ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাক্-স্বাধীনতার সীমারেখা কতদূর?

প্রকাশিত: ০৯:২৬, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৯

বাক্-স্বাধীনতার সীমারেখা কতদূর?

একজন মানুষের সঙ্গে অন্যজনের ভাবের বিনিময় হয় কথোপকথনের মাধ্যমে। স্বাভাবিকভাবেই এটি কারও কাছে কাম্য নয় যে, কেউ নৈতিকতা বিবর্জিত হয়ে সীমারেখা লঙ্ঘন করুক। সভ্যতা বিকাশের পূর্বে মানুষ নিজেদের বোধশক্তি কাজে লাগিয়ে নিজের কথার ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখার চেষ্টা করত। ধর্ম ও রাষ্ট্রব্যবস্থা একটি কাঠামোর মধ্যে আসার পর অনিয়ন্ত্রিত বাক্-স্বাধীনতায় লাগাম টানার চেষ্টা করা হলো। কিন্তু মানুষ যখন তাঁর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠে, তারপর শুরু হয় মানুষের অস্বাভাবিক বাক্-স্বাধীনতার চর্চা। ফলে বিশৃঙ্খলা ঠেকানোর জন্য আইনের মাধ্যমে নির্ধারণ করতে হয় কথা বলা বা মতো প্রকাশের সীমারেখা কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত থাকবে সে বিষয়টি। কখনও কখনও মনে হয়- পৃথিবী সৃষ্টির ঊষালগ্নে যখন কোন ভাষা ছিল না, হয়তো তখন পৃথিবীতে এত সমস্যা ছিল না। ভাষা সৃষ্টি হওয়ার মধ্য দিয়ে পৃথিবী বদলে গিয়েছে বৈপ্লবিকভাবে। আধুনিকতা, উন্নয়ন ও অগ্রগতির নানান মানদ-ের মূলে রয়েছে ভাষা ও বাক্-স্বাধীনতার প্রসঙ্গটি। মানুষ যখন বলতে শিখল, তখন তাদের চাহিদা বেড়ে গেল আর চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মানুষের উন্নয়নের ধারণা সমৃদ্ধ হতে লাগল। ফলে বঞ্চিত মানুষগুলো তাদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে দীর্ঘকাল সংগ্রাম করে চূড়ান্তভাবে স্বাধীনতা শব্দটিকে নিজের করে নিয়েছে। কাজেই বাক্-স্বাধীনতা আজ বাংলাদেশে সাংবিধানিক অধিকারে পরিণত হয়েছে। তাই প্রশ্ন হচ্ছে- বাক্-স্বাধীনতার সীমারেখা কতদূর? আধুনিক বিশ্বের প্রতিটি দেশের নাগরিক বাক্-স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে, কিন্তু এ স্বাধীনতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিছু বিধি-নিষেধ রয়েছে। বাক্-স্বাধীনতা আমাদের সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশে বাক্-স্বাধীনতার প্রসঙ্গটি লিপিবদ্ধ রয়েছে সংবিধানের ৩৯ নং অনুচ্ছেদে। উল্লিখিত অনুচ্ছেদের শিরোনাম হচ্ছে ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক্-স্বাধীনতা।’ সংবিধানের এই অনুচ্ছেদের মাধ্যমে চিন্তুা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। শুধু তাই নয়; বরং বাংলাদেশের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা অরোপিত বাধা-নিষেধ সম্পর্কে সকল নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশ সংক্রান্ত অধিকার ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হয়েছে। মোটের ওপর কথা হচ্ছে- প্রত্যেক নাগরিকের বাক্-স্বাধীনতার অধিকার রয়েছে, কিন্তু সেই স্বাধীনতা এতটা পর্যন্ত বিস্তৃত নয়, যা অন্যের অধিকারকে অসম্মান করে। অর্থাৎ যে বাক্-স্বাধীনতা আদালত অবমাননা করে কিংবা ব্যক্তি বা সংগঠনের মানহানি করে, সেই বাক্-স্বাধীনতাকে সংবিধান গ্রাহ্য করে না। বাংলাদেশে প্রচলিত দণ্ডবিধি আইন, ১৮৬০-এর ৪৯৯ ধারায় সে সকল বাক্-স্বাধীনতাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে পরিগণিত করেছে, যেগুলো প্রকাশ ও প্রচার করলে অন্য কারও মানহানি ঘটতে পারে। দ-বিধি আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ (সংশোধিত, ২০১৩)-এর ৫৭ ধারায় বাক্-স্বাধীনতার সীমারেখাকে আরও কঠিনভাবে