ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ হযরত মরিয়াম ‘আলায়হাস্ সালাম’

প্রকাশিত: ০৯:২২, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৯

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ হযরত মরিয়াম ‘আলায়হাস্ সালাম’

হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালামের আম্মাজান হচ্ছেন হযরত মরিয়াম আলায়হাস্ সালাম। ভাষাভেদে এই মরিয়ম নামটির বিভিন্ন উচ্চারণ রয়েছে। যেমন : আরবীতে মারইয়াম, হিব্রুতে মারিয়া, লাতিন ও ইংরেজীতে মেরী। কুরআন মজিদের ১৯ নম্বর সূরার নাম মারইয়াম। সূরা মারইয়ামের ১৬ নম্বর আয়াতে কারিমা থেকে ৩৫ নম্বর আয়াতে কারিমা পর্যন্ত হযরত মরিয়াম ‘আলায়হাস্ সালাম প্রসঙ্গ এবং তাঁর আব্বা-আম্মা উভয়েই যে বনী ইসরাইল বংশোদ্ভূত তা রয়েছে। হযরত মরিয়াম ‘আলায়হাস্ সালামের আব্বার নাম ইমরান, আম্মার নাম হান্না এবং নানাজানের নাম ফাকুম। ইমরান ও হান্না অতিশয় বার্ধক্যে উপনীত হয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু তখনও তাঁরা নিঃসন্তান ছিলেন। একদিন তাঁরা একটি পাখিকে দেখতে পেলেন যে পাখিটি তার ছানাকে ঠোঁট দিয়ে খাওয়াচ্ছে। তখন তাঁদের অন্তরে সন্তান লাভের আকাক্সক্ষা প্রবল হয়ে উঠল। তাঁরা আল্লাহর দরবারে একটি সন্তানের জন্য দোয়া করলেন। আল্লাহ জাল্লা শানুহু এই বয়সের ভারে ন্যুজ দম্পতির দোয়া কবুল করলেন। দেখা গেল কিছু দিনের মধ্যেই ইমরানের স্ত্রী হান্না গর্ভবতী হয়ে গেছেন। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন এই সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে ওকে বায়তুল মুকাদ্দাসের খিদমতে নিয়োজিত করবেন। তাঁরা এই মানতকালে ভাবেননি যে, যদি কন্যা সন্তান হয় তা হলে তো এই কাজে নিয়োজিত করা যাবে না। কেননা স্ত্রীলোক বা কন্যা সন্তানকে মসজিদের খাদিম নিয়োজিত করার কোন ধর্মীয় বিধান নেই। কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : যখন ইমরানের স্ত্রী বলেছিল : হে আমার রব, আমার গর্ভে যা আছে তা একান্ত আপনার জন্য উৎসর্গ করলাম। সুতরাং আপনি আমার নিকট থেকে তা কবুল করুন। নিশ্চয়ই আপনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। অতঃপর যখন সে তা প্রসব করল তখন সে (হান্না) বলল হে আমার রব, আমি কন্যা সন্তান প্রসব করেছি। সে যা প্রসব করেছে আল্লাহ্ তা সম্যক অবগত। আর ছেলে তো এই মেয়ের মতো নয়, আমি ওর নাম রেখেছি মারইয়াম। (সূরা আল ইমরান : আয়াত ৩৫-৩৬)। হযরত মরিয়াম আলায়হাস্ সালাম ভূমিষ্ঠ হওয়ার পূর্বেই পিতৃহারা হন। শিশু মরিয়ামের লালন-পালনের দায়িত্বভার নেয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন তাঁর খালু হযরত যাকারিয়া আলায়হিস্্ সালাম। কিন্তু ইহুদী যাজকরা জোর আপত্তি জানায়। এ ছাড়াও অনেকেই তাঁর অভিভাবক হওয়ার জন্য দাবি উত্থাপন করে। তখন যাজকগণ সিদ্ধান্ত দেয় এই অভিভাকত্ব নির্ধারণের জন্য লটারি করা হোক, নদীতে কলম নিক্ষেপ করা হোক। যার কলম ভেসে উঠবে সেই মরিয়ামের অভিভাবকত্ব লাভ করবে। আগ্রহী সবাই কলম ছুড়ল, কিন্তু দেখা গেল বৃদ্ধ যাকারিয়া আলায়হিস সালামের কলমই ভেসে উঠেছে। ফলে যাকারিয়া আলায়হিস সালামই অভিভাবক সাব্যস্ত হলেন। মরিয়ামের আপন খালু হযরত যাকারিয়া আলায়হিস্ সালাম- তিনিও নবী ছিলেন। তাঁর অভিভাবকত্বেই হযরত মরিয়াম আলায়হাস সালাম বালিকা হয়ে উঠলেন। হযরত মরিয়াম আলায়হাস সালামের তাঁর ইবাদত বন্দেগীর ক্ষেত্রে নিষ্ঠা, তাঁর তাকওয়া ও যুহদ তথা জগত সংসারের প্রতি অনাসক্তির কথা জেরুজালেমের অধিবাসীদের মুখে মুখে ফিরতে থাকে। তিনি আবিদা ও যাহিদা হিসেবে মশহুর হয়ে যান। ফেরেশ্তাগণ তাঁকে জানিয়ে যান যে, ইয়া মারইয়ামু ইন্নাল্লাহাসতফাকি ওয়া তহহারাকি ওয়াসতফাকি ‘আলা নিসায়িল্ আলামীন। ইয়া মারইয়ামুক্নুতী লি রব্বিকি ওয়াসজুদী ওয়ারকাঈ মা’আর