ সভায় সিপা চুক্তির বিষয়ে আলোচনা করা হবে। এছাড়া যে কোন পণ্য রফতানির উপর নিষেধাজ্ঞা দিতে হলে কমপক্ষে তিন মাস আগে আমদানিকারক দেশকে জানানোর প্রস্তাব দেবে বাংলাদেশ। বাণিজ্য চুক্তির আওতায় এ ধরনের একটি সংযুক্তি চেয়ে ভারতের কাছে প্রস্তাব রাখা হবে। জানা গেছে, পেঁয়াজ, আদা, রসুন ও চালসহ প্রায় সব ধরনের ভোগ্যপণ্য সামগ্রী ভারত থেকে আমদানি করে থাকে বাংলাদেশ। এর বাইরে কাপড়-চোপড়, ইলেক্ট্রনিক্স ও যন্ত্রপাতি সামগ্রী আনা হয়। প্রতিবেশী এই দেশটির সঙ্গে শুধু অফিসিয়াল বাণিজ্যের পরিমাণ বছরে প্রায় ৯-১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বড় অঙ্কের এই বাণিজ্যের পুরোটাই ভারতের অনুকূলে রয়েছে। কিন্তু গত সেপ্টেম্বর মাসে হঠাৎ করে ভারত নিজেদের প্রয়োজনে পেঁয়াজ রফতানির উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। ফলে পেঁয়াজের প্রধান উৎস ভারত থেকে আমদানি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বেড়ে দেশে প্রতিকেজি পেঁয়াজের দাম উঠে প্রায় ৩০০ টাকার ঘরে। ভবিষ্যতে হঠাৎ করে কোন নিয়মিত আমদানিপণ্যের উপর যাতে নিষেধাজ্ঞা দেয়া না হয় সেজন্য বাণিজ্য চুক্তিতে একটি সংযুক্তি দেয়ার প্রস্তাব দেবে বাংলাদেশ। এ ব্যাপারে জোরালো আলোচনা করা হবে এবারের দিল্লী বৈঠকে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি সেক্রেটারি মোঃ সেলিম হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশ-ভারত জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ অন ট্রেডের এবারের বৈঠকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, বাণিজ্য সচিবের নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল এবার বৈঠকে অংশগ্রহণ করতে দিল্লী যাবেন। মূলত দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধি এবং এক্ষেত্রে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা সমাধানের বিষয়ে আলোচনা করা হবে বৈঠকে। পেঁয়াজ এবার সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে বাংলাদেশের ভোক্তাদের। ভারত হঠাৎ করে রফতানি বন্ধ করে দেয়ায় দেশে এ পণ্যটি নিয়ে সঙ্কট তৈরি হয়। এ কারণে ভবিষ্যতে কোন পণ্যের উপর নিষেধাজ্ঞা দিতে হলে কমপক্ষে তিন মাস আগে আমদানিকারক দেশকে অবহিত করতে হবে। বাণিজ্য চুক্তির আওতায় এ ধরনের একটি প্রস্তাব দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রসঙ্গত, ভারত নিজেদের প্রয়োজনে গত ২৯ সেপ্টেম্বর হঠাৎ করে পেঁয়াজ রফতানির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এর ফলে সবচেয়ে বিপাকে পড়ে বাংলাদেশ। কয়েক ঘণ্টরা ব্যবধানে ওই সময় দ্বিগুণ দাম হয়ে যায় দেশে। ওই অবস্থায় বাজার পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার মিসর, তুরস্ক, থাইল্যান্ড, চীন ও মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানি শুরু করে। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারকে শেষ পর্যন্ত উড়োজাহাজে করে পেঁয়াজ আনতে হয়। এখন বড় অঙ্কের ভর্তুকি দিয়ে সরকার টিসিবির মাধ্যমে ৩৫ টাকায় পেঁয়াজ বিক্রি করছে ভোক্তাদের কাছে। অথচ ভারত হঠাৎ করে রফতানির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ না করলে উদ্যোক্তারা সময় নিয়ে কম দামে কম খরচে বিকল্প উৎস থেকে দেশে পেঁয়াজ আনতে পারতেন। দেশে পেঁয়াজ নিয়ে এ ধরনের সঙ্কট তৈরি হতো না। এমনকি এ পণ্যটি নিয়ে ব্যবসায়ীরা কারসাজির সুযোগ নিত না। জানা গেছে, কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট বা সিপা চুক্তি করার বিষয়ে ভারতের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি। এ কারণে ভারতের মোদি সরকারের প্রথম মেয়াদেই চুক্তিটি করার বিষয়ে প্রস্তাব দেয়া হয়। ভারতের সেন্টার ফর রেজিওনাল ট্রেড (সিআরটি) এ বিষয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানিয়েছে মোদি সরকারকে। অন্যদিকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিষয়টি বিএফটিআই পর্যালোচনা করছে। তবে এখনও সংস্থাটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়নি। এ বিষয়ে আরও সমীক্ষা হওয়ার প্রয়োজনের কথা তুলে ধরেছে বিএফটিআই। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শরীফা খান জনকণ্ঠকে বলেন, সিপা চুক্তি করার বিষয়ে বরাবরই ভারতের আগ্রহ রয়েছে। ভারত বড় দেশ, তাদের বাণিজ্য অনেক বড়। বাংলাদেশ আমদানিকারক দেশ। এ কারণে আমাদের পক্ষ থেকে বিষয়টি গভীরভাবে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, এ সংক্রান্ত সমীক্ষা রিপোর্ট পাওয়ার পর এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। জানা গেছে, দুই দেশের বাণিজ্য সচিব পর্যায়ের এবারে বৈঠকের আলোচনায় দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানোর বিষয়গুলোই সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাবে। ভারতের দিক থেকে বেনোপোল বন্দরে ট্রাক জট ছাড়াতে ‘ওয়ান টাইম পুস’ চালু করার প্রস্তাব থাকতে পারে। এছাড়া দুই দেশের সীমান্তে নির্মাণাধীন বর্ডার হাটের অগ্রগতি নিয়েও আলোচনা হবে। বাংলাদেশের দিক থেকে স্থলবন্দরগুলোর উন্নয়নে সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রকল্প গ্রহণের তাগিদ দেয়া হবে। যাতে দুই দেশের সীমান্ত বন্দরে একই ধরনের অবকাঠামো সুবিধা নিশ্চিত করা যায়। এছাড়া বিএসটিআই অনুমোদিত পণ্য ভারতের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক স্বীকৃতির বিষয়ে প্রস্তাব দেবে বাংলাদেশ। এছাড়া বাংলাদেশের পাট ও হাইড্রোজেন পার অক্সাইড জাতীয় পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে ভারত যে এ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করেছে তা প্রত্যাহারের বিষয়েও প্রস্তাব দেবে বাংলাদেশ। এছাড়া ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ১২টি প্রতিবন্ধকতা কাজ করছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই অবকাঠামো সমস্যা। বাংলাদেশ সরকার এসব সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছে। ঢাকা ও দিল্লীর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে বর্তমানে যেসব ইস্যু বাধা হিসেবে কাজ করছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে বুড়িমারী-চেংড়াবান্ধা ও তামাবিল-ডাউকি স্থলবন্দরের দুর্বল অবকাঠামো, ঢাকা-গুয়াহাটির মধ্যে দ্রুত বিমান সার্ভিস চালু না করা, বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে নৌপ্রটোকলের আওতায় ব্রহ্মপুত্র নদে এখনও পোর্ট অব কল স্থাপন না করা, রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি না হওয়া, কোস্টাল শিপিং পুরোপুরি চালু না করা ও বেশিসংখ্যক বর্ডারহাট স্থাপন না করা, শুল্ক-অশুল্কজনিত সমস্যা, সহজে ভিসা না পাওয়া প্রভৃতি।
×