বিবেচনা করা হয়েছিল। উল্লেখ্য যে, আইনটির ৫৭ ধারা এখন আর চলমান নেই। তবে জাতীয় ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও ডিজিটাল অপরাধ শনাক্তকরণ প্রতিরোধ দমন, বিচার ইত্যাদি করার লক্ষ্যে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। উক্ত আইনটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ নামে পরিচিত। আইনের ২৫ এবং ২৯ ধারায় উল্লেখ রয়েছে আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শক, মানহানিকর তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ, সম্প্রচার ইত্যাদি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যদি কোন ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোন ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে, এমন কোন তথ্য প্রেরণ করেন, যা আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শক বা এমন কোন তথ্য সম্প্রচার বা প্রকাশ করেন, যা কোন ব্যক্তিকে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ কাজ করাতে পারে বা মিথ্যা বলে জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও কোন ব্যক্তিকে বিব্রত, অপমান, অপদস্ত বা হেয় প্রতিপন্ন করার অভিপ্রায়ে কোন তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণœ করার বা বিভ্রান্তি ছড়ানোর উদ্দেশ্যে, অপপ্রচার বা মিথ্যা বলে জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও কোন তথ্য সম্পূর্ণ বা আংশিক বিকৃত আকারে প্রকাশ, প্রচার বা সম্প্রচার করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কাজ একটি অপরাধমূলক কাজ হিসেবে বিবেচিত হবে। যদি কোন ব্যক্তি এ ধরনের অপরাধ সংগঠন করেন, তবে তা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ ধারা মতে- ৩ বছরের কারাদ- ও ৩ লাখ টাকা অর্থদ-ে কিংবা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আর অপরাধী যদি পুনঃপুনঃ এ ধরনের অপরাধ করতে থাকে, তবে সেক্ষেত্রে সাজার পরিমাণ বেড়ে গিয়ে অনধিক ৫ বছর এবং অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদ-ের বিধান রাখা হয়েছে। একইভাবে উক্ত আইনের ২৯ ধারায় উল্লেখ রয়েছে মানহানিকর তথ্য প্রকাশ, সম্প্রচার ইত্যাদি করলে দ-নীয় অপরাধ হিসেবে পরিগণিত হবে। ওয়েবসাইট বা ফেসবুক বা অন্য কোন ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে দ-বিধি আইনের ৪৯৯ ধারায় বর্ণিত অপরাধ সংঘটন করেন, তাহলে অপরাধী একই দ-ে দ-িত হবেন। একটি প্রচলিত প্রবাদ বাক্য রয়েছে, ‘আইন না জানা কোন অজুহাত নয়’। রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে প্রত্যেককে আইন জানতে হবে। অজ্ঞতার কারণে কেউ দায়মুক্ত হতে পারবে না। কেউ জানুক বা না জানুক আগুনে হাত দিলে হাত পুড়ে যাবে। একইভাবে অপরাধ করলে অপরাধীকে সাজা পেতেই হবে। আইন জানা ছিল না -এ রকম যুক্তিতে কেউ পার পেতে পারবে না। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আমাদের জীবন পরিচালনা করতে পারলে অন্তত কোন আইনী ঝামেলায় জড়াতে হবে না। কাজেই আসুন আমরা আইন জেনে-বুঝে কথা বলি। আমাদের বাক্-স্বাধীনতা আছে, কিন্তু সেই স্বাধীনতারও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানসহ দ-বিধি আইন, ১৮৬০, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ যে ধারণা দেয়, তাতে আইনের প্রতি সম্মান রয়েছে- এমন কোন ব্যক্তির অনুধাবন করতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, বাক্-স্বাধীনতার সীমারেখা কতটুকু? লেখক : আইনজীবী ও প্রাবন্ধিক [email protected]
×