রকি’ঈন- হে মারইয়াম- আল্লাহু, আপনাকে মনোনীত ও পবিত্র করেছেন এবং আপনাকে বিশ্বজগতের নারীগণের মধ্যে মনোনীত করেছেন। হে মারইয়াম, আপনি আপনার রবের অনুগত হোন ও সিজদা করুন এবং যাঁরা রুকু করে তাঁদের সঙ্গে রুকু করুন। (সূরা আল ইমরান : আয়াত ৪২-৪৩)। বায়তুল মুকাদ্দাসের পূর্বদিকে পর্দা দিয়ে ঘেরা একটি নিরালা স্থানে হযরত মরিয়াম আলায়হাস্্ সালাম গোসলাদি করতেন। জানা যায় যে, এই কারণে খ্রীস্টানরা পূর্বদিকে মুখ করে উপাসনা করে। একদিন ফেরেশতা হযরত জিবরাইল আলায়হিস্্ সালাম আল্লাহর নির্দেশে তাঁর সম্মুখে পূর্ণ মানবের সুরতে আবির্ভূত হয়ে তাঁকে একটি পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দান করলেন। কুমারী হযরত মরিয়াম আলায়হাস্্ সালাম এ কথা শুনে যে উত্তর দিয়েছিলেন তা কুরআন মজিদে রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে : মারইয়াম বললেন, কেমন করে আমার পুত্র হবে, কেননা আমাকে কোন পুরুষ স্পর্শ করেনি এবং আমি ব্যভিচারিণীও নই। সে (জিবরাইল) বলল, এমনিতেই হবে, তোমার রব (আল্লাহ) বলেছেন, হুয়া আলায়ইয়া হায়য়িনু, ওয়া লিনাজ্জ্ আলাহু আয়তাল্ লিননাসি ওয়া রহমাতাম্মিন্না, ওয়া কানা আম্রাম মাকদীইয়া- এটা আমার জন্য সহজসাধ্য এবং আমি তাকে এই জন্য সৃষ্টি করব যাতে সে হয় মানুষের জন্য এক নিদর্শন ও আমার নিকট থেকে এক অনুগ্রহ, আর এটা তো এক স্থিরকৃত ব্যাপার। (সূরা মারইয়াম : আয়াত ২০-২১)। ইতোমধ্যে হযরত মরিয়াম আলায়হাস সালাম গর্ভবতী হলেন, এটা আল্লাহর এক অনন্য কুদরতের নিদর্শন। যে নিদর্শন আমরা লক্ষ্য করি হযরত আদম আলায়হিস্্ সালামের বিনা মাতা-পিতায় সৃষ্টি হওয়াতে। হযরত মরিয়াম আলায়হাস্ সালামের প্রসব বেদনা উঠলে তিনি দ্রুত একটা খেজুর গাছের তলায় গিয়ে আশ্রয় নিলেন। ১৬ বছর বয়স্ক মরিয়াম আলায়হাস্ সালামের প্রসব বেদনার দারুণ কাতর হয়ে বলতে লাগলেন : হায়! এর পূর্বে যদি আমি মরে যেতাম ও লোকের স্মৃতি হতে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যেতাম। (সূরা মারইয়াম : আয়াত ২৩)। অদৃশ্য থেকে কে যেন তাঁকে আহ্বান করে বলল : তুমি দুঃখ কর না, তোমার পাদদেশে তোমার রব এক নহর সৃষ্টি করেছেন, তুমি তোমার দিককার খেজুর বৃক্ষের কা-খানি নাড়া দাও, তা তোমাকে সুপক্ক তাজা খেজুর দেবে। সুতরাং খাও, পান কর ও চক্ষু জুড়াও। মানুষের মধ্যে কাউকে দেখলে বলবে : আমি দয়াময়ের উদ্দেশে মৌনতা অবলম্বনের মানত করেছি। সুতরাং আজ আমি কিছুতেই কোন মানুষের সঙ্গে কথা বলব না। (সূরা মারইয়াম : আয়াত ২৩-২৬)। আরও জানা যায় যে, তিনি ৪০ দিন একটি পর্বত গুহায় অবস্থান করেছিলেন। ৪০ দিন পর শিশু ঈসাকে নিয়ে তিনি তাঁর সম্প্রদায়ের কাছে এলে তারা তাঁকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে লাগল। তারা বলতে লাগল : তোমার আব্বা তো অসৎ লোক ছিলেন না এবং তোমার আম্মাও তো ব্যভিচারিণী ছিলেন না। তখন মরিয়াম (আ.) শিশুর দিকে ইশারা করলেন। লোকজন বলল, কোলের শিশুর সঙ্গে আমরা কেমন করে কথা বলব। তখন নবজাতক শিশু ঈসা বললেন : আমি তো আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন, নবী করেছেন। যেখানেই আমি থাকি না কোন তিনি আমাকে প্রাচুর্যম-িত করেছেন। আমি যতদিন জীবিত থাকি ততদিন সালাত ও যাকাত আদায় করতে তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। আর আমাকে আমার মায়ের প্রতি অনুগত করেছেন এবং তিনি আমাকে করেননি উদ্ধত ও হতভাগ্য। (সূরা মারইয়াম : আয়াত ২৯-৩২)। হযরত মরিয়াম ‘আলায়হাস্ সালাম হযরত ঈসা আলায়হিস্্ সালামের আম্মা। জানা যায়, শেষ নবী হযরত মুহম্মদ (সা)-এর জন্ম মুহূর্তে আসমান থেকে মা আমিনার পরিচর্যার জন্য যে ক’জন হুর ও রমণী ছিলেন তাঁদের মধ্যে আসিয়া ও মরিয়ামও ছিলেন। মিলাদ শরীফে যে তাওয়াল্লুদ পড়া হয় তাতে এর বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ
×